জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক জীবন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যদিও তাকে নিয়ে কিছু মানুষ অহেতুক ভাবে বিভিন্ন বিতর্ক করেছে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গে, তবে ইতিহাসের নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং তাকে “জাতির পিতা” হিসেবে স্বীকৃতি দিতে আন্তরিক প্রয়াস চালিয়েছিলেন।
১৯৭৯ সালে, জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। সেসময় জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আনুষ্ঠানিকভাবে “জাতির পিতা” হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য প্রস্তাব আনার বিষয়ে তার মনোভাব ছিল ইতিবাচক। তবে, তার সরকারে প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান এবং স্পিকার মির্জা গোলাম হাফিজ এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। ইতিহাসবিদদের মতে, জিয়াউর রহমানের মনের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সরকারের উচ্চপর্যায়ের কিছু ব্যক্তি রাজনৈতিক সুবিধার কারণে এই প্রস্তাব সংসদে উত্থাপন করতে বাধা দেন।
জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড নিয়ে স্পষ্ট কোনো অবস্থান না নেওয়া এবং কিছু বিতর্কিত ব্যক্তিদের আশ্রয় দেওয়ার কারণে তার প্রতি বিভিন্ন সময় প্রশ্ন তোলা হয়েছে। তবে জিয়াউর রহমান কখনোই বঙ্গবন্ধুর হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বরং তার রাজনৈতিক ও সামরিক জীবনে বঙ্গবন্ধুর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও দায়িত্বশীলতার নজির পাওয়া যায়।
জিয়াউর রহমান তার শাসনামলে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে অস্বীকার করেননি। বরং তিনি চেয়েছিলেন, জাতির পিতার মর্যাদা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হোক। তবে তার সরকারের কিছু সদস্য ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করে। এ ঘটনার ফলে জিয়াউর রহমানের প্রতি জনগণের বিভক্ত দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে।
বঙ্গবন্ধুকে “জাতির পিতা” হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু একটি ব্যক্তি বা দলকে সম্মান জানানো নয়; বরং মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনা সংরক্ষণ করার একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। জিয়াউর রহমানের এই প্রস্তাব আনার ইচ্ছা প্রমাণ করে যে, তার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধার অভাব ছিল না। তবে রাজনৈতিক বাধা ও অভ্যন্তরীণ বিভাজন এই ঐতিহাসিক পদক্ষেপকে বাস্তবায়িত হতে দেয়নি। এটি ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে গভীর বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে মর্মান্তিক ও গভীর ক্ষত। এই হত্যাকাণ্ড ঘিরে বহু বিতর্ক, বিভ্রান্তি ও রাজনৈতিক স্বার্থজড়িত সিদ্ধান্তসমূহ ইতিহাসের স্পষ্ট সত্যকে অনেক ক্ষেত্রে আড়াল করেছে। তবে নিরপেক্ষ তথ্য ও ইতিহাসের পর্যালোচনায় বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত দিকগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার পর খন্দকার মোশতাক আহমেদ একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের হাত থেকে রক্ষা করতে মোশতাক সরকারই তথাকথিত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ প্রণয়ন করে, যা আইনি সুরক্ষা দিয়ে হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনা নিষিদ্ধ করে। এ সময় জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন না। তিনি তখন সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। খন্দকার মোশতাকের সময়ে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা বিদেশে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পদে নিয়োগ পান। এটি মোশতাক সরকারের সিদ্ধান্ত ছিল, যা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত।
জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন। তার শাসনামলে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা দেশে ফিরে আসেনি। যদিও জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে বিভিন্ন বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।তবে- তিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের পুনর্বাসন বা রাজনৈতিক প্রশ্রয় দেওয়ার কোনো ঐতিহাসিক দলিল নেই। এর বিপরীতে, ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান নিহত হন এবং এরশাদ সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন। এরশাদের শাসনামলে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ফারুক ও রশিদকে দেশে ফেরানো হয় এবং তাদের মাধ্যমে ফ্রিডম পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করা হয়। এই দলটি জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়। এরশাদের এই পদক্ষেপ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের রাজনৈতিক শক্তি অর্জনের সুযোগ করে দেয়। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের লালদিঘি মাঠে এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়, যার ফলে বহু মানুষ প্রাণ হারায়। এই ঘটনাটি এরশাদ সরকারের দমননীতির একটি জঘন্য উদাহরণ। ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার এরশাদের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতায় যায়। এরশাদকে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া এবং রাষ্ট্রীয় সুবিধা প্রদান শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কৌশলের অংশ ছিল। তবে এই সমঝোতা বঙ্গবন্ধুর প্রতি এরশাদের শাসনামলের ভূমিকা এবং তার বিতর্কিত কাজগুলোর বিরোধিতা করা জনগণের অনুভূতিকে আহত করেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল মূলত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের কারণে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করা হয় এবং হত্যাকারীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের সরাসরি সম্পৃক্ততার কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। বরং হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা ও বিচারের বাধা মোশতাক সরকারের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় হয়েছে। হত্যাকারীদের বিদেশে পাঠানো, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ প্রণয়ন এবং বিচার প্রক্রিয়া থামানো সবই মোশতাকের ক্ষমতার সময়ের ঘটনা। এরশাদ সরকারের সময় হত্যাকারীদের রাজনৈতিক পুনর্বাসন এবং ফ্রিডম পার্টির গঠন ইতিহাসের আরেকটি কলঙ্কিত অধ্যায়। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের পুনর্বাসন ও স্বীকৃতি দেওয়া রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতার উদাহরণ।
সত্য ইতিহাস ও দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতির জনকের প্রতি সম্মান জানাবঙ্গবন্ধু ও জিয়াউর রহমানের সম্পর্ক: একটি ঐতিহাসিক পর্যালোচনা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জিয়াউর রহমানের সম্পর্ক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বঙ্গবন্ধু জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীতে উচ্চপদে নিয়োগ দিয়েছিলেন এবং তার দক্ষতা ও সততার প্রতি আস্থা রেখেছিলেন। তবে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সময় জিয়া সেনাবাহিনীর উপপ্রধান হিসেবে ছিলেন, যা তাকে বিতর্কের কেন্দ্রে নিয়ে আসে। এ সম্পর্ক, বিশ্বাসঘাতকতা এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়। জিয়াউর রহমান কেন সেনাবাহিনীর উপপ্রধান হলেন? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন। এর অংশ হিসেবে তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন প্রমাণিত সাহসী ও যোগ্য সেনা কর্মকর্তাদের সেনাবাহিনীর শীর্ষ পদে বসানোর সিদ্ধান্ত নেন।
জিয়াউর রহমানের যোগ্যতা এবং বঙ্গবন্ধুর আস্থা-জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান কমান্ডার ছিলেন। তিনি ৭১ সালে চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন এবং যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু তার এই অবদানের জন্য জিয়াকে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন। বঙ্গবন্ধু জিয়াউর রহমানের সামরিক দক্ষতা এবং শৃঙ্খলার জন্য তাকে পছন্দ করতেন। তিনি জিয়াকে স্বাধীনতার আদর্শের প্রতি অনুগত একজন সাহসী সেনা কর্মকর্তা হিসেবে দেখতেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড এবং সেনাবাহিনীর ভূমিকা- ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্য নির্মমভাবে নিহত হন। এই হত্যাকাণ্ডের সময় সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ। জেনারেল শফিউল্লাহর ভূমিকা- জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর এবং স্বাধীনতার পর সেনাবাহিনীর প্রথম প্রধান ছিলেন। ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সময় তার ভূমিকা বিতর্কিত হয়ে ওঠে। হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। কেন শফিউল্লাহ বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে পারেননি? ১. সেনাবাহিনীর ভেতরে কিছু সদস্য হত্যার পরিকল্পনায় সক্রিয় ছিলেন। ২. শফিউল্লাহ রাজনৈতিক এবং সামরিক দিক থেকে যথেষ্ট শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হন। ৩. সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে একটি বড় অংশ শফিউল্লাহর নির্দেশ উপেক্ষা করেছিল। শেখ হাসিনা সরকারের সময় কে এম শফিউল্লাহর মন্ত্রী হওয়া- ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে কে এম শফিউল্লাহকে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এটি একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখা হয়, কারণ ১৯৭৫ সালের হত্যাকাণ্ডের সময় তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। শেখ হাসিনার যুক্তি- শেখ হাসিনা হয়তো তাকে স্বাধীনতার সময় তার অবদানের জন্য এবং তার প্রতি আস্থা রেখে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তবে এটি আওয়ামী লীগের অনেক সমর্থক ও ইতিহাসবিদদের মধ্যে সমালোচনার সৃষ্টি করে। বঙ্গবন্ধু ও জিয়াউর রহমানের সম্পর্কের শেষ অধ্যায়- বঙ্গবন্ধু জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান করার মাধ্যমে তার প্রতি আস্থা প্রকাশ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়ে তার প্রতি আস্থা রেখেছিলেন। তবে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সময় সেনাবাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা এবং পরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো ইতিহাসের জটিলতা বাড়িয়েছে। জেনারেল কে এম শফিউল্লাহর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ থাকলেও, শেখ হাসিনা সরকার তাকে মন্ত্রী করেছিলেন। জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ছিলেন বলে ঐতিহাসিক কোনো প্রমাণ নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জিয়াউর রহমানের ভূমিকা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং পরবর্তী সময়ে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। এ লেখায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জন, জিয়াউর রহমানের ভূমিকা, এবং জাসদের কর্মকাণ্ডের প্রভাব নিয়ে তথ্য-উপাত্তভিত্তিক আলোচনা করা হলো। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা এবং জিয়াউর রহমানের ভূমিকা-
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই ঘোষণার পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হামলা শুরু হয়। জিয়াউর রহমানের ভূমিকা-
২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। বেতার বার্তায় তিনি বলেন, “আমি মেজর জিয়া, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিচ্ছি।” এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত, যা মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছিল। স্বাধীনতার ঘোষক বিতর্ক-
জিয়াউর রহমান কখনো নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে দাবি করেননি। বরং তিনি বরাবরই বঙ্গবন্ধুকে দেশের স্বাধীনতার মূল নেতা এবং জাতির পিতা হিসেবে সম্মান করেছেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে পারতাম না।” তার কথায় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা ও ভারতীয় সৈন্যদের সমর্থনের গুরুত্ব ছিল স্পষ্ট। মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের অবদান-
জিয়াউর রহমান ছিলেন ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সফল সামরিক নেতা। তিনি সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে থেকে মুক্তিবাহিনীকে নেতৃত্ব দেন এবং গুরুত্বপূর্ণ সামরিক বিজয় অর্জন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার সাহসিকতা এবং কৌশল তাকে একজন দক্ষ সামরিক নেতা হিসেবে পরিচিত করে তোলে।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিবেশ এবং জাসদের ভূমিকা-স্বাধীনতার পর দেশ পুনর্গঠনের সময় বঙ্গবন্ধুকে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এর মধ্যে একটি ছিল জাসদের কর্মকাণ্ড।
জাসদ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা জাসদ (জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল) গঠন করেন আ স ম আবদুর রব এবং মেজর জলিল। জাসদ তখনকার যুব সমাজ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় অংশকে প্রভাবিত করেছিল। তারা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের বিভিন্ন নীতি এবং কার্যক্রমের বিরোধিতা করত।
জাসদের বিরোধিতা এবং বঙ্গবন্ধুর শাসনে প্রভাব-জাসদের কর্মসূচি এবং সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সংঘাতের সৃষ্টি করেছিল। অনেকের মতে, জাসদের কর্মকাণ্ড বঙ্গবন্ধুর শাসন পরিচালনায় অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় এবং একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনে পরোক্ষভাবে জাসদের কর্মকাণ্ড একটি ভূমিকা পালন করেছিল বলে অনেকে মনে করেন। জাসদের নেতা এবং শেখ হাসিনার সরকার- পরবর্তী সময়ে জাসদের অনেক নেতাকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়।
আ স ম আবদুর রব এবং হাসানুল হক ইনু শেখ হাসিনার আমলে মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মঈন উদ্দিন খান বাদলসহ জাসদের অনেক নেতা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সমালোচনা-
