চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী থানায় এক ব্যবসায়ী অপহরণের ঘটনায় পুলিশ মাত্র ১২ ঘণ্টার মধ্যে অপহৃতকে উদ্ধার করে এবং মূল পরিকল্পনাকারীসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করেছে। ঘটনাটি শহরজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করলেও পুলিশের দ্রুত পদক্ষেপ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। জানা যায়, গ্রেফতারকৃত অপহরণকারীরা বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারী একটি গ্রুপের সদস্য। অপহরণকারীদের মুক্তিপণ দাবি এবং ভিকটিমের উপর নির্যাতনের বিষয়টি এই অপারেশনকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। সাবেক চেয়ারম্যান ব্যবসায়ী হারুনকে অপহরণের ১২ ঘন্টার মধ্যেই মূল পরিকল্পনাকারীসহ ০৬ অপহরণকারীকে গ্রেফতার ও অপহৃত চেয়ারম্যান হারুনকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে বায়েজিদ বোস্তামী থানা পুলিশ।
ঘটনার বিবরণঃ
মোঃ হারুন রশিদ (৫৩) নামের এক ব্যবসায়ীকে নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী এলাকা থেকে অপহরণের বারো ঘন্টার মধ্যেই উদ্ধার করেছে বায়েজিদ বোস্তামী থানা পুলিশ। মূল পরিকল্পনা কারীসহ ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ঘটনায় ব্যবহৃত একটি জিপগাড়ি ও একটি মোটরসাইকেলও জব্দ করেছে পুলিশ। অপহৃত মোঃ হারুন রশিদ হলেন চট্টগ্রামের ভূজপুর থানার নারায়ণহাট ইউনিয়নের বাসিন্দা । গত ২৬/১১/২৪ খ্রি. রাত আনুমানিক ০৮.০০টার সময় হারুন রশিদ বায়েজিদ বোস্তামী থানাধীন মাইজপাড়া আনোয়ারুল আজিম পেট্রোল পাম্পের বিপরীতে এএইচবি থাই অ্যালুমিনিয়াম এসএস অ্যান্ড গ্লাস হাউজের আনুমানিক ২৫ গজ দক্ষিণে রাস্তার উপর তার পূর্ব-পরিচিত মতিউর রহমান লিয়াকত ও খুরশিদ আলমের সাথে কথা বলার সময় হাটহাজারী থেকে অক্সিজেনগামী একটি রূপালী রঙের প্রাইভেট কার তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। গাড়ি থেকে ৩ জন এবং আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকা আরো ৮/৯ জন ব্যক্তি হঠাৎ মোঃ হারুন রশিদকে কোনো কিছু বুঝে উঠার আগে উক্ত প্রাইভেট কারে জোরপূর্বক উঠিয়ে অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে অপহরণকারীরা হারুন রশীদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন থেকে তার স্ত্রীর মোবাইল ফোনে কল দিয়ে চার লক্ষ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। অপহরণের সংবাদ পেয়ে দ্রুততার সাথেই বায়েজিদ বোস্তামী থানার এসআই জসিম উদ্দিন এর নেতৃত্বে এসআই সঞ্জয় শর্মা, এসআই মোঃ নাছির উদ্দিন, এএসআই মোঃ মেজবাহ উদ্দিন ও এএসআই সৈয়দ আবুল হাশেমসহ একটি আভিযানিক দল ভিকটিমের স্ত্রী ও ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী এবং রাউজান থানা এলাকার বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করেন। এক পর্যায়ে গত ২৭/১১/২৪ খ্রি. রাত ০৩.৩০টার সময় গোপন সূত্রে প্রাপ্ত সংবাদ ও তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় হাটহাজারী থানাধীন হাটহাজারী মোড় বাস টার্মিনালসংলগ্ন দরবার হোটেলের সামনে রাস্তার উপর অভিযান পরিচালনা করে মুক্তিপণ বাবদ টাকা নিতে আসা ৬ জন আসামিকে আটক করেন। আসামিদের হেফাজত থেকে একটি Hunk মোটরসাইকেল এবং একটি জিপগাড়িসহ আটক করলেও অজ্ঞাতনামা আসামিরা ভিকটিমের মোবাইল নিয়ে পালিয়ে যায়। জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা জানায় ভিকটিমকে একটি রূপালী রঙের প্রাইভেট কার, আটককৃত জিপ ও মোটরসাইকেল যোগে অপহরণ করে চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানাধীন সুলতানপুর সিটিয়াপাড়া হারুন চেয়ারম্যানের বাড়ির নাছির উদ্দিনের ঘরে নিয়ে আসামি মঞ্জুর আলমকে
