সে এক অন্তর্লীন সন্ধ্যা। হাওয়াই গিটার সংগঠনের ৪১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে থিয়েটার ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণে আয়োজন হয়েছিল একটি সংগীতের জলছবি। রাত নেমে এলে যেমন নদীর বুকে চাঁদের প্রতিফলন পড়ে, ঠিক তেমন করে সুরের ঢেউ এসে ছুঁয়ে গেল আমার মনের তটরেখা। এই আয়োজন ছিল কেবল একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নয়, ছিল এক রকম আত্মদর্শনের উপলক্ষ, যেখানে সময় থমকে দাঁড়ায়, স্মৃতি ভেসে ওঠে, আর শিল্পী ও শ্রোতার মাঝে গড়ে ওঠে এক অব্যক্ত বন্ধন।
হঠাৎ করেই পেছন থেকে ভেসে এলো এক চেনা কণ্ঠ—“কামাল ভাই!”—পেছনে ঘুরতেই দেখলাম কল্যাণী ঘোষ, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের জীবন্ত প্রতীক। তাঁর পাশে গীতা আচার্য্য, যিনি চাটগাঁইয়া গানের প্রাণস্পন্দন হয়ে বহুদিন ধরে আমাদের হৃদয়ে দোলা দিয়ে চলেছেন। আমি বিস্মিত, আনন্দিত এবং আপ্লুত। সময় যেন এক লহমায় পেছনে ফিরে গেল।
তাঁদের দুজনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আজকের নয়—বাংলা টিভিতে “কিছু কথা, কিছু গান” অনুষ্ঠানে তাঁরা ছিলেন আমার গল্পের, আমার শ্রুতিমধুর আলাপচারিতার অংশ। একসাথে কত আয়োজন, কত অনুষঙ্গ, কত গান আর গানে গাঁথা চট্টগ্রামের সংস্কৃতি। সেই সব দিন ফিরে এলো, মুহূর্তে মন ভরে উঠল এক অদ্ভুত মাধুর্যে।
গীতা আচার্য্যের নাম উচ্চারণ করতেই স্মৃতির ঝাঁপি খুলে গেল—তাঁর ভাই সজ্জিত আচার্য্যের মুখ ভেসে উঠল চোখে। তিনি ছিলেন আঞ্চলিক গানের এক নির্লোভ সাধক। ‘সাম্পানওয়ালা’, ‘বাঁশখালী মহেশখালী’, ‘আঁই চাটগাঁইয়া’—এমন সব গান তাঁর হাত ধরেই জন্ম নিয়েছিল, হয়ে উঠেছিল অঞ্চলভিত্তিক গানের প্রাণরসায়ন। আমার লেখাও তিনি সুরারোপ করেছিলেন, এবং সেসব গানের জন্ম হয়েছিল আমাদের হৃদয়-মিলনের এক পরম মুহূর্তে। আজ তিনি নেই, অভিমানে কিংবা অপমানবোধে গান ছেড়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন—সেই ক্ষত আজও রয়ে গেছে শিল্পীমনের গভীরে।
কল্যাণী ঘোষ সেই ক্ষতের মাঝে গান বয়ে নিয়ে চলেছেন আজও, সুরকে করেছেন জীবনসঙ্গী। তাঁর চোখে সেদিন দেখা গিয়েছিল অতীতের আলো আর বর্তমানের ব্যথা—এক সুরের সাধনার দুই প্রান্ত।
আমাদের প্রজন্ম থেকে নতুন প্রজন্মের কাছে চাটগাঁইয়া ভাষা আর আঞ্চলিক গান যেন ধীরে ধীরে অপরিচিত হয়ে উঠছে। অথচ এ ভাষা, এ গানই তো আমাদের শিকড়, আমাদের আত্মপরিচয়ের মূল স্তম্ভ। আজ যখন এই দুই শিল্পীকে একত্রে কাছে পাই, তখন মনে হয়—তাঁদের গান, তাঁদের জীবন, তাঁদের অণুগল্পগুলো সংরক্ষণ করা আমাদের সাংস্কৃতিক দায়িত্ব।
তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে ছবিটি যখন তুলছিলাম, বুঝতে পারছিলাম, এটি কেবল একটি ছবি নয়—এ এক ইতিহাস, এক অনুপম বন্ধনের নিদর্শন। সেই মুহূর্তটি আমার সাংবাদিকজীবনের গর্বিত স্মৃতি হয়ে থাকবে, যেমন থাকে কোনো পুরোনো খাতার ভিতর লুকিয়ে রাখা একটি চিঠি—অতি প্রিয়, অতি আপন।
এখন সময় এসেছে, কলম দিয়ে তাঁদের শিল্প-ভাস্কর্য অঙ্কনের। সেই দায়িত্ব আমি নিয়েছি। আজকের এই লেখা সেই যাত্রার সূচনা মাত্র।