পাসপোর্ট অধিদফতরের দুর্নীতির সিন্ডিকেটে ধস : দুর্নীতির শীর্ষে সাইদুল ইসলাম’ বিদায়ের পথে তিন পরিচালকের”
পাসপোর্ট অধিদফতরের দুর্নীতির ‘অপ্রতিরোধ্য’ সাম্রাজ্যের পতনের সুর বাজতে শুরু করেছে। ঘুষ, দুর্নীতি ও অনৈতিক উপায়ে বিপুল অর্থ উপার্জনের অভিযোগে অধিদফতরের তিন শীর্ষ পরিচালক—আবদুল্লাহ আল মামুন, মোহাম্মদ তৌফিকুল ইসলাম খান ও সাইদুল ইসলাম—এক এক করে মুখোমুখি হচ্ছেন আইনি শাস্তি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার। একসময় তারা অধিদফতরের ভেতরে গড়ে তুলেছিলেন দুর্নীতির শক্তিশালী সিন্ডিকেট, যাদের দাপটে নিয়ম-নীতির কোনো মানেই ছিল না। এখন সেই অভেদ্য সিন্ডিকেটে ধস নামছে।
এরই মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলায় চার্জশিটভুক্ত হওয়ায় আবদুল্লাহ আল মামুন ও তৌফিকুল ইসলাম খানকে বরখাস্ত করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। অপরদিকে, সাইদুল ইসলামের বিরুদ্ধেও দায়ের হয়েছে পৃথক মামলা, যেখানে আসামি করা হয়েছে তার স্ত্রী শায়লা আক্তারকেও।
“দুর্নীতি করে কেউ পার পাবে না”—মহাপরিচালকের হুঁশিয়ারি
পাসপোর্ট অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল নুরুল আনোয়ার ভোরের আওয়াজ-কে বলেন, “অনিয়ম-দুর্নীতির জায়গা নেই। এরই মধ্যে দুজন কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে, একজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। সাইদুল ইসলামের বিষয়েও দুদক পদক্ষেপ নিয়েছে।”
সাইদুল ইসলামের বিশাল সম্পদের পাহাড়
সাইদুল ইসলাম ময়মনসিংহ অফিসে কর্মরত থাকাকালে ব্ল্যাংক পাসপোর্ট ও ভুয়া এনওসির মাধ্যমে সাধারণ ফি’তে জরুরি পাসপোর্ট ইস্যু করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। অভিযোগ আছে, এসব অর্থে তিনি নিজ জেলা সাঁথিয়ায় ১০ বিঘা জমিতে পুকুর, কাশিয়ানিতে ভবনসহ জমি, ২০ বিঘার ফার্ম, নরসিংদীতে দুটি কারখানা, উত্তরায় ফ্ল্যাট ও প্লট, ধানমন্ডি ও মোহাম্মদপুরে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কিনেছেন। এছাড়া চন্দ্রিমা হাউজিং, শ্যাওড়াপাড়া, বছিলা এলাকায়ও রয়েছে বিপুল সম্পদ। এসবই করেছেন নিজের ও স্ত্রীর নামে, এমনকি কিছু বেনামিও।
২০ মে, দুদক দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে, যেখানে স্ত্রীর সম্পৃক্ততাও পাওয়া যায়। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে পরিচালক পদে কর্মরত। তবে ভোরের আওয়াজকে একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, তাকে এ পদ থেকে সরিয়ে অন্যত্র বদলি করা হবে এবং পরবর্তীতে চার্জশিটের ভিত্তিতে স্থায়ীভাবে বরখাস্তের প্রক্রিয়া শুরু হবে। আবদুল্লাহ আল মামুনের ক্ষমতার দাপট
