বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাসরত উপজাতী বা পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর লোকজন পাহাড়ের ঢালে জঙ্গল কেটে সে জঙ্গলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে পাহাড় পরিস্কার করে এক ধরনের চাষাবাদ করে, এই চাষাবাদ পদ্ধতিকে বলা হয় জুম চাষ। জুমের ধান পাকার সময় হওয়ায় পাহাড়ের নতুন ধান কাটা শুরু হয়েছে।
পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়িদের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র সহায়ক ও আদিম পদ্ধতির চাষাবাদ হলো জুম চাষ। বর্তমানে জুম চাষ অনেকাংশে কমে এলেও পাহাড়ের উপরে বা দূর্গমে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ লোকজন এখনো জুম চাষের উপর নির্ভরশীল। ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমির অভাবে অনেক ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক ভাবে জুম চাষের উপর নির্ভরশীল হতে হয় এখানকার পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মানুষ গুলোর। এখন জুমের ফসল তোলার সময় শুরু হয়েছে, এখন পাহাড়ে বেশিরভাগ জুমের ধান পেকে যাওয়ায় কৃষকেরা পাকা ধান কেটে ফসল সংগ্রহ করার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলার বলিপাড়া ইউনিয়নের ছাখয় কমান্ডার পাড়া নিকটবর্তী ঢালু পাহাড়ের উপর মেয়ইপ্রু মার্মা জুমের নারী-পুরুষ মিলে পাকা ধান কাটার শুরু করেছেন। এ সময় জুমের মালিক বলেন, ‘৪ হারি পরিমাণ ধান জুমে লাগিয়েছি। জুমের পাকা ধানগুলো আজকে প্রথমবার কাটতে শুরু করেছি। আশা করছি যে যথেষ্ট পরিমাণ ধান পাবো।’ একিভাবে পার্শ্ববর্তী পাড়ার রুইতন ম্রো ও নাননুং ম্রোদের জুমে ধান কাটতে শুরু করেছেন তারা।
জুমে শুধু ধানই নয়, তিল, যব, ভুট্টা, ঢেড়স, বেগুন, মারফা (শশা জাতীয় ফল), চিনাল (বাঙ্গি জাতীয় ফল), ঠান্ডা আলু, মরিচ, তুলা, মিস্টি কুমড়া, সাদা কুমড়া, টকপাতা, হলুদ, আদা, ইত্যাদি সহ প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ প্রকারের সাথী ফসল জুম চাষীরা উৎপাদন করে থাকেন। এ কারণে জুমিয়ারা জুম চাষকে একটি পূর্ণাঙ্গ বাজারের সাথে তুলনা করে থাকেন। এছাড়া জুম ক্ষেতে বিভিন্ন রঙের গাঁদা ফুলের চাষ করাটা জুম চাষিদের সখ হলেও ফসলের ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে এই ফুল ও গাছের ঘ্রান কার্যকরি ভূমিকা রাখে। ধান কাটা শেষে গৃহিণীরা যখন বিভিন্ন কাজে জুমে যায়, তখন গাঁদা ফুল মাথায় দিয়ে বাড়িতে ফিরে, এটা পাহাড়ের ঐতিহ্যর অংশ। বছর শেষে পাহাড়িরা গাঁদা ফুল দিয়ে বাড়িঘর সাজিয়ে রাখেন। পাড়ায় পূজা পার্বণ হলে গাঁদা ফুল দিয়ে দেবতাদের পূজা, প্রনাম করেন। জুম চাষ জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস হওয়ার পাশাপাশি পাহাড়ের নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠির ঐতিহ্য ধরে রাখতেও মূখ্য ভূমিকা পালন করে।
উপজেলা উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা টুটন দাশ বলেন, ‘উপজেলা কৃষি অফিস থেকে কৃষকদের কৃষি প্রশিক্ষণ, মাঠ পর্যায়ের কৃষি পরামর্শ ও বিভিন্ন কীটনাশক সহযোগিতা দেয়ার কারণে কৃষকেরা এখন চাষাবাদ সম্পর্কে জানেন। কৃষি প্রশিক্ষণের শিক্ষা কাজে লাগিয়ে চাষাবাদ করলে জুম চাষেও ভালো ফসল ফলবে এবং লাভবান হতে পারবেন জুম চাষিরা। মাঠ পর্যায়ের কৃষি পরামর্শের জন্য আমরা সব সময় আছি’।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. ওয়ালিদ হোসেন জানান, উপজেলায় প্রায় দুই হাজার একশত পনেরো হেক্টর জায়গার উপর ৩ হাজার ৯’শ ১৫ জন কৃষক জুম চাষ করে থাকেন। এবছর জুম ধান উৎপাদনের লক্ষ্য মাত্রা ধরা হয়েছে অনুমানিক ৪৫০ মেট্রিক টন। এবছর চাষাবাদ উপযোগ আবহাওয়া বিরাজ করায় পাহাড়ের আউশ জাতীয় ধান ভালো হয়েছে। আগস্টের শেষ সপ্তাহ থেকে কৃষকেরা জুমের পাকা ধান কাটা শুরু করেছে, অক্টোবর বা নভেম্বরের প্রথম দিকে ফসল সংগ্রহের কাজ শেষ হবে।