বুঝিয়ে দেয়। আসামিরা আটক হওয়ার পর ভিকটিমকে উক্ত স্থান থেকে অন্যত্র নিয়ে যায়। রাতের বেলায় বিভিন্ন পাহাড়ে জঙ্গলে নিয়ে পলাতকসহ অজ্ঞাতনামা আসামিরা মুক্তিপণের টাকার জন্য শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে। পুলিশ আটককৃত আসামিদেরকে নিয়ে তাদের দেখানোমতে নাসির উদ্দিনের বাড়িসহ চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানাধীন সম্ভাব্য সকল স্থানে ভিকটিমেকে উদ্ধারের জন্য অভিযান অব্যাহত রাখে। অভিযানের এক পর্যায়ে ২৭ নভেম্বর সকাল আনুমানিক ১০.৪৫টার সময় চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানাধীন হলুদিয়া ইউনিয়নের রহমানিয়া মাদ্রাসার পাশে ভিকটিম মোঃ হারুন রশিদকে উদ্ধার করে বায়েজিদ বোস্তামী থানা পুলিশ ।
গ্রেফতারকৃত আসামি ১) আল ফয়জুল আলম প্র. রবিউল (৩৫), ২) মোঃ সোহানুর রহমান (২৮), ৩) মোঃ সাদেকুল আলম (২৯), ৪) মোঃ লোকমান শরীফ (৩৫), ৫) মোঃ শফিকুল ইসলাম বাপ্পী (৩০) ও ৬) মোঃ আরমান প্রঃ মানিক (৪৪)-দেরকে বিজ্ঞ আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে। পলাতক আসামিদের গ্রেফতারের নিমিত্তে অভিযান অব্যাহত আছে। ৩ নং আসামি একজন যুব দলের নেতা, তার বিরুদ্ধে আরো তিনটি মামলা রয়েছে, রাউজানে অপহরণ চক্রের নেতৃত্বে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠজন আল ফয়জুল ও গিয়াস কাদের চৌধুরীকে শোকজ রাউজান উপজেলায় অপহরণ বাণিজ্যের ঘটনায় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও রাউজানের সাবেক এমপি গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর ঘনিষ্ঠজন এবং যুবদল নেতা আল ফয়জুল ওরফে রবিউলের নাম উঠে এসেছে। অভিযোগ রয়েছে, রবিউলের নেতৃত্বে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, চাঁদাবাজি এবং অপহরণের মতো গুরুতর অপরাধ দীর্ঘদিন ধরে সংগঠিত হচ্ছে। বিশেষ সূত্রে জানা গেছে, গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছত্রছায়ায় রবিউল এবং তার দলীয় ক্যাডাররা রাউজানে একের পর এক অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। এই ঘটনায় স্থানীয় জনগণের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ বিরাজ করছে। দলের শীর্ষ পর্যায়ে এ বিষয়ে জানার পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে গিয়াস কাদের চৌধুরী এবং তার ছেলে সামির কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিশ (শোকজ) পাঠানো হয়েছে। দলীয় সূত্রে আরও জানা গেছে, গিয়াস কাদের চৌধুরী দলের দুঃসময়ে দীর্ঘদিন দেশের বাইরে পলাতক ছিলেন, যা দলের হাইকমান্ডের মধ্যে তার প্রতি অনাস্থার জন্ম দিয়েছে। তবে বর্তমানে দলের সুসময়ে তিনি দেশে ফিরে এসে রাউজানে ফ্যাসিবাদী কায়দায় ব্যাপক চাঁদাবাজি পরিচালনা করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তার আশীর্বাদপুষ্ট দলীয় ক্যাডাররাও এ কাজে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। স্থানীয়দের দাবি, গিয়াস কাদের চৌধুরী ও তার অনুসারীদের কার্যক্রম দলীয় ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ণ করছে। দ্রুত এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
