সকালটা আজও ভোরের নরম কুয়াশায় জড়িয়ে ছিল। বৃষ্টি থেমেছে, কিন্তু মাটিতে রয়ে গেছে গতরাতের অশ্রু। চট্টগ্রামের বাতাসে সেই চেনা সোঁদা গন্ধ, যেন শূন্যতার নিজস্ব এক ভাষা হয়ে বয়ে চলেছে। আমি হাঁটতে বের হলাম, প্রতিদিনের মতো। এই হাঁটা শুধু শরীরচর্চা নয়, প্রতিটি পদক্ষেপ যেন সময়ের সঙ্গে একধরনের বোঝাপড়া। আজ পথে বের হয়ে মনে হল, শূন্যতাও যেন একটি চরিত্র—অতৃপ্ত, অমীমাংসিত। সকালবেলার রাস্তাগুলোয় মানুষের ব্যস্ততা শুরু হয়নি। আমি যে পথে হেঁটে চলি, সেই পথগুলোও আজ যেন নিঃশব্দে হাঁটছে আমার সঙ্গে। রাস্তায় কিছু গুটিকয়েক পাখি, বাতাসে ওদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ। দোকানের ঝাঁপ এখনও অর্ধেক নামানো। এক কোণে এক বৃদ্ধ বসে আছেন—চোখে শূন্য দৃষ্টি। আমিও তাঁর পাশে কিছু সময় দাঁড়ালাম, কিন্তু কথা হলো না। আমাদের শূন্যতা হয়তো আলাদা, কিন্তু বোঝাপড়াটা এক।
কাঁদবেন কিন্তু কাঁদাবেন না।
এই কথাটি মনে পড়তেই বহু পুরনো এক স্মৃতি ফিরে এল। আমার ভাইয়ের মুখ মনে পড়ে গেল। জীবনের সবচেয়ে বড় শূন্যতা তার অনুপস্থিতি। কেঁদেছিলাম, কাঁদছি এখনো—কিন্তু সেই কান্না কাউকে দেখাইনি। কারণ, কান্না দেখানো মানেই শূন্যতা ভাগ করা, আর আমি জানি, সবাই সব শূন্যতা বইতে পারে না। ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে প্রথমবার সমুদ্র দেখতে গিয়েছিলাম। সেই বিশাল জলরাশি দেখে মনে হয়েছিল, পৃথিবীর সব শূন্যতা এই সমুদ্রে এসে মিশে আছে। বাবার হাত ছেড়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। আজ মনে হয়, তখন থেকেই শূন্যতার সঙ্গে আমার আলাপ। সমুদ্রের ঢেউ গুনেছি, গুনতে গুনতে বুঝেছি—প্রতিটি ঢেউ এসে ভাঙে, মিলিয়ে যায়, কিন্তু কিছু রেখে যায় বালিতে। আমাদের জীবনেও শূন্যতার ঢেউ আসে, নিয়ে যায় প্রিয়জনদের, স্বপ্নদের। কিন্তু কিছু না কিছু রেখে যায়—স্মৃতি। ঠকবেন কিন্তু ঠকাবেন না।
শহরের প্রতিটি মোড়, প্রতিটি প্রান্তে ঠকে গেছি বহুবার। তবে সেই অভিজ্ঞতা আমাকে ঠকানোর সাহস দেয়নি কখনো। শূন্যতা আমাকে শিখিয়েছে, মানুষ ঠকে গড়ে ওঠে, ঠকিয়ে নয়। সাংবাদিকতার দীর্ঘপথে বহুবার সত্য লিখতে গিয়ে নানান বাধা এসেছে। কেউ কেউ প্রতিশোধ নিতে চেয়েছে, কেউবা ধমক দিয়েছে। ঠকে গেছি, কিন্তু কলম থামাইনি। কারণ, শূন্যতা আমাকে শিখিয়েছে, অন্যকে ঠকানোর চেষ্টা করলে শূন্যতাও প্রতিশোধ নেয়—নিজেকে শূন্য করে দেয়।
ভালোবাসবেন কিন্তু দেখাবেন না।