ঢাকা বিভাগীয় অফিসের সাবেক পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ঘনিষ্ঠ এবং পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের আস্থাভাজন। এই সম্পর্কের কারণেই তিনি দীর্ঘদিন ছিলেন প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এমনকি অধিদফতরের মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত মহাপরিচালকের আদেশও অমান্য করার দুঃসাহস দেখিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে ২১ জুন ২০২২ সালে দায়ের হওয়া মামলায় ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ চার্জশিট আদালতে গৃহীত হলে ২৭ এপ্রিল তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তাকে নিয়েও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। পাসপোর্ট অধিদফতরে তার প্রভাব এতটাই ছিল যে, কেউ মুখ খুলতে সাহস পেত না। বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হওয়া ছাড়াও, অবৈধভাবে বেনজীর আহমেদকে পাসপোর্ট দেওয়ার মামলার আসামিও তিনি।মতৌফিকুল ইসলাম খানের বিলাসবহুল জীবন- তৌফিকুল ইসলাম খান, যিনি ডাটা অ্যান্ড পার্সোনালাইজেশন সেন্টারের পরিচালক ছিলেন, তাকেও বরখাস্ত করা হয় ৯ মার্চ। ২০০৪ সালে সহকারী পরিচালক হিসেবে যাত্রা শুরু করে মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে তিনি পরিচালক পদে উন্নীত হন। এই সময়কালে তার বেতন ৫৫ হাজার থেকে বেড়ে ৭৫ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়। কিন্তু এর সঙ্গে সংগতি না রেখেই তিনি ঢাকায় ৮টি ফ্ল্যাট, ৭টি প্লট, ২টি দোকান এবং ৬৪ লাখ টাকার এফডিআরের মালিক হন। উত্তরায় ১৫০০ বর্গফুট ফ্ল্যাট (মূল্য ১ কোটি ১০ লাখ), ধানমন্ডি, গ্রিন রোড ও লালমাটিয়ায় একাধিক ফ্ল্যাট, শান্তিনগরে ভাইয়ের নামে কেনা ১ কোটি ২৬ লাখ টাকার ফ্ল্যাট, এমনকি নীলক্ষেতেও ২টি দোকান রয়েছে তার দখলে। সিন্ডিকেটের ছায়া আরও গভীরে
পাসপোর্ট অধিদফতরের উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র ভোরের আওয়াজকে জানায়, এই তিনজনের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল দুর্নীতির সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট। তারা শুধু নিচের কর্মকর্তাদের নয়, উপরমহলের নির্দেশনাও অগ্রাহ্য করতেন। এমনকি মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত মহাপরিচালকের বিরুদ্ধেও ষড়যন্ত্র করেছেন। বর্তমানে অধিদফতরের আরও কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে। দুদকের নথিপত্র অনুযায়ী, শিগগিরই তাদের বিরুদ্ধেও মামলা এবং বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে যোগদানের পর পরিচালক সাইদুল ইসলাম গড়ে তুলেছেন ঘুষ বাণিজ্যের এক ভয়াবহ সাম্রাজ্য। ২০২৩ সালের জুনে তিনি এ পদে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে আজ অবধি মাত্র এক বছরের ব্যবধানে তার বিরুদ্ধে ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে প্রায় ১০০ কোটি টাকা অবৈধভাবে আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। সাধারণ মানুষের পাসপোর্ট পাওয়ার প্রক্রিয়াকে তিনি পরিণত করেছেন এক লজ্জাজনক দালাল-নির্ভর মেশিনে।
ফাইলপ্রতি ১৬ শত টাকা, দৈনিক লাখে পৌঁছায় আদায়-ভোরের আওয়াজের অনুসন্ধানে জানা যায়, চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের অধীনে থাকা জেলা পাসপোর্ট অফিস এবং মুনসুরাবাদ পাসপোর্ট অফিসের প্রতিদিনের ডেলিভারি সংখ্যা গড়ে ৩০০ থেকে ৪০০। প্রতিটি পাসপোর্ট ডেলিভারির বিপরীতে নির্ধারিত ফি ছাড়াও গোপনে আদায় করা হয় ফাইলপ্রতি ১৬০০ টাকা ঘুষ, যার একটি অংশ সরাসরি পরিচালক সাইদুল ইসলামের দখলে যায়।
