আরো একটি মহাবিপ্লবের ডাক: দুর্নীতি-মাফিয়া ভাঙনে ন্যায়, গণতন্ত্র ও মানুষের মুক্তির সংগ্রাম”
সম্মানিত পাঠক-এই লেখাটি লেখার অনুপ্রেরণা এসেছিল একজন সাহসী সাংবাদিক মিজানুর রহমান চৌধুরী
অন্তর থেকে উচ্চারিত দীর্ঘশ্বাস ও প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর থেকে। আমি জুলাই আন্দোলনের অগণিত শহিদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে লিখতে বসছি। আজকে তাদের তাজা রক্তে লেখা হয়েছে আমাদের নতুন স্বাধীনতার ইতিহাস। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সেই আত্মত্যাগের স্বপ্ন এখনো পূর্ণতা পায়নি। দুর্নীতি, লুটপাট ও মাফিয়াদের দাপটে দেশ আবারও পথ হারানোর শঙ্কায়—এ কারণেই আজ জরুরি হয়ে উঠেছে আরো একটি মহাবিপ্লবের ডাক। যিনি এই কথাটি লেখার অনুপ্রেরণা দিয়েছেন-
তিনি আর কেউ নন, সময়ের সাহসী সাংবাদিক, দৈনিক আমাদের বাংলা সহ একাধিক পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক এবং লাভ বাংলাদেশ-এর চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান চৌধুরী। তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতায় আমি উপলব্ধি করেছি—তিনি কেবল একজন সাংবাদিক নন, বরং একজন আত্মপ্রতিবাদী। তাঁর আক্ষেপ, তাঁর ক্ষোভ, তাঁর হতাশা সবই ব্যক্তি বিশেষকে ঘিরে নয়; বরং গোটা ব্যবস্থার গভীর অসুখকে ঘিরে।
তিনি অকপটে বলেছেন, দুর্নীতি কমেনি বরং নতুন আকারে বিস্তার লাভ করেছে। লুটপাট থেমে নেই, বরং প্রতিদিনই নতুন নতুন সিন্ডিকেট গড়ে উঠছে। কখনো বিএনপি-জামাতের নামে, কখনো জুলাই বিপ্লবীর মুখোশ পরে, আবার কখনো সরকারি চাকরিজীবী কর্মকর্তা, রাজনৈতিক টাউট-বাটপার কিংবা সুবিধাবাদী সাংবাদিকদের ছদ্মবেশে—সবাই যেন দল বেঁধে জাতির সম্পদ আত্মসাৎ করতে উঠেপড়ে লেগেছে। চৌধুরী সাহেবের ক্ষোভ এখানেই—যাদের হাতে দেশকে গড়ার দায়িত্ব, তারাই হয়ে উঠেছে ধ্বংসের কারিগর।
তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের অঙ্গীকার ছিল মানুষের মুক্তি, অর্থনৈতিক সাম্যের বাস্তবায়ন, এবং শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা। লাখো প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া সেই স্বাধীনতা আজও অর্থবহ হয়ে ওঠেনি। মানুষের মনের স্বাধীনতা আসেনি, অর্থনীতির মুক্তি হয়নি, জনজীবনে স্বস্তি ফিরেনি। ইতিহাসের প্রতি মুহূর্তে আমাদের ছাত্র সমাজকে রাজপথে দাঁড়াতে হয়েছে—এরশাদের পতন ঘটাতে যেমন হয়েছিল, তেমনি জুলাই বিপ্লবের সময়ও ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন ঘটাতে প্রাণ দিতে হয়েছে। অথচ সেই রক্তঝরা ত্যাগও আজ ভেসে যাচ্ছে সুবিধাভোগীদের দৌরাত্ম্যে।
