প্রতিবেশী দেশ ভারত বহু বছর ধরে বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে লক্ষাধিক মানুষ চিকিৎসা, শিক্ষা এবং ভ্রমণের জন্য ভারতে যান। এই চিকিৎসা খাতে নির্ভরতা এতটাই বেশি যে বাংলাদেশের বিপুল অঙ্কের অর্থ প্রতিবছর বৈধ ও অবৈধ পথে ভারতে চলে যায়। ভারতে চিকিৎসা খাতে আমাদের কতপরিমাণ বাংলাদেশের টাকা ব্যয় হয় তা একটু পর্যালোচনা করে দেখাযায়-ভারতে প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে আনুমানিক ১০-১২ লক্ষ মানুষ চিকিৎসা গ্রহণের জন্য যায়। এর মধ্যে বেশিরভাগই উন্নত চিকিৎসার জন্য কলকাতা, চেন্নাই, দিল্লি, বেঙ্গালুরু এবং মুম্বাইয়ের হাসপাতালগুলোতে যায়। চিকিৎসা খাতে অর্থ ব্যয় (বাংলাদেশ থেকে):বাংলাদেশের রোগীরা চিকিৎসা গ্রহণের জন্য ভারতের হাসপাতালে বছরে আনুমানিক ৬,০০০-৮,০০০ কোটি টাকা ব্যয় করেন। এর বাইরে ভ্রমণ, আবাসন, এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ ধরলে এই ব্যয়ের পরিমাণ আরও বাড়ে।
ভারতে পণ্য রপ্তানি থেকে আয়:
ভারত প্রতিবছর বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি করে, যার আর্থিক পরিমাণ আনুমানিক ৭৫,০০০-৮০,০০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ভারতের অন্যতম বৃহৎ রপ্তানি বাজার। চিকিৎসা ও ভিসা বাণিজ্যের প্রভাব: ভারত চিকিৎসা এবং ভিসা বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে আরও কয়েকশ কোটি টাকা সরাসরি দালাল ও ভিসা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নিয়ে যাচ্ছে। এই আর্থিক শোষণ বাংলাদেশি রোগীদের জন্য বড় ধরনের আর্থিক ও মানবিক চাপ তৈরি করছে। চিকিৎসার জন্য যাওয়া রোগীদের জন্য এটি যেমন একটি নির্ভরতার জায়গা, তেমনি তাদের জন্য বিড়ম্বনার এক নতুন নাম হয়ে উঠেছে ভারতীয় ভিসা বাণিজ্য।
ভারতে চিকিৎসা নিতে চাওয়া রোগীদের সামনে ভিসা প্রাপ্তির প্রক্রিয়া আজ এক বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়েছে। ভিসা পেতে দালালদের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের ঘুষ দিতে বাধ্য হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। বিশেষত চট্টগ্রামসহ অন্যান্য ভিসা অফিসে এই বাণিজ্য আজ একটি সুসংগঠিত দালাল চক্রের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। চট্টগ্রামে ভিসা প্রক্রিয়া: জটিলতার অন্ত নেই
ভারতীয় ভিসা পেতে চট্টগ্রামের রোগীদের প্রথমে সিরিয়াল নিতে হয়। এরপর একটি নির্ধারিত তারিখে পাসপোর্ট জমা দেওয়ার সুযোগ মেলে। কিন্তু পাসপোর্ট জমা দেওয়া এবং ভিসা প্রাপ্তি—এই দুই ধাপে দালাল চক্রের প্রভাব এতটাই বিস্তৃত যে এটি একটি নিয়ন্ত্রিত বাজারে পরিণত হয়েছে। ভিসার জন্য দালাল নির্ভরতা: সরকারি নিয়মে ভারতীয় ভিসা প্রক্রিয়া বিনামূল্যে হওয়ার কথা। তবে বাস্তবতা হলো, দালাল ছাড়া ভিসা প্রাপ্তি কার্যত অসম্ভব। চট্টগ্রামে একজন রোগীকে ভিসা পেতে দালালকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হচ্ছে। একটি পরিবারের যদি চারজন সদস্য চিকিৎসার জন্য ভারতে যেতে চান, তাহলে এই খরচ বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় দুই লাখ টাকায়। এই টাকা দিতে গিয়ে রোগী ও তার পরিবার হিমশিম খাচ্ছে।
অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া ও হয়রানি:
পাসপোর্ট জমা দেওয়ার পরও রোগী নিশ্চিত হতে পারছেন না যে তিনি ভিসা পাবেন কি না। অনেক সময় দেখা যায়, লাইনে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরও ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়। এই প্রক্রিয়ার কোনো নির্ধারিত নিয়ম নেই, বরং প্রতিটি ধাপেই দালালদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ।