একটি সাধারণ হিসাবে দেখা যায়, প্রতিদিন ৩৫০টি পাসপোর্ট × ১৬০০ টাকা = ৫,৬০,০০০ টাকা দৈনিক ঘুষ আদায়। মাসিক হিসাবে যা দাঁড়ায় প্রায় ১ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। এভাবে ১২ মাসে তার গোপন সিন্ডিকেট প্রায় ১০০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ সংগ্রহ করেছে। দালাল নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তিগত বাহিনী সাইদুল ইসলাম পাসপোর্ট সেবাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যবহার করছেন একাধিক দালালচক্র। মুনসুরাবাদ অফিসে তার নির্দেশে নির্দিষ্ট কিছু দালাল প্রবেশাধিকার পায়, যাদের মাধ্যমেই হয় কাগজপত্র যাচাই, তথ্য সংশোধন, জরুরি পাসপোর্ট অনুমোদনসহ সবকিছু। সাধারণ মানুষ সেখানে গিয়ে সেবা না পেয়ে বাধ্য হয় দালালের হাতে টাকা তুলে দিতে।
ভেতরে থাকা একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, এসব দালালদের তালিকা তিনি নিজেই নির্ধারণ করেন এবং তাদের মাধ্যমে প্রতি সপ্তাহে মোটা অঙ্কের অর্থ কালেকশন করেন। অর্থ লেনদেনে হয় মোবাইল ব্যাংকিং, নগদ টাকা এবং বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের মাধ্যমে হস্তান্তরের পদ্ধতি।
দুর্নীতির টাকায় জমি, ফ্ল্যাট, ব্যবসা সম্প্রসারণ, চট্টগ্রামে যোগদানের পর তার সম্পদের বহর আরও বিস্তৃত হয়। কক্সবাজার, রাঙ্গুনিয়া ও পটিয়ায় জমি কেনা ছাড়াও চট্টগ্রাম নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কেনার খবর পাওয়া গেছে। এছাড়াও আগে থেকেই ঢাকায় ধানমন্ডি, উত্তরায় ফ্ল্যাট, চন্দ্রিমা হাউজিং-এ প্লট, সাঁথিয়ায় ফার্মহাউজ ও নরসিংদীতে দুটি কারখানা রয়েছে। তার স্ত্রী শায়লা আক্তারের নামেও কিছু সম্পত্তি রয়েছে, যা মূলত সাইদুলের দুর্নীতির টাকায় কেনা হয়েছে—এমন অভিযোগে দুদক তাদের দুজনকেই আসামি করেছে। সাময়িক বরখাস্তের প্রক্রিয়া শুরু-চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, এসব তথ্য গোপনে ঢাকায় প্রেরণ করা হয়েছে এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও দুদক এই কর্মকর্তা সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ অনুসন্ধানে নেমেছে।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, মামলার চার্জশিট জমা হলে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হবে, এবং তার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণে আর দেরি হবে না।
সাধারণ নাগরিকরা বলছেন, ‘পাসপোর্ট অফিস এখন ঘুষের কারখানা’
ভুক্তভোগী এক পাসপোর্ট আবেদনকারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “দালাল ছাড়া কোনো কাজই হয় না। ১৬০০ টাকা না দিলে ফাইলই নড়ে না। এটা ওপেন সিক্রেট। কর্মকর্তারাও জানেন, কিছু বলেন না।” সাইদুল ইসলাম শুধু একজন ব্যক্তি নন, তিনি একটি দুর্নীতির প্রতীক হয়ে উঠেছেন। তার বিরুদ্ধে অবিলম্বে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে পাসপোর্ট অধিদফতরের বিশ্বাসযোগ্যতা পুরোপুরি ধসে পড়বে। দেশের নাগরিকদের প্রতি এই অধিদফতরের দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত পদক্ষেপ এখন সময়ের দাবি।