চৌধুরী সাহেবের বক্তব্য আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। তাঁর আক্ষেপ, তাঁর অসন্তোষ এবং আশঙ্কা—সবই যেন আমার ভেতরের অস্থিরতাকে নাড়া দিয়েছে। তিনি বলেছেন, এই যে বিপ্লবের নামে পরিবর্তন এসেছে, তা আসলে অর্ধেক বিপ্লব। এতে সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি, ভবিষ্যতেও হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কারণ, আবারও এক শ্রেণীর লোভী, অসত, সুবিধাবাদী মানুষ নতুন পতাকা হাতে লুটপাট চালাচ্ছে।
তাঁর কথায় আমি দেখেছি এক গভীর সতর্কবার্তা—যদি আমরা এখনই সঠিক পথে না দাঁড়াই, তবে দেশ আবারও পথহারা হবে। সেই পথ হারানোর দায়ভার কেউ নিতে চাইবে না। এই পরিস্থিতি ঠেকাতে দরকার নতুন করে জনগণের জাগরণ। দরকার এক মহাবিপ্লব—যা হবে সত্যিকার অর্থে শোষিত-বঞ্চিত-লাঞ্ছিত মানুষের ঐক্যের বিপ্লব। তবে সেই বিপ্লবের মানে সহিংসতা নয়, বরং ন্যায়ের শপথে অন্যায়ের আস্তানায় আঘাত হানা।
সাংবাদিক মিজানুর রহমান চৌধুরীর কথাগুলো আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে কলম ধরতে। তাঁর ভাবনা আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছে—কোনো পরিবর্তনই স্থায়ী হবে না যদি তা মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন না ঘটায়। তাই আজকের প্রেক্ষাপটে তাঁর কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছে আমার লেখার দিশারি। তাঁর আত্মপ্রতিবাদী উচ্চারণই আমাকে সত্য বলার সাহস দিয়েছে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার শক্তি যুগিয়েছে।
এই লেখার প্রতিটি অক্ষরে তাই তাঁর প্রেরণার ঋণ জড়িয়ে আছে। আমি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ, কারণ তাঁর কথা আমার ভেতরের নিঃশব্দ ক্ষোভকে শব্দে রূপ দিয়েছে, আমার কলমকে দিয়েছে নতুন বেগ, নতুন পথচলার সাহস। এদেশের ইতিহাস যে কত কষ্ট আর আত্মত্যাগের ওপর দাঁড়িয়ে আছে—সেটা ভুলে যাওয়া যায় না। ১৯৭১-এর রণক্ষেত্রে। লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আমরা যে স্বাধীনতার মশাল জ্বালিয়েছিলাম, সেই অমোঘ প্রত্যয়ের আলো আজও আমাদের পথ প্রদর্শন করে। কিন্তু স্বাধীনতা কেবল ভূখণ্ডের মুক্তি নয়; তা মানুষের জীবনে মর্যাদা, সম্ভাবনা, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও সামাজিক ন্যায়বিচার ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি বহন করে। আজ সেই প্রতিশ্রুতি বহু ক্ষেত্রে রক্ষা পাচ্ছে না—দুর্নীতি, সিন্ডিকেট, ক্ষমতার একচেটিয়া প্রয়োগ এবং নাগরিক অধিকার অক্ষুণ্ণ রাখার ব্যর্থতা আমাদের স্বাধীনতাকে করুণভাবে ক্ষয় করেছে। আমি একজন সাংবাদিক, পাঠকের পক্ষে কথা বলি—কথাটি ভীষণ অংশগ্রহণঘন এবং ব্যক্তিগত: আমি চাই এই লেখা পড়ে উজ্জীবিত হোক সেই সব বঞ্চিত, লাঞ্ছিত, লাঞ্ছিত মানুষ; জাগুক এক দৃঢ় আশা—যা সংবিধানের আলোয় সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করবে। কিন্তু একই সঙ্গে আমাকে সতর্কও থাকতে হয়—বিপ্লবের কথা বললে কোনোভাবে হিংসা, অরাজকতা বা আইনভঙ্গকে