চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী থানার এক সফল অভিযানে যেভাবে কথিত সাংবাদিক পরিচয়ধারী এক ব্যক্তিসহ চারজন চাঁদাবাজ ধরা পড়েছে, তা কেবল একটি সাধারণ অপরাধ দমনের ঘটনা নয়—এ এক ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধির প্রতিচ্ছবি। এদের অপকর্মে কলঙ্কিত হচ্ছে যে পেশাটি একসময় জাতির বিবেক হিসেবে পরিচিত ছিল, সেটি হলো সাংবাদিকতা।
ঘটনার বিস্তারিত বলছে, স্টারশিপ গলিতে ভুক্তভোগী জয়নালকে মারধর, অর্থ ছিনতাই, এরপর জোরপূর্বক একটি অফিসে আটকে রেখে মোবাইল ফোনের ভিডিও দিয়ে ব্ল্যাকমেইল—সব মিলিয়ে এক ভয়াবহ অপরাধচক্রের চিত্র উঠে এসেছে। অভিযুক্তদের একজন নিজেকে সাংবাদিক বলে পরিচয় দিতেন। আর এটাই আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় লজ্জার বিষয়।
আমি সাংবাদিকতা করছি প্রায় চার দশক ধরে। এই দীর্ঘ সময় আমি লিখেছি, পড়েছি, গবেষণা করেছি—তারই ফসল ‘সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের কথা’ নামের একটি বই, যেখানে পেশাটির ইতিহাস, দায়বদ্ধতা ও বর্তমান সংকট নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করেছি। এই বইটি দেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে রেফারেন্স বই হিসেবে অন্তর্ভুক্তির প্রক্রিয়ায় রয়েছে। তা সত্ত্বেও আমি আজও নিজেকে পরিপূর্ণ সাংবাদিক বলতে সংকোচ বোধ করি। কারণ আমি জানি, সাংবাদিকতা একটি কঠিন, নিবেদিত ও সাহসিকতার পেশা—এটি কেবল কার্ড ঝুলিয়ে বা অনলাইন পোর্টালের নাম ব্যবহার করেই হয় না।
কিন্তু আজ এমন এক দুঃসময় এসেছে, যেখানে কিছু লোক নামসর্বস্ব অনলাইন পোর্টাল খুলে বা মুদ্রিত কার্ড ছাপিয়ে নিজেকে সাংবাদিক বলে পরিচয় দেয়। তারা সমাজে ভয়ভীতি ছড়িয়ে, চাঁদা তুলে, মানুষের দুর্বলতাকে পুঁজি করে ব্যবসা করে। এরা সাংবাদিকতার সবচেয়ে বড় শত্রু। এদের হাতে পেশার সম্মান প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, সাধারণ মানুষ প্রকৃত সাংবাদিকদেরও সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছে।
আমি কয়েক মাস আগে সাহসিকতার সঙ্গে একটি ঘোষণা দিয়েছিলাম—যে কেউ লেখালেখি, টিভি উপস্থাপনা কিংবা তাত্ক্ষণিক স্ক্রিপ্ট রচনায় আমাকে হারাতে পারে, আমি তাকে এক লক্ষ টাকা পুরস্কার দেব। আজও কেউ সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেনি। কারণ সাংবাদিকতা প্রতিভার, অভিজ্ঞতার, এবং সমাজচেতনার এক জটিল সংমিশ্রণ—এটি অনুকরণ বা ভান করে হয় না।
এই প্রেক্ষাপটে ওসি মো. আরিফুর রহমানের নেতৃত্বে বায়েজিদ থানার অভিযানের প্রশংসা না করে পারা যায় না। তারা সময়মতো পদক্ষেপ নিয়ে একটি ভয়ংকর চক্রকে ধ্বংস করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই ধরনের ভুয়া সাংবাদিকের উৎস কোথায়? কে বা কারা তাদের মদদ দেয়? স্থানীয় বা জাতীয় পর্যায়ের কতজন তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত?
এই অপসাংবাদিকদের প্রতিহত করতে হলে আমাদের সমাজকে, আমাদের সংবাদমাধ্যমকেও আত্মবিশ্লেষণ করতে হবে।
সংবাদপত্র বা টিভি প্রতিষ্ঠানের ভেতর থেকে যে অনিয়ন্ত্রিত আইডি ইস্যু হয়, সেগুলোকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
সাংবাদিক সংগঠনগুলোকে আরও দায়িত্বশীল ও স্বচ্ছ হতে হবে—ভুয়া সাংবাদিকদের বিষয়ে ‘নীরব সম্মতি’ নয়, বরং কঠোর অবস্থান নিতে হবে।
সংবাদপাঠক, কলাম লেখক, মাঠ-সাংবাদিক—সবার পেশাগত পরিচয় যাচাইয়ের সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা থাকতে হবে।
সাংবাদিকতা কোনো অলঙ্কার নয়, এটা জাতির বিবেক। এর অপব্যবহার হলে শুধু পেশাটি নয়, সমাজ, ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্রও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তাই আজ সময় এসেছে সাংবাদিকতার নামে এই চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে কলম ধরার, প্রতিবাদ গড়ার এবং সমাজকে জানিয়ে দেওয়ার—তাদের হাতে আমরা আমাদের পেশাকে তুলে দেব না।
সাংবাদিকতা বেঁচে থাকবে তাদের হাত ধরে, যারা কথা বলে সাহস নিয়ে, যারা সত্যের পক্ষে লিখে নির্ভীকভাবে, আর যারা কোনো ভুয়া পরিচয়ের আড়ালে নয়, নিজের বিবেক আর আদর্শকে পাথেয় করে পথ চলেন।
লেখকঃ যুগ্ম সম্পাদক ও চট্টগ্রাম
বিভাগীয় ব্যুরো প্রধান,
দৈনিক ভোরের আওয়াজ ও The Daily banner,
#গবেষক ও টেলিভিশন উপস্থাপকঃ