দালালদের দৌরাত্ম্য এবং সাধারণ মানুষের ভোগান্তি
ভারতের ভিসা প্রক্রিয়ায় দালাল চক্রের এমন দৌরাত্ম্য সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। বিশেষ করে চট্টগ্রামে এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। রোগীরা ভিসা পেতে একদিকে দালালদের চাঁদা দিতে বাধ্য হচ্ছেন, অন্যদিকে তারা চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে গিয়ে চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়ছেন।বাংলাদেশের অনেক গরিব মানুষ, যারা চিকিৎসার জন্য শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করেন, তারা এই ভিসা বাণিজ্যের কারণে চিকিৎসা নেওয়ার আগেই দুর্বল হয়ে পড়ছেন। এতে তাদের জন্য জীবন বাঁচানোর আশা অনেকটাই ফিকে হয়ে যাচ্ছে।ভিসা বাণিজ্যের আর্থিক প্রভাব
ভারতের চিকিৎসা খাতে বাংলাদেশের রোগীদের ওপর নির্ভরতা এতটাই বেশি যে প্রতিবছর লক্ষাধিক মানুষ ভারতের বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা নিতে যান। এতে বৈধভাবে হাজার কোটি টাকা ভারতে চলে যায়। কিন্তু ভিসা বাণিজ্যের মাধ্যমে অবৈধভাবে আরও কয়েকশ কোটি টাকা দালাল ও ভিসা কর্তৃপক্ষের হাতে চলে যাচ্ছে।
ভারত এই অর্থনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করলেও বাংলাদেশি রোগীদের জন্য একটি সহজ ও মানবিক ভিসা প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। ভিসা বাণিজ্য শুধু আর্থিক শোষণেরই উদাহরণ নয়, এটি দুই দেশের মধ্যকার আস্থার সম্পর্কেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা এই ভিসা বাণিজ্যের বিষয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলি অবগত থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে তারা কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। ভারতীয় দূতাবাস এই বিষয়ে নীরব ভূমিকা পালন করছে। এমনকি কেউ যদি এই দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেন, তাহলে তাকে হয় ভিসা প্রত্যাখ্যানের শিকার হতে হয়, নয়তো ভিসা বাতিল করা হয়। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি ভীতি তৈরি হয়েছে, যা দালাল চক্রকে আরও শক্তিশালী করছে। করণীয়
এই ভিসা বাণিজ্য বন্ধ করতে বাংলাদেশ সরকারের উচিত ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে একটি মানবিক এবং স্বচ্ছ ভিসা প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা। দালাল চক্র নির্মূল করতে এবং সাধারণ মানুষকে হয়রানি থেকে রক্ষা করতে একটি যৌথ পর্যবেক্ষণ কমিটি গঠন করা জরুরি। ভারত যদি বাংলাদেশকে তাদের বড় অর্থনৈতিক অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করে, তবে তাদের দায়িত্ব বাংলাদেশের মানুষের প্রতি ন্যায্য আচরণ করা।
বাংলাদেশ থেকে ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগীরা প্রতিনিয়ত ভিসা বাণিজ্যের ফাঁদে পড়ে শোষণের শিকার হচ্ছেন। এটি শুধু অর্থনৈতিক শোষণের নয়, বরং মানবিকতার প্রতি অবমাননার উদাহরণ। দুই দেশের সম্পর্ক আরও মজবুত করতে এবং সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কমাতে এই ভিসা বাণিজ্যের অবসান ঘটানো অত্যন্ত জরুরি। মানবিক মূল্যবোধ এবং নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতের উচিত এই প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা এবং সহজীকরণ আনা।