উৎসাহিত করা আমার উদ্দেশ্য নয়। এই আন্দোলন যদি হয়, তবে সেটা হিংসাহীন, আইনি এবং গণতান্ত্রিক পথে হবে—কারণ সহিংসতা নয়, ন্যায় ও আইনের বিজয়ই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। বর্তমান পরিস্থিতির মূলে যে সমস্যা—তারা একাধিক: দুর্নীতির অতৃপ্তি, সরকারি দপ্তরে আর্থিক অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যবহার, মিডিয়ার উপর চাপ এবং তরুণ প্রজন্মের সামনে সীমিত রোজগার—এসব মিলিয়ে সমাজে এক গভীর অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। সিন্ডিকেটেরা সুযোগ বুঝে দেশের সম্পদ লুটে নিচ্ছে; সুবিধাভোগীরা জনগণের স্বপ্নকে দ্রবীভূত করছে। এর প্রতিবাদে তরুণেরা রাস্তায় নামছে—তারা যে শুধু রাগ দেখাচ্ছে না, তারা দাবি তুলছে ন্যায়বিচার, সুযোগ-অধিকার ও মর্যাদার। এই দাবিগুলো যদি রাষ্ট্র ও সমাজ গ্রহণ না করে, তবে নিশ্চিত ভাবেই হতাশা বাড়বে এবং বিভক্তি গভীরতোর দিকে যাবে। কিন্তু সঠিক পথ কোনটি? আমার বিশ্বাশ: পরিবর্তন হবে সংহত পরিকল্পনা, প্রমাণভিত্তিক অভিযোজনে এবং আইনের মাধ্যমে। তাই বিস্তারিতভাবে কয়েকটি বাস্তব পদক্ষেপ প্রস্তাব করছি—যেগুলো দিয়ে আমরা ধীরে ধীরে দেশের ন্যায়বিচার ব্যবস্থা পুনর্গঠন করতে পারি:
১) স্বচ্ছ ও স্বাধীন তদন্ত-সংস্থা গঠন: দুর্নীতির মামলাগুলোর জন্য রাজনীতিকভাবে নিরপেক্ষ, স্বায়ত্তশাসিত তদন্তবিধি জরুরি। একটি প্রকৃত স্বাধীন তদন্ত-ফোরাম যা রাজনৈতিক চাপ থেকে মুক্ত থাকবে, যদি গঠন করা যায়—অবৈধ সম্পদ উন্মোচন, জালিয়াতি ও সিন্ডিকেট-হরিণিয়ার বিরুদ্ধে তা কার্যকর হাতিয়ার হবে। ২) সরকারি নিয়োগে স্বচ্ছতা ও দক্ষতা: সরকারি চাকরিতে স্বচ্ছ প্রতিযোগিতামূলক নিয়োগ, বিজ্ঞপ্তি-প্রক্রিয়ার হস্তক্ষেপ রোধ, ও নিয়োগে জনগণের আস্থা ফেরাতে হবে। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অডিট ও জনগণের অংশগ্রহণ বাড়ালে সিন্ডিকেটের পথ বন্ধ হবে।
৩) সাংবাদিক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা: তথ্য মানুষের অধিকার। স্বাধীন সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা না থাকলে অপকর্ম আড়াল হয়ে যায়। সাংবাদিকদের উপর চাপ বা মামলা-নিপীড়ন বন্ধ রাখতে আইনি সুরক্ষা প্রদান জরুরি। জনগণ যাতে নির্ভয়ে জানতে পারে—তাই তথ্যের প্রবাহ স্বচ্ছ রাখতে হবে।
৪) অর্থনৈতিক নীতিতে পুনর্গঠন: ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগকে উৎসাহিত করে চাকরি সৃষ্টি, কর-সার্বিকতা ও সরকারি খরচে স্বচ্ছতা—এসবই সাধারণ মানুষের জীবনে সরাসরি প্রভাব ফেলে। সিন্ডিকেট যে পথ ধরে লুটপাট করে, সেখান থেকেই রাজস্ব পুনরুদ্ধার করে সামাজিক সেবায় বিনিয়োগ করতে হবে।
৫) ছাত্র-যুব নেতৃত্বকে সংগঠিত ও রাজনৈতিক শিক্ষা প্রদান: ছাত্ররা আন্দোলনের মূল শক্তি; কিন্তু তাদেরকে সংগঠিত, সহনশীল ও নেতৃত্বগুণে পরিণত করা দরকার—আইনগত পথ, নৈতিকতা ও গণতন্ত্রের শিক্ষা দিয়ে তাদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা জরুরি।