অপহৃত চেয়ারম্যান হারুনের বিরুদ্ধে ভুজ পুর থানায় হত্যার মামলা রয়েছে বলে থানা সূত্রে জানাযায়। অপহরণ, রাজনীতি এবং আইনশৃঙ্খলা: বায়েজিদের ঘটনায় নতুন প্রশ্ন বায়েজিদ বোস্তামী থানার সাম্প্রতিক অপহরণ ও উদ্ধার অভিযান নিঃসন্দেহে পুলিশের দ্রুততার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। মাত্র ১২ ঘণ্টার মধ্যে অপহৃত ব্যক্তিকে উদ্ধার এবং অপহরণকারীদের গ্রেপ্তার, এমন সাফল্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্ষমতাকে পুনরায় প্রমাণিত করেছে। তবে এ ঘটনাটি গভীর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের দাবি রাখে, কারণ এটি কেবল একটি অপহরণের ঘটনা নয়, বরং রাজনীতি ও অপরাধের অন্ধকার জগতের ভয়াবহ চিত্র উন্মোচন করেছে। প্রথমত, এ ঘটনায় অভিযুক্তদের মধ্যে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারী থাকা এবং যুবদল নেতার জড়িত থাকার বিষয়টি রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার প্রশ্ন তুলেছে। রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে সন্ত্রাস ও অপহরণ চক্র গড়ে উঠলে তা কেবল আইনশৃঙ্খলার জন্য হুমকি নয়, পুরো সামাজিক ব্যবস্থাকেই দুর্বল করে দেয়। রাউজানে দীর্ঘদিন ধরে অপহরণ, চাঁদাবাজি এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রম চলতে থাকা সত্ত্বেও এ বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি কেন? এর পেছনে রাজনৈতিক প্রভাবের কী ভূমিকা রয়েছে, তা গভীর অনুসন্ধানের দাবি রাখে।
দ্বিতীয়ত, দলীয় শৃঙ্খলা এবং রাজনৈতিক মূল্যবোধের অভাবও এখানে প্রকট। গিয়াস কাদের চৌধুরীর মতো উচ্চপর্যায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে আসা, এমনকি তাদের শোকজ নোটিশ পাঠানোর মতো ঘটনা বিএনপির অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার ইঙ্গিত দেয়। দলের প্রতি জনগণের আস্থা তৈরি করতে হলে এসব নেতাদের কার্যক্রমের বিষয়ে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায়, দলের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ণ হতে থাকবে। তৃতীয়ত, অপহৃত হারুন রশিদের বিরুদ্ধে হত্যার মামলার বিষয়টি এ ঘটনাকে আরও জটিল করে তুলেছে। অপরাধী ও ভুক্তভোগীর সম্পর্কের এই ধোঁয়াশা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য নীতিগত চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। অপরাধী ও ভুক্তভোগীর চরিত্র বিচার না করে সঠিক তদন্ত ও আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এই ঘটনা আমাদের রাজনীতি, সমাজ এবং আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার গভীর অসংগতির দিকগুলো তুলে ধরে। অপরাধ দমনে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত একটি শক্তিশালী প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের সদস্যদের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে কঠোর নজরদারি ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
বায়েজিদে পুলিশের সাফল্য প্রশংসনীয় হলেও এ ঘটনাটি সমগ্র ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং অপরাধ প্রবণতার সামাজিক শিকড়ের প্রতি নতুন করে আলোকপাত করেছে। এ বিষয়গুলো সমাধানে আমাদের ত্বরিত ও আন্তরিক পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায়, এমন ঘটনা ভবিষ্যতেও সমাজকে অস্থিতিশীল করে তুলবে।