তৃতীয় পর্বঃ
বৃষ্টি পড়ছিলো টিপ টিপ করে। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে জোবায়েদা তাকিয়ে ছিলো বাইরে, অথচ মনটা ছিলো ভিতরে, এক গাঢ় কুয়াশার ভেতর আটকে। মনে হচ্ছিলো, চোখের সামনেই সে দেখতে পাচ্ছে সেই অদ্ভুত মানুষটিকে, যাকে সে ভালোবেসেছিলো একদিন। সাদাসিধে, কোমল চেহারার এক মানুষ। তার প্রতিটি কথা, প্রতিটি স্পর্শ যেন এক নির্ভেজাল ভরসা, তবুও আজ যেন সব কিছুই অন্যরকম। জোবায়েদার ভেতরের কুয়াশার আবরণে একের পর এক ফোঁটা ফোঁটা দাগ পড়ছে, ঠিক বৃষ্টির মতোই। সে ভাবতে থাকে—ছলনা! এই শব্দটির অর্থ এত গভীর, এত রহস্যময় হতে পারে, এটা সে কখনো ভাবেনি। মানুষ কত সুন্দরভাবে হাত ধরে, চোখে চোখ রেখে ভালোবাসার অভিনয় করতে পারে! একদিন যে মানুষটি বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো, “তুমি আমার পৃথিবী,” সেই মানুষটিই আরেকজনকে নিয়ে পার্কে হাঁটে, তার চোখে চোখ রেখে বলে “তুমি ছাড়া আমার চলে না।” এসব দেখতে দেখতে তার নিজের চোখই যেন বিশ্বাস করতে চাইছিলো না। চোখের ভেতরের কুয়াশা তখন ভারী হতে থাকে, মনের গভীরে কষ্টের এক নিঃশব্দ ঝড় বয়ে যায়। জোবায়েদা চুপ করে থাকেনি, তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু যতই কথা বলেছে, ততই বুঝতে পেরেছে, সে একা। তার কষ্টে তার সঙ্গীর কিছুই যায় আসে না। তার কষ্ট যখন তীব্র হয়ে ওঠে, তখন তার মুখের ওই মানুষটির মন ঠিকই ভালো হয়ে ওঠে অন্য কারো সান্নিধ্যে, আর জোবায়েদা নিজে কুয়াশায় ঢাকা এই পৃথিবীতে একাই থাকেন।
একদিন, সে ভাবল, চেষ্টা করে দেখুক সব ঠিক করার। মনের সব শক্তি দিয়ে ধরে রাখুক সেই মানুষটিকে, যে তার জীবনে এতটা জায়গা দখল করেছে। কিন্তু যতই চেষ্টায় ধরা দেওয়ার চেষ্টা করে, ততই সে দূরে সরে যায়। সময় যেন থেমে যায় তার কাছে। মাসের পর মাস কেটে যায়, কিন্তু কিছুই বদলায় না। সেই মানুষটি কখনো ফিরে এসে জানতে চায় না, “তুমি কেমন আছো?” জোবায়েদার কাছে মনে হয়, তার ভালোবাসা, তার অপেক্ষা সব যেন কেবল এক অচেনা কুয়াশার মধ্যে হারিয়ে গেছে।
আস্তে আস্তে জোবায়েদা শিখে যায়, তাকে একাই থাকতে হবে। আর কারো ভরসায় সে থাকতে পারবে না। তার বিশ্বাসের সমস্ত আলো নিভে গেছে, এখন সে অন্য কাউকে বিশ্বাস করতে ভয় পায়। তবে ধীরে ধীরে সে এক নতুনভাবে নিজের ভালো থাকার চেষ্টা করতে শিখে যায়। একসময় বুঝতে পারে, নিজের ভরসা একমাত্র নিজের মধ্যেই খুঁজে পেতে হয়, অন্য কেউ সে সুখ এনে দিতে পারবে না। তবুও, যখন কখনো বৃষ্টি পড়ে আর কুয়াশা ঘন হয়, তার মনে তখনও এক নিরব কষ্ট জেগে ওঠে। তাকে মনে করিয়ে দেয়, সেই প্রথম বৃষ্টির দিনের কথা, যখন একজনে তার জীবনটাকে ভরসায় পূর্ণ করেছিলো, অথচ পরে ছলনার বৃষ্টিতেই সব ভিজিয়ে দিয়েছিলো।
জোবায়েদার গল্প এক ধরণের গল্প যা কেবল তার নয়, যেন পৃথিবীর অগণিত নারীর প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। জীবন তার কাছে কেবলই একটি দৈনন্দিন সংগ্রাম নয়, বরং ভালোবাসার অভাব পূরণের এক অতলান্ত আকাঙ্ক্ষা। এ যেন এক অবিচ্ছিন্ন যাত্রা—প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত জোবায়েদা স্বপ্ন দেখে সেই মানুষটির, যে তার অন্তরের নিঃসঙ্গতাকে ভালোবাসায় রাঙিয়ে তুলবে। তবু, সেই ভালোবাসা কি সবার জীবনেই আসে?