জাসদের নেতাদের আওয়ামী লীগের মন্ত্রী এবং এমপি হিসেবে জায়গা দেওয়া নিয়ে অনেক সমালোচনা রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, যারা বঙ্গবন্ধুর শাসনকে অস্থিতিশীল করেছিল, তাদের শেখ হাসিনা সরকারের অংশীদার করা ইতিহাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জিয়াউর রহমান উভয়েই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বঙ্গবন্ধু দেশের
স্বাধীনতার জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধে সামরিক নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং যুদ্ধের ময়দানে সরাসরি লড়াই করেছেন। জাসদের কর্মকাণ্ড মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। পরবর্তী সময়ে তাদের নেতৃত্ব শেখ হাসিনার সরকারে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আসায় সমালোচনা উঠেছে। তথ্যভিত্তিক এই ইতিহাস পর্যালোচনা আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং এর পরবর্তী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের জটিলতাগুলো বুঝতে সাহায্য করে। বঙ্গবন্ধু হত্যা, জাসদের ভূমিকা, এবং রাজনৈতিক পটভূমি: তথ্যভিত্তিক আলোচনা- বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার ঘটনা একটি কালো অধ্যায়। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে কারা দায়ী এবং এর রাজনৈতিক পটভূমি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক রয়েছে। এ লেখায় বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রেক্ষাপট, জাসদের ভূমিকা, এবং জিয়াউর রহমানের অবস্থান নিয়ে তথ্যভিত্তিক আলোচনা করা হলো।
বঙ্গবন্ধুর শাসনকাল এবং জাসদের উদ্ভব- স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে মনোনিবেশ করেন। কিন্তু তখন তিনি বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। জাসদের গঠন এবং কার্যক্রম- ১৯৭২ সালে আ স ম আবদুর রব এবং মেজর জলিলের নেতৃত্বে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠিত হয়। জাসদ নিজেকে “বিপ্লবী দল” হিসেবে পরিচিত করে এবং সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ডাক দেয়। জাসদের অধীনস্থ “গণবাহিনী” সারা দেশে সশস্ত্র আন্দোলন পরিচালনা করে, যা আইনশৃঙ্খলার গুরুতর অবনতি ঘটায়। গণবাহিনীর কর্মকাণ্ডের ফলে দেশে ব্যাপক সহিংসতা, খুন, লুটপাট এবং ধ্বংসযজ্ঞ চলতে থাকে।
জাসদের প্রভাব- জাসদের নেতৃত্বাধীন সহিংস কর্মকাণ্ড বঙ্গবন্ধু সরকারের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। তারা বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সশস্ত্র কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে এবং একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করে। বঙ্গবন্ধুর কঠোর সিদ্ধান্ত-
জাসদের সহিংসতা এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতি বঙ্গবন্ধুকে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে তিনি সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেন এবং রাষ্ট্রের ক্ষমতা নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করেন। তিনি বাকশাল (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ) গঠন করেন, যা একটি একদলীয় শাসনব্যবস্থা। এই সিদ্ধান্ত তার জনপ্রিয়তাকে কমিয়ে দেয় এবং বিরোধীদের ক্ষোভ আরও বাড়ায়।
১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট- জাসদের ভূমিকা- অনেক গবেষক মনে করেন, জাসদের সহিংস কার্যক্রম বঙ্গবন্ধুর শাসনকে অস্থিতিশীল করে তুলেছিল। জাসদের কর্মকাণ্ড এবং সরকারের সঙ্গে তাদের বিরোধ একটি অস্থির পরিবেশ তৈরি করে, যা বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনে পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখে। খন্দকার মোশতাকের ভূমিকা- বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন তার মন্ত্রিসভার সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমেদ। মোশতাক বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে মদদ দেন এবং হত্যাকাণ্ডের পর নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে খন্দকার মোশতাক হত্যাকারীদের বিচারের হাত থেকে রক্ষা করেন। জিয়াউর রহমানের অবস্থান জিয়াউর রহমান তখন উপ-সেনাপ্রধান -বঙ্গবন্ধু হত্যার সময় জিয়াউর রহমান ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপপ্রধান। তিনি সরাসরি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য জিয়াউর রহমান দায়ী নয়- বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড একটি দীর্ঘ পরিকল্পনার ফল, যা জিয়াউর রহমানের পদমর্যাদা বা ক্ষমতার বাইরের ঘটনা। খন্দকার মোশতাক এবং তার সহযোগীরাই মূল ষড়যন্ত্রকারীদের নেতৃত্বে ছিলেন। অনেক গবেষকের মতে, জাসদের কর্মকাণ্ড এবং খন্দকার মোশতাকের ষড়যন্ত্র বঙ্গবন্ধু হত্যার পথ প্রশস্ত করেছিল।
জাসদ ও খন্দকার মোশতাককে দায়ী করার কারণ- জাসদের সশস্ত্র সংগ্রাম বঙ্গবন্ধুর সরকারের বিরুদ্ধে।
–লেখাটিঃ দৈনিক ভোরের আওয়াজ পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে।