চট্টগ্রাম, ১৭ মার্চ ২০২৫: চট্টগ্রাম মহানগরের অন্যতম ব্যস্ত বাণিজ্যিক এলাকা মহল শপিং কমপ্লেক্স-এ দীর্ঘদিন ধরে দোকান ভাড়া নিয়ে জটিলতা চলছিল। অবশেষে কোতোয়ালি থানার ওসি (অপারেশন) রুবেল এর নেতৃত্বে পরিচালিত তদন্তে ভাড়াটিয়া আহম্মদ উল্লাহ আল মামুনের প্রতারণা ও জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। থানার তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ওসি আব্দুল করিম মামুনের বিরুদ্ধে প্রতারণা ও জালিয়াতির মামলা দায়েরের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কীভাবে শুরু হয়েছিল প্রতারণা?- মহল মার্কেটের প্রথম ফ্লোরের এ/১২ নং দোকান এর বৈধ মালিক মোঃ ইউসুফ মজুমদার। তিনি অভিযোগ করেছেন যে, ভাড়াটিয়া আহম্মদ উল্লাহ আল মামুন মৌখিক চুক্তির ভিত্তিতে সাময়িক সময়ের জন্য দোকানের অর্ধেক অংশ ভাড়া নেন। চুক্তির মেয়াদ শেষ হয় ৩১ ডিসেম্বর ২০২১, কিন্তু মামুন এরপরও দোকান ছাড়েননি, বরং দীর্ঘদিন ধরে ভাড়া পরিশোধ না করেই দোকানটি দখলে রেখেছেন। ইউসুফ মজুমদারের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মামুনের বকেয়া ভাড়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪,৩৬,৫০০/- টাকা। তিনি দফায় দফায় ৩০,০০০/- টাকা, ৭৫,০০০/- টাকা এবং ২০২৩ সালে সর্বশেষ ৫০,০০০/- টাকা পরিশোধ করেন। ফলে এখনো ২,৮১,৫০০/- টাকা বকেয়া রয়েছে।
তবে মামুন শুধু ভাড়া পরিশোধে অনাগ্রহী ছিলেন না, বরং তিনি দোকানটি নিজের বলে দাবি করতে থাকেন এবং অন্যদের কাছে উপ-ভাড়ায় দিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেন। আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে দোকান দখলের চেষ্টা- অভিযোগ রয়েছে, মামুন আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে দোকানটি নিজের দখলে রাখতে চান। ইউসুফ মজুমদার অভিযোগ করেছেন, যেহেতু তিনি কুমিল্লার বাসিন্দা, তাই এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মামুন স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে দোকানটি দখলে রাখেন। ইউসুফ মজুমদার এই বিষয়টি ১৮ অক্টোবর ২০২২ তারিখে মহল শপিং কমপ্লেক্স ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির কাছে অভিযোগ করেন। তবে সমিতির সদস্য সচিব মোহাম্মদ বরিউল আলী, যিনি একজন প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা, উল্টো মামুনের পক্ষ নিয়ে ইউসুফ মজুমদারকে হুমকি দেন।
বরিউল আলী তখন বলেছিলেন, “তোমার এখানে কোনো দোকান নেই। যদি মালিকানা দাবি করতে আসো, তাহলে তোমাকে উচিত শিক্ষা দেওয়া হবে।”
এরপর ৭ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে ইউসুফ মজুমদার পুনরায় মহল শপিং কমপ্লেক্স ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির আহ্বায়কের কাছে অভিযোগ করেন। তখন সমিতির পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয় যে, পরবর্তী মাসের ১০ তারিখে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হবে।
গুপ্ত হামলা, আটকে রেখে প্রাণনাশের হুমকি-
কিন্তু ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে সমাধানের বদলে একটি ভয়াবহ ঘটনা ঘটে। অভিযোগ রয়েছে, মামুন ও তার সহযোগীরা বিকেল আনুমানিক ৫টার সময় ইউসুফ মজুমদারকে দোকান বুঝিয়ে দেওয়ার কথা বলে পুরাতন গীর্জার একটি গুদাম ঘরে ডেকে নিয়ে আটকে রাখেন। সেখানে তাকে হত্যার হুমকি দিয়ে জোরপূর্বক দোকানের মালিকানা ত্যাগের স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
ৃইউসুফ মজুমদার প্রাণরক্ষার জন্য কৌশলে রাজি হওয়ার ভান করে সেখান থেকে পালিয়ে আসেন এবং কোতোয়ালি থানায় অভিযোগ করেন।
কোতোয়ালি থানার তদন্ত ও মামলা দায়ের- ইউসুফ মজুমদারের অভিযোগ পাওয়ার পর কোতোয়ালি থানার ওসি (অপারেশন) রুবেল নিরপেক্ষ তদন্ত পরিচালনা করেন। তদন্তে ভাড়াটিয়া মামুনের বিরুদ্ধে প্রতারণা ও জালিয়াতির অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায়।
এই তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কোতোয়ালি থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আব্দুল করিম মামুনের বিরুদ্ধে প্রতারণা ও জালিয়াতির মামলা দায়েরের সিদ্ধান্ত দেন।
ভুক্তভোগী ইউসুফ মজুমদারের বক্তব্য- ইউসুফ মজুমদার বলেন, “আমি দোকানের বৈধ মালিক হওয়া সত্ত্বেও মামুন রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে আমার দোকান দখলে রেখেছে। আমার পাওনা ভাড়া পরিশোধ না করে বরং আমাকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছে। আমি ন্যায়বিচার চাই। থানার তদন্তে আমার অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হয়েছে, এখন আমি দোকান ফেরত পেতে চাই।”
ওসির বক্তব্য-
কোতোয়ালি থানার ওসি আব্দুল করিম বলেন, “তদন্তে দেখা গেছে, মামুন প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে দোকানের মালিকানা দাবি করে মালিককে প্রতারিত করেছেন। তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এবং প্রকৃত মালিককে তার অধিকার নিশ্চিত করা হবে।”
উচ্চমহলের দৃষ্টি আকর্ষণ
এই ঘটনার পর চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী মহলে আলোচনা শুরু হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কেউ যদি দোকান দখল করতে পারে, তাহলে সাধারণ ব্যবসায়ীরা কতটা নিরাপদ?
এখন মামুনের বিরুদ্ধে নেওয়া আইনানুগ ব্যবস্থা ভবিষ্যতে অন্যদের জন্য সতর্কবার্তা হয়ে উঠবে কিনা, তা সময়ই বলে দেবে। তবে কোতোয়ালি থানার দ্রুত পদক্ষেপ অনেকেরই প্রশংসা কুড়িয়েছে।
চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক এলাকায় প্রভাব খাটিয়ে দোকান দখল, প্রতারণা ও জালিয়াতির ঘটনা নতুন নয়। কিন্তু এবার কোতোয়ালি থানার কার্যকর তদন্তের মাধ্যমে প্রতারকচক্র ধরা পড়েছে। এখন দেখার বিষয়, আইনি প্রক্রিয়ায় প্রকৃত মালিক তার ন্যায়বিচার পান কিনা।