রাতভর ঝরেছে রহমতের বৃষ্টি, যেন আকাশ নিজেই নেমে এসেছে মাটির বুক জুড়ে। বৃষ্টির ধারা যখন থেমেছে, শহরের বুকজুড়ে এক কোমল আলোয় জেগে উঠেছে সকাল। বাটালি হিলের চূড়ায় দাঁড়িয়ে সূর্য যেন আজ একটু বেশি স্নেহবতী। ভেজা পাতা আর নিঃশব্দ বাতাস মিলে তৈরি করেছে এক অপার্থিব পরিবেশ। সেই ভোরে আমি হাঁটতে বের হলাম, হৃদয়ের নিভৃত কোনায় জমে থাকা ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলার আশায়।
সেই আলোছায়ার মোড় ঘুরতেই দেখা হয় একজন মানুষের সঙ্গে—যিনি প্রথম দেখাতেই ভরিয়ে দেন এক আশ্চর্য প্রশান্তিতে। বয়স পেরিয়েছে ষাট, তবু চোখে-মুখে ক্লান্তির চিহ্ন নেই, বরং এক ধরনের অন্তরাত্মার দীপ্তি। সঙ্গে আছেন একজন বোরকাপরা রমণী, যিনি প্রথমত এক নির্লিপ্ত অথচ দৃঢ় ব্যক্তিত্বের প্রতীক, পরে বুঝি—তিনি ডাক্তারের সহধর্মিণী।
ডা. হাশমত আলী মিয়া। নাম শুনলেই বোঝা যায়—চিকিৎসার জগতে এক বিশিষ্ট পরিচিতি। কিন্তু সেই নামের চাইতেও বড় হয়ে ওঠে তার ব্যবহার, তার নম্রতা, তার কোমল মনোভাব। তিনি চিকিৎসক শুধু নন, যেন একজন জীবনচর্চার সাধক। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা স্ত্রী—যাঁর নাম আমরা জানি না, কারণ তিনি নিজেই নিজের নামকে আড়াল করে রেখেছেন—তাঁর চোখের ভাষায় যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তিনি একজন অনুভূতির মানুষ। কেউ কোনো কথা না বলেও হৃদয়কে নাড়া দিতে পারে—সেই শক্তি তাঁর চোখে, তাঁর মৃদু হাসিতে।
আমাদের পরিচয় হয় হঠাৎ করেই, কিন্তু কথা বলতে বলতে মনে হলো—এই মানুষগুলো তো চিরপরিচিত! যেন পূর্বজন্মের কোনো বন্ধন আজ সকালের আলোয় ফিরে এসেছে। ডা. হাশমতের চোখেমুখে কোনো চিকিৎসকের কৃত্রিম গাম্ভীর্য নেই। আছে এক আশ্বাসের ভাষা। আমি বলি আমার স্ত্রীর দীর্ঘ রোগভোগের কথা। তিনি শোনেন মনোযোগ দিয়ে—মাথা নাড়েন, কখনো চোখে চোখ রাখেন, কখনো মৃদু হাসেন। তাঁর প্রতিটি কথা যেন শরীরে নয়, মনের গভীরে গিয়ে আঘাত করে—আর দাগ রেখে যায়।
“রোগী শুধু শরীরের অসুখে ভোগে না,” তিনি বললেন, “ভোগে মানসিক একাকীত্বে, ভোগে দুশ্চিন্তার অন্ধকারে। একজন চিকিৎসক যদি তার সঙ্গে হাঁটে, তবে শুধু ওষুধ নয়—একটা আলোকিত পথও দিতে পারে।”
আমি চুপ করে থাকি। কোথায় যেন শোনা এই কথা, কিন্তু এইভাবে কখনো শোনা হয়নি।
আলাপ চলতে থাকে—খাবার-দাবার, হাঁটার নিয়ম, মেডিকেল পরীক্ষার গুরুত্ব, এমনকি ভালোবাসার ভূমিকাও। আশ্চর্য লাগে—একজন চিকিৎসক যখন বলেন, “যিনি পাশে থাকেন, তিনিই সবচেয়ে বড় ওষুধ”—তখন বোঝা যায়, চিকিৎসা একটানা পেশা নয়, এক মহৎ সাধনা।