প্রাসাদের সোনালী শৃঙ্গের মতো, দুবাইয়ের রাজকন্যা শেখা মাহরার জীবনেও যেন এই অনুরূপ শূন্যতা ছিল। রাজকন্যা হয়েও, তাঁর প্রাসাদ যেন নিঃসঙ্গতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। ২০২৩ সালে ধুমধাম করে বিয়ে করেছিলেন তিনি শেখ মানার বিন মোহাম্মদকে। রাজকুমারের হাত ধরে রূপকথার জীবনে প্রবেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন খুব দ্রুতই ভেঙে যায়। বিয়ের কিছু মাসের মধ্যেই মাহরা বুঝতে পারলেন, তাঁর স্বামী অন্য নারীর সান্নিধ্যে আকৃষ্ট। প্রাসাদের সোনালী দেয়ালগুলো তখন তাঁর কাছে আরও একাকী হয়ে উঠলো। মাহরা সাহস করে নিজের ভালোবাসাকে মুক্ত করলেন, বললেন, “যেহেতু তুমি অন্য নারীর সঙ্গ উপভোগ করছো সেহেতু আমি তোমাকে মুক্ত করে দিলাম।” সেই মুহূর্তে তিনি যেন সমগ্র পৃথিবীর সকল নারীর পক্ষে একান্তে বললেন—কেবল প্রাসাদের অভিজাত্য আর ক্ষমতার মর্যাদা নয়, এক নারী তার ভালোবাসার সাথেই সুখী হতে চায়। শেখা মাহরা সেই নারী যে শুধুমাত্র বিলাসবহুল জীবনের মধ্যে সুখ খুঁজে পায় না। তাঁর চাহিদা আরও গভীর, আরও অন্তর্দৃষ্টি মেশানো। পৃথিবীর বহু নারী হয়তো তাঁর মতোই অনুভব করেন, এবং মাহরার এই সিদ্ধান্ত তাঁদের জন্য এক প্রতীক হয়ে ওঠে। রাজকন্যা হয়েও, প্রাসাদে রাজ্যের খ্যাতির মাঝেও, তিনি চেয়েছিলেন এক সাধারণ স্বপ্ন—ভালোবাসার মানুষটি কেবল তাঁরই থাকুক। কিন্তু, তার কাছে সেই একাকীত্বই স্বস্তি হয়ে উঠলো।
কালের নির্দয় বিচার কেবল রাজকন্যাদের জন্য নয়, বরং এই কাহিনি চলে আসে প্রিন্সেস ডায়ানার জীবনেও। রাজপুত্র চার্লসের প্রতি তাঁর অপার ভালোবাসা, সেই ভালোবাসার গল্প সারা পৃথিবী জানলেও, সেই গল্পের শেষটি তিক্ত। প্রাসাদের ভিতরেও ডায়ানার মতো নারীদের জীবন শুন্যতায় ভরে যায়, কারণ পুরুষের প্রেমে নতুনত্বের প্রতি এক চিরন্তন আকর্ষণ। তারা নতুনের প্রতি অভিলাষিত হয়, আর পিছনে ফেলে যায় স্বপ্ন গড়া সম্পর্ক।
মাহরা, ডায়ানা, জোবায়েদা—তাঁদের জীবন আলাদা হলেও, তাঁদের হৃদয়ের চাওয়া যেন এক। সেই চাওয়াটি একক, সবার হৃদয়ে এক অবিনশ্বর আকাঙ্ক্ষা হয়ে উঠেছে। ভালোবাসা কেবল একটি প্রাসাদ নয়, বরং এক নিঃসঙ্গ সময়ের শান্তি, যা এক নারীর জীবনকে পূর্ণতা দেয়। বিচ্ছেদের পর মাহরা নিজের পথ খুঁজে নিয়েছেন, তাঁর বিউটি ব্র্যান্ড ‘মাহরা এম১’ থেকে একটি সুগন্ধি এনেছেন বাজারে। সেই সুগন্ধির নাম ‘ডিভোর্স’। হয়তো সেই বিচ্ছেদই তাঁর কাছে নতুন এক শুরু, নতুন এক স্বাধীনতা। তিনি হয়তো পৃথিবীকে বলতে চেয়েছেন—সুখ পাওয়ার জন্য একা থাকাও প্রয়োজন। কখনও কখনও সম্পর্কের চেয়ে একাকীত্বই যেন শান্তির দূত হয়ে আসে। আমরা সকলেই এই গল্প থেকে কিছু না কিছু শিখতে পারি। জোবায়েদার জীবনের গল্পে, মাহরার জীবনের আকাঙ্ক্ষায়, ডায়ানার নিঃসঙ্গতায়—সবখানেই ছড়িয়ে রয়েছে সেই চিরন্তন সত্য, যে জীবন কখনও স্থির নয়। ভালোবাসা যেমন খুঁজে পাওয়া যায়, তেমনি তা হারিয়েও যায়। তবু, আমাদের প্রত্যেকের জীবনে সেই সত্যিকার সুখ লুকিয়ে থাকে আমাদের নিজেদের মধ্যে, কখনও সঙ্গীর সাথে, কখনও একাকীত্বে। জোবায়েদার স্বপ্ন ছিল চিরন্তন ভালোবাসার। সে ছোটবেলা থেকেই ভালোবাসা নিয়ে রূপকথার গল্প পড়েছে, নিজের অন্তরে গেঁথেছে একজন স্নেহময়, বিশ্বস্ত সঙ্গীর কথা। তার চোখে স্বপ্নের ছবি ছিল এমন একজনের, যার সঙ্গে জীবনের প্রতিটি ছোট-বড় মুহূর্ত ভাগ করে নিবে। যে তাকে সম্মান করবে, তার আবেগকে বুঝবে, আর তার মনের গভীরতম অনুভূতিগুলোকে আপন করে নিবে।
বিয়ের আগের দিনগুলোতে কতজন প্রস্তাবকেই না ফিরিয়ে দিয়েছিল জোবায়েদা! তার আশা ছিল, একদিন তার মনের মতো একজন মানুষ আসবে, যে তার জীবনের প্রতিটি স্বপ্ন পূর্ণ করবে। কিন্তু সে যখন বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হলো, তখন দেখল সেই আশার আলোক রশ্মি মলিন হতে শুরু করল। সে বুঝতে পারলো, এই মানুষটি তার চেয়ে তার শরীরকে বেশি আকর্ষণীয় মনে করে। প্রথম রাতে, সে দেখলো তার স্বামীর চোখে এক অস্থির ক্ষুধা, যে ক্ষুধা ভালোবাসার জন্য নয়, বরং শুধু শারীরিক তৃপ্তির জন্য।
প্রথম প্রথম, জোবায়েদা ভেবেছিল হয়তো এটাই ভালোবাসার একটি দিক, হয়তো সময়ের সাথে সাথে সে তার স্বামীর চোখে সত্যিকারের ভালোবাসা দেখতে পাবে। কিন্তু দিন যত এগোতে থাকল, ততই সে বুঝতে পারলো এই সম্পর্ক যেন এক অপূর্ণতায় ভরা। তার স্বামী ছিল শুধু রাতের অন্ধকারে শরীরের তৃষ্ণা মেটানোর জন্য উপস্থিত। প্রতিটি রাত ছিল একই, এক মেকি ভালোবাসার নাটক, যেখানে স্পর্শের মধ্যে ছিল না কোনো উষ্ণতা, ছিল না হৃদয়ের কোনো স্পন্দন। জোবায়েদা তার স্বামীর মনোভাব ধীরে ধীরে বুঝে গেলো। সে অনুভব করল, এই মানুষটি কখনোই তাকে