৬) সামাজিক ঐক্য ও স্থানীয় কর্মশালা: গ্রামীণ ও শহর উভয়খানে ঐক্য গড়ে তোলা এবং স্থানীয় সমস্যার সমাধানে কমিউনিটি-ভিত্তিক কর্মশালা পরিচালনা করলে জনগণের আস্থা ফিরবে। জনগণকেই যদি বাস্তবভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া যায়, তাহলেই তারা স্ব-সংরক্ষণে আগ্রহী হবে।
এই পথগুলো বাস্তবায়নে কঠোর রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন—কেবল বক্তৃতা নয়, কার্যকর কর্মপরিকল্পনা, নিরপেক্ষ বিচারবিভাগ ও সক্রিয় নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণ। আমাদেরকে বুঝতে হবে—কোনো এক ব্যক্তিকে অপসারণ করে বাকিরা প্রতিস্থাপন করলে মূল সমস্যাগুলো সরে যায় না; সমস্যার মূলে থাকা অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থাই সংস্কার করতে হবে। নীতিগত পরিবর্তন ছাড়া কোনো সংক্ষিপ্ত সাফল্য টেকসই হবে না।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক—আমাদের প্রশ্ন করা প্রয়োজন: এই লড়াই কাকে লক্ষ্য করে? আমার মনে হয় ‘লুটেরা’ ও ‘মাফিয়া’ শব্দগুলোকে কেবল আইনগত অভিযোগ ও প্রমাণের আলোকেই সামনে আনতে হবে। জনসাধারণের হতাশা ও ক্ষোভকে যদি আমরা ব্যক্তিগত প্রতিহিংসায় পরিণত করি, তবে আমরা সিস্টেমিক সমস্যার পরিবর্তে ব্যক্তিনির্ভর প্রতিশোধে লিপ্ত হব। তাই তদন্ত-প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও স্বাধীন হলে, অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাদের অবৈধ সম্পদ জব্দ করা এবং সমাজে ফের বিতরণ করার নীতি গ্রহণ করাই উচ্চতর ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে।
আমি বিশ্বাস করি—কথা বলার ক্ষমতা, কলমের শক্তি, ও মানবিক ঐক্য দিয়ে আমরা বড় পরিবর্তন আনতে পারি। আপনাদের, আমাদের—সকলের দায়িত্ব একসাথে কাজ করে গণতান্ত্রিক পথ ধরে সমাজকে পুনর্গঠন করা। রাষ্ট্রযন্ত্র, বিচারবিভাগ, সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজ যখন একত্রে কাজ করবে, তখনই অল্প অস্থায়ী লিপ্ততা কাটিয়ে আমরা সেই সোনালী দিনের স্বপ্ন পূরণ করতে পারব—যা ১৯৭১- ও ২৪শে জুলাই আন্দোলন
এর আত্মত্যাগের সঠিক প্রতিদান হবে।
শেষে বলি—এই লড়াই হবে রাগের নয়, ন্যায়ের; হিংসার নয়, আইনের; বিভাজনের নয়, ঐক্যের। ইতিবাচক, শৃঙ্খলাবদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনই আমাদের দেশকে সত্যিকারভাবে মুক্ত করবে—মুখের স্বাধীনতাও ফিরিয়ে দেবে, মানুষের হৃদয়ে আত্মবিশ্বাসও। এ ভূমিকা পালন করতে কলম চালিয়ে যাব, সত্য বলব, আর নাগরিকদের ঐক্যের আহ্বান জানাব—এই প্রত্যয়ের সঙ্গে।
সবিশেষ শ্রদ্ধা ও দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে, লেখাটি শেষ করছি।
লেখকঃ সাংবাদিক গবেষক টেলিভিশন উপস্থাপক।