চেরাগি পাহাড় বঙ্গবন্ধু ভবনে চাটগাঁইয়া নওজোয়ানের উদ্যোগে ১৮ই অক্টোবর, আইয়ুব বাচ্চুর ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে চেরাগি পাহাড় বঙ্গবন্ধু ভবনে চাটগাঁইয়া নওজোয়ানের উদ্যোগে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক এবং সঙ্গীত জগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এই বৈঠকখানা হলে উপস্থিত ছিলেন, যেখানে রূপালী গিটারের কিংবদন্তি শিল্পীকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তার জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা করা হয়। আয়োজন এবং উদ্দেশ্য:
চাটগাঁইয়া নওজোয়ান, যারা দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রামের তরুণদের সংগঠিত করে বিভিন্ন সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার কাজ করে আসছে, এই বিশেষ আয়োজনটির মূল উদ্যোক্তা ছিল। সংগঠনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আইয়ুব বাচ্চুর অবদানকে স্মরণ করা এবং তার সঙ্গীতের উত্তরাধিকারকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
বক্তব্য ও স্মৃতিচারণ:
বক্তব্যের সময় চাটগাঁইয়া নওজোয়ানের নেতা চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরামের মহাসচিব, বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সাংবাদিক কামাল উদ্দিন বলেন, “আইয়ুব বাচ্চু শুধুমাত্র একজন গায়ক ছিলেন না, তিনি আমাদের জন্য একটি অধ্যায়, একটি প্রতিষ্ঠান। তাঁর সৃষ্টিশীলতা এবং সঙ্গীতের প্রতি ভালোবাসা চিরকাল আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।” তিনি আরও বলেন, “রূপালী গিটারের সুর আজও আমাদের হৃদয়ে বেজে চলে, এবং তাঁর মত সরল, সোজা এবং উদার মানুষের অনুপস্থিতি আমাদের হৃদয়ে শূন্যতা তৈরি করেছে।”আলোচনায় উঠে আসে আইয়ুব বাচ্চুর জীবনের অনেক অজানা অধ্যায় এবং তার ব্যতিক্রমী সঙ্গীতশৈলীর কথা। তার গান কীভাবে সমাজের বাস্তবতা, প্রেম, সংগ্রাম এবং মানুষের আবেগের গভীরতম অংশকে স্পর্শ করেছিল, তা নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়। ব্যক্তি আইয়ুব বাচ্চু: আলোচনা সভায় রায়হান, যিনি আইয়ুব বাচ্চুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন, বলেন, “বাচ্চু ভাই ছিলেন এমন একজন মানুষ, যিনি সবার কষ্টের পাশে দাঁড়াতেন। তাঁর সরলতা এবং আন্তরিকতা এমন ছিল, যা শুধু গানে নয়, তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও প্রতিফলিত হতো। খুলশী সেন্টারের দোকানে আড্ডার সময় তিনি আমার জন্য দুটো শার্ট উপহার দিয়েছিলেন এবং একদিন দুপুরে খুলশী টাওয়ারে খাবার খাওয়ানোর কথাগুলো আমি কখনো ভুলতে পারব না।” অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে উপস্থিত সকলে আইয়ুব বাচ্চুর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন। তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে সবাই একমত হন যে, আইয়ুব বাচ্চুর সৃষ্টিকর্ম শুধু বাংলাদেশ নয়, আন্তর্জাতিক সংগীত জগতেও চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে। বিশেষ ঘোষণা:অনুষ্ঠানে চাটগাঁইয়া নওজোয়ানের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়, আগামী বছর আইয়ুব বাচ্চুর স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটি সঙ্গীত উৎসবের আয়োজন করা হবে, যেখানে তাঁর জনপ্রিয় গানের পরিবেশনার মাধ্যমে তাঁকে স্মরণ করা হবে।এই আলোচনাসভা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু চিরকাল সঙ্গীত জগতে অমর হয়ে থাকবেন। তাঁর সুর, তাঁর গান আমাদের পথচলার প্রেরণা হয়ে থাকবে, এবং তাঁর রূপালী গিটারের সুর আমাদের জীবনের প্রতিটি বাঁকে ধ্বনিত হবে। যিনি আমাদের সঙ্গীতজগতকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।
আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন শুধু একজন গায়ক বা গিটারবাদক নন, তিনি ছিলেন আমাদের চট্টগ্রামের ঐতিহ্য আর অহংকার। তিনি সুরের মাধ্যমে যে আগুন জ্বালিয়েছিলেন, তা আজও আমাদের অন্তরে জ্বলছে। তাঁর হাতের রূপালী গিটার থেকে ঝরে পড়া প্রতিটি সুর যেন চট্টগ্রামের হৃদয়কে স্পর্শ করে যায়। আজ তাঁর কথা স্মরণ করতে গিয়ে মনে হচ্ছে, তাঁর মতন কেউ কি আর আসবে? তাঁর সেই গিটারের সুরের যাদু কি আর কখনো আমাদের কানে বেজে উঠবে? আমাকে আজ এই বিশেষ অনুষ্ঠানে কিছু কথা বলার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন চাটগাঁইয়া নওজোয়ানের কর্ণধার জামাল ভাই। অনেক অনুষ্ঠানেই আমি যোগ দিই, আলোচনা করি, তবে আইয়ুব বাচ্চুর স্মরণে কিছু বলতে পারাটা আমার জন্য এক বিশাল গর্বের বিষয়। আজ তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলতে চাই, আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন এমন একজন মানুষ, যার সুরের মধ্যে ছিল জীবনের উত্থান-পতনের গল্প, ভালোবাসার অনুরণন, এবং কষ্টের গভীর ছায়া।
তাঁর গানের মধ্যে ছিল জীবনের গল্প। তিনি যখন গাইতেন, মনে হতো যেন তাঁর গিটারের প্রতিটি সুর আমাদের অন্তরের কথা বলে। “রূপালী গিটার” গানের সেই সুর, সেই ছন্দ যেন আজও কানে বাজে। এই গানের প্রতিটি শব্দে তিনি জীবনের বেদনাকে তুলে ধরেছিলেন, যা আমাদের সবাইকে ছুঁয়ে যায়। আমাদের সঙ্গীতজগতে এমন কেউ আর আসবে কি, যিনি একইসাথে এতটা স্নিগ্ধ ও তীব্র ভালোবাসার অনুভূতি জাগাতে পারবেন?
আজ আমরা আইয়ুব বাচ্চুকে স্মরণ করছি, কিন্তু আমাদের অন্তরে তাঁর যে স্থান তা কখনো পূর্ণ হবে না। তিনি চলে গেছেন, কিন্তু তাঁর সৃষ্টিগুলো আমাদের মাঝে রয়ে গেছে চিরকাল। প্রতিটি গানে, প্রতিটি সুরে তিনি আমাদের হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবেন। তাই এই মহান গিটার সম্রাটের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলতে চাই, তাঁর সুর আমাদের সঙ্গীতপ্রেমী হৃদয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবে- আইয়ুব বাচ্চু: বাংলাদেশের রক সঙ্গীতের অগ্রদূত আইয়ুব বাচ্চু, যিনি বাংলাদেশে রক সঙ্গীতকে একটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, সঙ্গীতপ্রেমীদের জন্য এক অসাধারণ অনুপ্রেরণা। তিনি ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীতের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল এবং কিশোর বয়সেই তিনি গিটার শেখা শুরু করেন। প্রারম্ভিক জীবন ও সঙ্গীতের প্রতি আকর্ষণ আইয়ুব বাচ্চুর ছোটবেলা কাটে চট্টগ্রামে, যেখানে তিনি প্রথম গিটার হাতে তুলে নেন। তাঁর সঙ্গীত জীবনের প্রথম দিকের অনুপ্রেরণা ছিলেন জিমি হেন্ড্রিক্স, মার্ক নফলার, এবং কার্লোস সান্তানা। এই শিল্পীদের কাজ তাঁকে কেবল গিটার শেখার জন্যই অনুপ্রাণিত করেনি বরং নিজস্ব সঙ্গীত সৃষ্টির জন্য প্রেরণা জুগিয়েছে। বাচ্চু চট্টগ্রামের স্থানীয় ব্যান্ডের সাথে যুক্ত হন এবং সেখানে তিনি অনেকের মধ্যে নিজেকে আলাদা করে তুলতে সক্ষম হন। ব্যান্ড ক্যারিয়ার ও এলআরবি প্রতিষ্ঠা
আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গীত ক্যারিয়ারের শুরু হয় ১৯৭৮ সালে ফিলিংস নামক একটি ব্যান্ডের মাধ্যমে। পরবর্তীতে তিনি সোলস ব্যান্ডে যোগ দেন এবং সেখানে প্রায় ১০ বছর কাটান। এই ব্যান্ডের সাথে তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন এবং বাংলাদেশে রক সঙ্গীতপ্রেমীদের মাঝে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তবে ১৯৯১ সালে বাচ্চু তাঁর নিজস্ব ব্যান্ড এলআরবি (লাভ রানস ব্লাইন্ড) প্রতিষ্ঠা করেন, যা দেশের রক সঙ্গীত ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। এলআরবি ব্যান্ডের প্রথম অ্যালবামটি ছিল ডাবল অ্যালবাম, যা বাংলাদেশের প্রথম দ্বৈত অ্যালবাম হিসেবে বিশেষভাবে স্মরণীয়। এলআরবির গানগুলোর মধ্যে “চলো বদলে যাই”, “রূপালী গিটার”, “মাধবী”, “শেষ চিঠি”, এবং “বাংলাদেশ” গানগুলো বিশেষভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। তিনি এই ব্যান্ডের মাধ্যমে দেশজুড়ে অসংখ্য সঙ্গীতপ্রেমী সৃষ্টি করেন এবং রক সঙ্গীতকে নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করেন। একক অ্যালবাম এবং সঙ্গীত জীবনে সফলতা আইয়ুব বাচ্চুর একক অ্যালবামগুলির মধ্যেও রয়েছে বেশ কিছু কালজয়ী গান। তাঁর প্রথম একক অ্যালবাম রক্তগোলাপ প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে। এরপর তিনি বেশ কিছু অ্যালবাম প্রকাশ করেন, যেমন “ময়না”, “কষ্ট”, “আম্মা”, “ধূমকেতু”, “ভালোবাসা এক্সপ্রেস”, এবং “জীবন”। তাঁর কণ্ঠ ও সুরের মাধ্যমে তিনি সঙ্গীতপ্রেমীদের মনে গভীর ছাপ ফেলতে সক্ষম হন। তাঁর গানের কথা, সুর এবং গিটার সোলোর মধ্য দিয়ে জীবনের নানা দুঃখ-কষ্ট, প্রেম-বিরহ এবং সামাজিক বাস্তবতার কথা ফুটে উঠত।
গিটার বাজানো এবং ভিন্নধর্মী সঙ্গীত আইয়ুব বাচ্চু বাংলাদেশের সঙ্গীতজগতে একজন অসাধারণ গিটারবাদক হিসেবে পরিচিত। তাঁর গিটারের জাদুতে তিনি যেমন শ্রোতাদের মন জয় করেছেন, তেমনি নতুন প্রজন্মের অনেক শিল্পীকেও অনুপ্রাণিত করেছেন। দেশের অনেক গিটারবাদক তাঁর গিটারের সুরকে অনুকরণ করার চেষ্টা করেছেন। আইয়ুব বাচ্চু সবসময় গিটারের সাথে এক অদ্ভুত ভালোবাসা অনুভব করতেন, যা তাঁর গান ও লাইভ পারফরম্যান্সে প্রকাশ পেত। সামাজিক অবদান ও উত্তরাধিকার
আইয়ুব বাচ্চু শুধু গানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না; তিনি একজন জনদরদী মানুষও ছিলেন। তিনি তরুণদের মাঝে সঙ্গীতচর্চার প্রতি আগ্রহ বাড়ানোর জন্য কাজ করেছেন এবং বিভিন্ন সময় সঙ্গীতশিল্পীদের সুনির্দিষ্ট পরামর্শ দিয়ে তাঁদেরকে এগিয়ে যেতে সহায়তা করেছেন। এ কারণে অনেক তরুণ সঙ্গীতশিল্পী তাঁকে তাঁদের আদর্শ হিসেবে মানেন। তাঁর মৃত্যুর পরেও তিনি দেশের সঙ্গীত জগতে অবদান রেখে যাচ্ছেন, এবং তাঁর গানগুলি এখনো সঙ্গীতপ্রেমীদের মাঝে প্রিয়। শেষযাত্রা এবং তাঁর স্থায়ী প্রভাব ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আইয়ুব বাচ্চু চিরতরে বিদায় নেন। তাঁর মৃত্যুতে পুরো দেশ শোকাহত হয় এবং সঙ্গীত জগতে এক বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হয়। তবে তাঁর গান এবং সঙ্গীতের মাধ্যমেই তিনি আজও আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন। বাংলাদেশে রক সঙ্গীতকে একটি ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁর অবদান অনস্বীকার্য, এবং তাঁর গান প্রজন্মের পর প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে থাকবে।