নিজের হৃদয় দিয়ে ভালোবাসেনি, বরং শরীরকে এক খেলার উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করেছে। তার চোখে এক কামুকতা ছিল, যেটা ভালোবাসার বদলে ছিল তার নিজস্ব তৃষ্ণাকে মেটানোর ইচ্ছা। এমনকি, সে শুনেছে তার স্বামী অন্য নারীদের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে—নারীর দেহের প্রতি তার এই তৃষ্ণা যেন এক অবসেশন। সেই মুহূর্তে জোবায়েদা নিজেকে আরও অসহায় ও দুর্বল মনে করতে লাগল। প্রতি রাতেই তার স্বামী তার শরীরকে আলাদা করে বোঝাতে চাইত, অথচ মনকে কখনোই ছুঁতে পারেনি। সে তার প্রতি কোনো শ্রদ্ধাবোধ দেখায়নি, জোবায়েদার মনের কষ্ট বোঝার চেষ্টা করেনি। তার ভালোবাসা কেবল ছিল এক মেকি অভিনয়। কিছু দিনের মধ্যেই জোবায়েদার মন থেকে বিশ্বাস আর স্বপ্ন ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে লাগল। সে অনুভব করল, যে পুরুষ নিজের চাহিদা মেটানোর জন্য নারীদের শিকার করে, তার হৃদয়ে ভালোবাসার কোনো স্থান নেই। এই অভিজ্ঞতা জোবায়েদাকে কঠিন করে তুলল। তার কাছে এখন পুরুষ মানেই এক কামুক জীব, যে ভালোবাসার নাম করে দেহের দাসত্ব করতে চায়। সে নিজের ভিতরে এক প্রতিবাদের শক্তি খুঁজে পেলো। সে জানলো, তার জন্য এমন একটি জীবন ঠিক নয়, যেখানে সে প্রতিদিন তার নিজের আত্মমর্যাদাকে ধ্বংস হতে দেখবে। সে জানলো, তাকে এই অন্ধকার থেকে মুক্তি পেতে হবে, তাকে এই কামনার শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জোবায়েদা তার স্বপ্নের মৃত্যু দেখেছে, কিন্তু সেই মৃত্যু তাকে আরও দৃঢ় করে তুলেছে। সে সিদ্ধান্ত নিলো, তার জীবনকে আর কোনো কামুকের শিকারে পরিণত হতে দেবে না। সে জানে, এই পৃথিবীতে সত্যিকারের ভালোবাসা আছে এবং সে নিজের জন্য সেই ভালোবাসা খুঁজে নেবে। সে একটি নতুন শুরু করবে, যেখানে সে নিজের জীবনকে নিজের শর্তে গড়ে তুলতে পারবে, এক আত্মমর্যাদার ভিত্তিতে। এইবার সে বেরিয়ে এলো সেই ভেঙে যাওয়া সম্পর্ক থেকে, যেখানে ভালোবাসা ছিল শুধুই এক ছলনা। সে নিজের মত করে নতুন করে জীবনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করল—যে স্বপ্ন তাকে সুখ এনে দেবে, তাকে শান্তি এনে দেবে। সে জানে, সত্যিকারের ভালোবাসা তাকে কষ্ট দিবে না, বরং তার সমস্ত স্বপ্নকে পূর্ণতা দেবে।
লেখক ঃ সাংবাদিক গবেষক টেলিভিশন উপস্থাপক।