সেই আলোছায়া ভরা পথে হাঁটতে হাঁটতেই তিনি বললেন, “আমি কিডনি নিয়ে কাজ করি বটে, কিন্তু আমার চোখ পড়ে হৃদয়ের কিডনিতে। কারণ সব কষ্ট সেখানেই জমে।”
আমি তাকিয়ে দেখি, তাঁর চোখে জল চিকচিক করে—একেবারে অনিচ্ছায়, যেন কারো অজান্তে গড়িয়ে পড়বে। পাশে থাকা তাঁর স্ত্রী আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন—নীরব, তবু অকাট্য এক ভাষা নিয়ে। আমি বুঝি, এই দাম্পত্য শুধু সংসার নয়—এক মানবিক বন্ধনের নিটোল উদাহরণ।
হঠাৎ তিনি বললেন, “চলেন, আজ প্রাতঃভ্রমণ একটু ভিন্ন হোক। আমরা সকালের এক আনন্দঘন প্রীতিভোজ করি।”
আমরা বসলাম এক জায়গায়—যেখানে বাংলার স্বাদ আর সৌন্দর্য মিলে একাকার। গরুর নলা, মুরগির স্যূপ, নানরুটি, আর হাইওয়ের সেই বিখ্যাত দই। হাসি-আলাপ আর স্মৃতির বিনিময়ে সময় গড়িয়ে গেল।
তাঁর স্ত্রী বললেন, “আমি আপনার লেখা পড়েছি। জাহিদ ভাই বলেছিলেন, আপনি একজন গভীর ও মানবিক লেখক।”
আমি অবাক হই। যিনি চোখে চোখ রাখেন না, তিনিই বুঝে নেন হৃদয়ের গোপন ভাষা। আমি বলি কিছু না—শুধু মাথা নিচু করে থাকি, সম্মানের ভার সয়ে উঠতে পারি না।
খাবার শেষে, আলো কিছুটা গাঢ় হয়, বাতাসে নেমে আসে এক পরিপূর্ণ প্রশান্তি। মনে হলো, এই সকাল শুধু একটি দিনের সূচনা নয়—এক মানবিক সাক্ষাতের মাইলফলক। হৃদয়ের কোথাও লেখা হয়ে গেছে তাঁদের নাম—ডা. হাশমত আলী মিয়া ও তাঁর সহধর্মিণী। তিনি ফরিদপুরের পুত্রবধূ হয়েও চট্টগ্রামের হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছেন। তাঁর ব্যবহার, বুদ্ধিমত্তা, পর্দার আড়ালে থেকেও আলোকবর্তিকা হয়ে ওঠা—সবকিছু মিলিয়ে তিনি একজন অনন্যা নারী। সমাজে এমন কিছু মুখ দরকার, যারা দেখায় না, কিন্তু জ্বলে।
সকাল গড়িয়ে দুপুর, আমি হাঁটি আবার ফিরতি পথে। কিন্তু মনে হয়, যেন আজ কিছু থেকে গেল। হৃদয়ের পাতায় লেখা হয়ে গেল এক নতুন অধ্যায়। মানুষ কখনো শুধু নাম-পরিচয়ে বড় হয় না—তাদের বড় করে তোলে তাদের আচরণ, তাদের নীরবতা, আর অসীম মানবিকতা। এই গল্প তাই একজন ডাক্তারকে নিয়ে নয়, বরং এক মানবিক আত্মার উন্মোচন।
যদি কোনোদিন এই স্মৃতি মলিন হয়, তবু তাঁদের কোমল উপস্থিতি, সেই সকালে বলা কথা, আর হৃদয়ের গভীরে ছুঁয়ে যাওয়া অনুভব চিরকাল থাকবে—আমার আত্মার গহীনে, একজন লেখক হিসেবে নয়, একজন মানুষ হিসেবে।