চট্টগ্রাম মহানগরের প্রাণকেন্দ্র বহদ্দারহাট। প্রতিদিন লাখো মানুষের চলাচলে মুখর এই জনপদে গতকাল ৬ মে দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে যেন সময় থমকে দাঁড়ায়। সিএমপির চান্দগাঁও থানার একটি চৌকস দল আকস্মিক অভিযান চালায় এলাকার কয়েকটি স্পর্শকাতর স্থানে। অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ আফতাব উদ্দিন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) তানভীর আহমেদ, এসআই ফয়সাল ও এসআই রাশেদুল ইসলামসহ সঙ্গীয় বাহিনী।
তারা ছিলেন নির্ভার, প্রশিক্ষিত এবং পরিপূর্ণ তথ্যভিত্তিক অভিযানের প্রস্তুতিতে সুসজ্জিত। তাদের লক্ষ্য ছিল—চান্দগাঁও থানার নাশকতা মামলায় অভিযুক্তদের আটক করা, যাদের বিরুদ্ধে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৫(৩) ধারা অনুযায়ী মামলা দায়ের করা হয়েছে। অভিযানে একে একে গ্রেফতার হন নয়জন ব্যক্তি, যাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র, শান্তিপূর্ণ পরিবেশকে অস্থির করে তোলার পরিকল্পনা ও আইন-শৃঙ্খলার পরিপন্থী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে।
গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের পরিচয়:
১। মোঃ আব্দুল হামিদ রজবী (৪৬) – আনোয়ারার রায়পুরের সন্তান, বহদ্দারহাটের বাদামতলীতে বর্তমান বাসিন্দা। দীর্ঘদিন ধরেই নানা ধরনের সন্দেহজনক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত বলে গোয়েন্দা রিপোর্টে উঠে এসেছে।
মোঃ মাঈনউদ্দিন (৫০) – সাতকানিয়ার চরতির বাসিন্দা, বহদ্দারহাটের চৌধুরী স্কুলসংলগ্ন মসজিদের ইমাম। ধর্মীয় দায়িত্বের আড়ালে রাজনীতিসংশ্লিষ্ট ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকার প্রমাণ মেলে বলে পুলিশ জানায়।
সৈয়দ আব্দুল্লাহ আল ফয়সাল কাদেরী (৪০) – চিকিৎসক পরিবারের সন্তান। আনোয়ারার হাইলদর থেকে উঠে আসা এই ব্যক্তি বহদ্দারহাট এলাকায় পরিচিত মুখ। তাঁর বিরুদ্ধে গোপনে মিটিং ও সভার আয়োজনের অভিযোগ রয়েছে।
মোঃ আবু বক্কর (২৯) – রাউজানের নোয়াপাড়ার বাসিন্দা। বর্তমানে চান্দগাঁওর মৌলভী বাজারে থাকেন। প্রযুক্তিনির্ভর চক্রে সক্রিয় ছিলেন বলে জানা যায়।
মোঃ জসীম উদ্দিন (৩৮) – বাকলিয়ার পুরনো বাসিন্দা। দার্শনিক চেহারা ও নম্র ভাষার আড়ালে প্রচার-প্রচারণা চালানোর দায়িত্বে ছিলেন বলে অভিযোগ।
ইয়ামলিহা বিন হোসাইন (২০) – মহেশখালীর মাতারবাড়ী থেকে উঠে আসা তরুণ। বয়স কম হলেও অতিমাত্রায় সক্রিয়, চেতনার দোহাই দিয়ে গোপনে প্রচার চালাতেন। মোঃ জিয়াউদ্দিন হাসান (২১) – আনোয়ারার সন্তান, বর্তমানে বায়েজিদ এলাকায় বসবাস। নতুন প্রজন্মের ‘মৌলিক বিপ্লবের’ নামে ছদ্মবেশে গোপন যোগাযোগ রাখতেন।
মোঃ আতিক জাওয়াদ (২০) – পেকুয়ার তরুণ, আলামিন বাড়ীয়া কামিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। প্রযুক্তিনির্ভর একটি চক্রের ‘যোগাযোগ রক্ষাকারী’ হিসেবে পরিচিত।
মোঃ এহছান উদ্দিন (২১) – বাঁশখালীর প্রেমাশিয়ার সন্তান, বর্তমানে বহদ্দারহাট বাদুরতলা জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন। ধর্মীয় পরিচয়ের ছায়ায় গোপন বৈঠকের আয়োজন করতেন বলে অভিযোগ।
পুলিশের ভাষ্যে অভিযানের তাৎপর্য:
চান্দগাঁও থানা পুলিশ জানায়, দেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্টের উদ্দেশ্যে দীর্ঘদিন ধরে নাশকতার পরিকল্পনা করে আসছিল একটি চক্র। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উগ্রবাদী মতাদর্শ ছড়ানো, লোকচক্ষুর আড়ালে গোপন সভা-সমাবেশ এবং শহরের বিভিন্ন এলাকায় অস্থিরতা সৃষ্টি করার মতো পরিকল্পনার সঙ্গে এরা যুক্ত ছিল। ওসি মোঃ আফতাব উদ্দিন বলেন, “আমরা কঠোর নজরদারি রেখেছিলাম বহুদিন ধরেই। নির্ভুল তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের পরই অভিযান চালানো হয়। রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।”
জনগণের প্রতিক্রিয়া:
অভিযানের খবর ছড়িয়ে পড়তেই এলাকার সাধারণ মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরে আসে। নাগরিকদের মতে, পুলিশ সঠিক সময়েই পদক্ষেপ নিয়েছে। অনেকে মনে করছেন, এই ধরনের তৎপরতায় শহরের ভেতরে লুকিয়ে থাকা ষড়যন্ত্রীদের ঘুম হারাম হবে।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার কার্যালয় থেকেও এই সফল অভিযানের জন্য সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের অভিনন্দন জানানো হয়েছে।
শেষ কথা:
একটি শান্ত নগরের বুকে যেকোনো অশান্তির বীজ রোপণের চেষ্টা যে সফল হবে না, চান্দগাঁও থানার এই অভিযানে তা আবারও প্রমাণিত হলো। যে হাত আগুন নিয়ে খেলতে আসে, সেই হাতেই আগুন ধরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অব্যাহত রাখবে—এমনটাই প্রত্যাশা শহরবাসীর।