ভালোবাসা সবসময় প্রকাশ পায় না। আমি আমার শহরটাকে ভালোবাসি, চট্টগ্রামকে। এর প্রতিটি ইট, প্রতিটি গলির প্রতি গভীর টান আছে। কিন্তু সেই ভালোবাসা শব্দে মেলে না। শূন্যতা ভালোবাসার একটা আড়াল, যা শুধু অনুভব করা যায়, দেখানো যায় না। একবার বিদেশে থাকার সময়, চট্টগ্রামের বৃষ্টি মিস করেছিলাম। রাস্তার ধারে ফুটপাতে বসে থাকা চায়ের দোকান, রিকশার টুংটাং শব্দ, পুরোনো বইয়ের দোকান—সব যেন ডেকে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিল। দূর থেকেই ভালোবাসতে শিখেছিলাম শহরটাকে। ভালোবাসা দূর থেকেই সবচেয়ে স্পষ্ট হয়, কাছে গেলে তার রূপ ম্লান হয়ে যায়। আজকের হাঁটাহাঁটির পথে এই সব চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল। পথে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো যেন শূন্যতার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টিতে তাদের পাতাগুলোও যেন অশ্রুসিক্ত। আমি যখন চলে যাই, তারা থেকে যায়। আমি ভাবতে থাকি, আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই শূন্যতা আছে। কেউ কাছের মানুষ হারিয়ে, কেউ স্বপ্নের মৃত্যু দেখে, আবার কেউবা জীবনের নিরবধি একাকীত্বে। শূন্যতা গল্প বোনে, প্রতিদিন। আমার হাঁটার পথে একটি পুরনো মসজিদের পাশ দিয়ে যাই। ফজরের আযান শুনে থমকে দাঁড়াই কিছুক্ষণ। মনে হয়, শূন্যতার মধ্যেও কিছু আছে যা সবসময় ফিরে আসতে চায়। আযানের শব্দ সেই ফাঁকা জায়গা ভরিয়ে দেয়, মনে করিয়ে দেয়—শূন্যতাও কখনো কখনো পূর্ণতা আনে। একদিন হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম, শূন্যতা শুধু বেদনা নয়, এটা আমাদের গড়েও। যা নেই, তাই দিয়ে আমরা যা আছি তাকে মূল্য দিই। হাঁটতে হাঁটতে বুঝি, জীবন মানেই শূন্যতার সঙ্গে সহবাস। রাতের শহর আর সকালের শহরের মধ্যে অনেক তফাৎ। সকালের শহরটা অনেকটা ফাঁকা, কিন্তু সন্ধ্যার শহরটা ব্যস্ত। মানুষজনের চিৎকার, হর্নের শব্দ—সব মিলিয়ে একধরনের পূর্ণতা। কিন্তু এই পূর্ণতার মাঝেও আমি সেই শূন্যতা খুঁজি। অল্প শব্দে লিখলে শূন্যতার গল্প শেষ হয় না। এই গল্প চলতে থাকে, যেমন করে আমি হাঁটি প্রতিদিন—নিঃশব্দে, একা। শূন্যতার জলছবিতে নিজেকে খুঁজে পাই আবার হারিয়ে ফেলি, প্রতিবার নতুন করে। একদিন হয়তো এই শূন্যতা আমাকেও কোথাও নিয়ে যাবে, যেখানে শব্দ থেমে যাবে, স্মৃতি মিলিয়ে যাবে। কিন্তু ততদিন, আমি এই পথ ধরে হাঁটব, শূন্যতার সঙ্গী হয়ে।শূন্যতা যখন পূর্ণতা পায় বাতাসে শীতের আমেজ। সকালের কুয়াশা এখনো পুরোপুরি কাটেনি। আমি বাটালি হিলের পথে হাঁটছি। চারপাশ নিস্তব্ধ, শুধু পায়ের নিচে পাতা ভাঙার শব্দ। এই নীরবতা আমার সঙ্গী বহুদিন ধরে। শূন্যতা যেন এমন এক বন্ধু, যে কখনো দূরে যায় না। কিন্তু আজ যেন সেই শূন্যতা একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। কারণ আমি জানি, এই পথচলায় আমি একা নই। অনেক প্রিয় মানুষ আছেন, যারা আমার লেখা পড়ে, আমার শব্দের ভেতর দিয়ে আমাকে ভালোবাসেন। তাদের প্রশংসার শব্দগুলো কানে বাজে, মনে হয় তারা আমার পাশেই হাঁটছেন। “আপনার লেখাটা দারুণ হয়েছে! আরও লিখবেন।” এই কথাগুলো যখন শুনি, শূন্যতার দেয়াল যেন একটু একটু করে গলে যায়। শরীরচর্চার ফাঁকে বাটালি হিলের বন্ধুরা যখন আমার লেখা নিয়ে আলোচনা করেন, তখন মনে হয়—আমি একা নই, আমার কলমের পাশে অনেকেই দাঁড়িয়ে আছেন। একদিন সকালে, শরীরচর্চা শেষে এক বন্ধু বললেন, “আপনার লেখাগুলো আমি নিয়মিত পড়ি। আপনি আমাদের শহরের কথা বলেন, আমাদের জীবনের গল্প বলেন। আপনার লেখায় আমাদের শূন্যতাগুলো যেন পূর্ণ হয়ে ওঠে।”
এই কথায় আমি থমকে দাঁড়াই। আমি কি সত্যিই অন্যের শূন্যতা ভরিয়ে তুলতে পারি? আমি কি শব্দের ভেতর দিয়ে এমন কিছু তৈরি করেছি, যা আরেকজনের অন্তর ছুঁয়ে যেতে পারে? প্রতিদিন যখন কলম ধরি, তখন শূন্যতা আমাকে গ্রাস করতে চায়। মনে হয়, চারপাশ ফাঁকা, শব্দগুলো অর্থহীন। কিন্তু সেই মুহূর্তে, আমি মনে করি—আমার প্রতিটি লেখা সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে এক উপহার। তিনি আমায় দিয়েছেন এই কলম, এই ভাষা। আমার সব শূন্যতার মধ্যে তিনিই সেই পূর্ণতা, যা আমাকে পথ দেখায়। এক বিকেলে বাটালি হিলের ওপর দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখছিলাম। আকাশের রঙ বদলে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। তখন মনে হলো, সূর্য ডুবলেও আলো একেবারে হারিয়ে যায় না। ঠিক তেমনই, শূন্যতা থাকলেও আশেপাশের ভালোবাসা আর প্রশংসা সেই শূন্যতা ঢেকে দেয়।
আমার লেখার সবচেয়ে বড় পাঠক আমার সৃষ্টিকর্তা। তিনি জানেন, আমি কোন শব্দে কাঁদি, কোন বাক্যে হাসি। যখন আমি লিখতে বসি, মনে হয় তিনি আমার কাঁধের ওপর হাত রেখে বলছেন, “তুমি লিখে যাও, আমি তোমার পাশে আছি।” এভাবে প্রতিটি শব্দের ভেতর দিয়ে আমি শূন্যতা জয় করি। আমার পাঠকরা, আমার বন্ধুরা, এবং সৃষ্টিকর্তা—তিনটি শক্তি আমার কলমের কালি হয়ে বয়ে চলে। শূন্যতা কি তবে কখনো পুরোপুরি মুছে যায়? হয়তো না। কিন্তু ভালোবাসা আর প্রশংসার আলো সেই শূন্যতাকে সহনীয় করে তোলে। তাই আমি লিখে যাই, যতদিন পারি। কারণ জানি, কোথাও কেউ আমার লেখা পড়ে, আর সেই পাঠকই আমার শূন্যতার মাঝে এক টুকরো পূর্ণতা।