চরণদ্বীপ, নদী বেষ্টিত এক গ্রাম। দিনে নৌকা চলে, রাতে গরু চুরি চলে। গ্রামের লোকজন জানে, এখানে রাত হলেই শুরু হয় “গরু উদ্ধার অভিযান”, যদিও আইন ভাষায় একে বলে চুরি। কিন্তু এসব কিছুতেই এলাকার গণমাধ্যমের তেমন আগ্রহ নেই—যতক্ষণ না “গরু চোর” নিজেই সাক্ষাৎকার দিতে চায়।
একদিন সকালে চরণদ্বীপের গাছপালায় ভরা এক জঙ্গলময় পথে দেখা গেল এক অদ্ভুত দৃশ্য—এক লোক লাল রঙের মাইক মুখের সামনে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। অপর পাশে একজন হাত নেড়ে-নেড়ে কথা বলছে। জামার বোতাম খোলা, মুখে আত্মবিশ্বাস, পেছনে গাছ, মাটিতে শুকনা পাতা—সেটা যেন এক ‘জীবন বদলানো’ সাক্ষাৎকার!
লোকটি বলছে—
“দেইখেন ভাই, আমরা গরু চুরি করি ঠিকই, কিন্তু সেটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। গরুগুলা রাস্তায় রোদের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়—কেউ তো ওদের একটা ছায়া দেয় না! আমি ওদের নিরাপদ আশ্রয়ে নিই, আর এইটা হইলো মানবিক কাজ!”
সাংবাদিক মুহূর্তেই ফেসবুক লাইভ চালু করে বলেন,
“প্রিয় দেশবাসী ও চরণদ্বীপের ভাই-বোনেরা, মন দিয়ে শুনুন! গরু চোরদের এই দৃষ্টিভঙ্গি আগে কেউ শোনেনি!”
চোর আবার হাত তুলল, “আমার বাবা ছিলেন ঐতিহাসিক ছাগল চোর। উনি বলতেন, পশুদের স্বাধীনতা দিতে হয়। আমি সেই পথেই হাঁটতেছি, শুধু গরুটা একটু দামী, তাই বেশি কেয়ার লাগে।”
এই সময় পেছন থেকে ভেসে এল এক ক্ষুব্ধ গলায় চিৎকার,
“এই যে সাংবাদিক ভাই, ওরে তো গত কইদিন আগে আমার গরু চুরি করতে ধইরা বাঁশি দিছিলাম! এখন লাইভে কি বান্ধবী হইছে?”
সাংবাদিক বিব্রত হলেও ক্যামেরা বন্ধ করলেন না। বরং বললেন,
“এটাই তো গণতন্ত্রের সৌন্দর্য! প্রত্যেকের কথা শোনার অধিকার আছে।”
চোর হালকা হেসে বলল, “আগামী মাসে একটা সংগঠন করতে চাই—’পশু মুক্তি পার্টি’। সদস্য ফি একখান গরু!”
এই কথা শুনে গ্রামের লোকজন ফেসবুকে একের পর এক রিয়্যাক্ট দিতে লাগল। কেউ লিখল “Hero!”, কেউ লিখল “Thief of the year!”
তবে সবচেয়ে মজার ছিল চরণদ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের এক মেম্বারের মন্তব্য—
“এই সাংবাদিকরে আমরা পরের নির্বাচনে মনোনয়ন দিব, প্রচারণার দায়িত্ব গরুর উপর!”
সেই দিনের পর থেকে চরণদ্বীপে সাংবাদিকরা চোর ধরতে না গিয়ে তাদের সাক্ষাৎকার নিতে ব্যস্ত। গরুগুলোও নাকি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হাঁ করে থাকে—এই বুঝি তারাও লাইভে যাবে!
এবং তখন থেকেই একটা নতুন বাক্য গ্রামের ছেলেমেয়েরা মুখে মুখে বলত—
“চরণদ্বীপে চুরি শুধু পেশা না, প্রচারও!”
চরণদ্বীপে গরু চুরির সাক্ষাৎকার ভাইরাল হওয়ার পর এল এক নতুন যুগ। গ্রামের চা দোকানে এখন আর ক্রিকেট বা রাজনীতি নয়, আলোচনা হয়—“গরুটা কয়টা ভিউ আনছে?”
একদিন হাটবারে হঠাৎ দেখা গেল, গ্রামের মাঠে মাইকে ঘোষণা:
“চরণদ্বীপ গরু কল্যাণ ট্রাস্টের পক্ষ থেকে আগামী শুক্রবার হবে ‘গরু সম্মেলন ও সাংবাদিক সংবর্ধনা’। সকল গরু মালিক এবং চোরবৃন্দ আমন্ত্রিত!”
মাঠে এল লাল কার্পেট, গাছের ডালে টাঙানো ব্যানার—“গরুদের কথা বলুক গরুরাই!”
চোরটা এবার আর শুধু সাক্ষাৎকার দেয়নি, সরাসরি গরুদের নিয়ে মিছিল বের করেছে। এক হাতে গরুর দড়ি, আরেক হাতে প্ল্যাকার্ড:
“গরু আছে যেখানে, স্বাধীনতা সেখানে!”
সাংবাদিক ভাই এইবার গলা খাঁকিয়ে বলেন,
“বন্ধুগণ, আমরা গরুরাও (মানে, গরুর পাশে দাঁড়ানো মানুষরাও) সমাজের অবিচারের শিকার। আমাদের মাইক থাকবে, কিন্তু মওকা দিলে!”
এক বৃদ্ধ কৃষক ফিসফিস করে বললেন,
“এই যে গরু চোর, সাংবাদিক আর চেয়ারম্যান—তিনজনেই গরুর পিঠে রাজনীতি করে! গরু বেচারা বেচে আছে শুধু দুধ আর দড়ির জন্য!”
মাঠজুড়ে হাসির ঝড়।
শেষে সেই ভাইরাল চোর ঘোষণা দিল,
“পরের নির্বাচনে চেয়ারম্যান হইব আমি! প্রতীক হইলো—একটা গরু!”
হাটের লোক হইচই করে উঠল—
“জয় হোক গরুতে, জয় হোক সত্য কথায়!”
চরণদ্বীপ এখন দেশের প্রথম ‘গরু-মিডিয়া মডেল’ গ্রাম। সাংবাদিকেরা খবর করতে আসে, কিন্তু গরুরা ক্যামেরা দেখে পোজ দেয়।
সেই ভাইরাল চোর এখন “গরুবন্ধু” নামে জনপ্রিয়, আর সাংবাদিক ভাই “মাইক্রোফোন মামা” নামে খ্যাত।
আর গ্রামের পুকুরঘাটে লেখা—
“এখানে গরু চুরি নয়, গরু নিয়ে ভাবনা হয়।” চরণদ্বীপে একদিন হঠাৎ ঘোষণা এলো—
“আজ থেকে গরু চুরি আর লাইভ সাক্ষাৎকারের যুগ শেষ! এখন শুরু হবে গরুর অধিকার সংরক্ষণের যুগ।”
জনগণ হাঁ করে তাকিয়ে রইল। কী এমন হলো?
মূল ঘটনা ছিল, জেলা প্রশাসক একদিন ভুল করে ফেসবুকে ভিডিও দেখে লিখে ফেললেন:
“চরণদ্বীপে গরুদের রাজনৈতিক ক্ষমতা গড়ে উঠছে। বিষয়টি রাষ্ট্রের জন্য হুমকি।”
ব্যস, সেই থেকে পত্র-পত্রিকা, টকশো, এমনকি এক চুল্লু জাতীয় দৈনিকে হেডলাইন—
“চরণদ্বীপ: গরুরা কি জঙ্গি হয়ে উঠছে?”
পুলিশ আসল, প্রশাসন আসল, লাইভ বন্ধ, মাইক বাজেয়াপ্ত, গরুর দড়ি কাটা—সবশেষে ‘গরু চোর’ ভাইকেও ধরে নিয়ে গেল। সাংবাদিক ভাই দৌড়ে পালালেন পাশের হাটে, বললেন,
“আমি তো শুধু গল্প বলছিলাম, ও তো বাস্তব হয়ে গেল!”
গ্রামের এক বৃদ্ধ তখন পুকুরঘাটে বসে বিড়বিড় করে বললেন:
“সব নাটকেরই একটা দপন লাগে, এইটাই হলো ওই লাইভ সাংবাদিকতার কবর।”
এবং তারপর থেকেই চরণদ্বীপে আবার আগের মত শান্ত। গরুগুলো ফিরে গেছে গাছতলায়, চোর গেছে জেলখানায়, আর সাংবাদিক ভাই ব্যস্ত নতুন গল্প খুঁজতে—এইবার নাকি তিনি “মুরগি চোরের মনস্তত্ত্ব” নিয়ে কাজ করছেন।
শেষ পঙক্তি:
“গরু গেল, লাইভ গেল, চরণদ্বীপ আবার নিস্তরঙ্গ—কিন্তু ক্যামেরার লেন্সে থেকে গেলো এক চিরন্তন হাসির রেখা, যাকে বলে ‘দপন হাস্যরস’।”