“নজর মোহাম্মদ গোষ্ঠীর আদি ইতিহাস:চরণদ্বীপের জমিদার বংশের উত্তরাধিকার-১
ইতিহাস শুধু কাগজে-কলমে লেখা কিছু তথ্য নয়; এটি শেকড়, পরিচয় ও ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি। আমি, একজন গবেষক ও লেখক হিসেবে, দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রামের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করছি। বিশেষ করে বোয়ালখালী থানার ইতিহাস, এবং তার ভেতরে চরণদ্বীপ ইউনিয়নের অতীত আমাকে গভীরভাবে আকর্ষণ করে।
চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার চরণদ্বীপ ইউনিয়নের নামকরণের পেছনে একটি আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য ও জনশ্রুতি রয়েছে। স্থানীয় ইতিহাস অনুযায়ী, হযরত বু-আলী কালন্দর শাহ (রহ.) বোয়ালখালী অঞ্চলে আগমনের সময় নদীপথে চরণদ্বীপে তাঁর পবিত্র চরণ রেখেছিলেন। এ কারণে এই স্থানের নাম ‘চরণদ্বীপ’ রাখা হয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। এটি একটি আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য হিসেবে স্থানীয় জনগণের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে, যা চরণদ্বীপ ইউনিয়নের নামকরণের পেছনের কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে, এই নামকরণের সঠিক সময়কাল বা ঐতিহাসিক দলিলসমূহের অভাব রয়েছে। তথ্য সংগ্রহের জন্য স্থানীয় ইতিহাসবিদ বা ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে।
কারণ এই চরণদ্বীপেই আমাদের বংশের আদি পুরুষ, জমিদার নজর মোহাম্মদ খাঁ তাঁর উত্তরাধিকার সূত্রে যে ঐতিহ্যের সূচনা করেছিলেন, তা আজও টিকে আছে আমাদের পরিবারের স্মৃতি ও সমাজের সংস্কৃতিতে।
এই লেখায় আমি চেষ্টা করব নজর মোহাম্মদ গোষ্ঠীর আদি ইতিহাস, তাঁর অবদান, পারিবারিক কবরস্থান, জমিদারি ও তালুকদারির ধারা এবং পতনের পটভূমি একটি পূর্ণাঙ্গ আকারে তুলে ধরতে। জমিদার নজর মোহাম্মদ খাঁ ও তাঁর ঐতিহাসিক প্রভাব-স্থানীয় ইতিহাস অনুযায়ী, নজর মোহাম্মদ খাঁ ছিলেন একজন জমিদার। তিনি জীবদ্দশায় ধর্মীয়, সামাজিক এবং প্রশাসনিক ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। তাঁর মৃত্যু হয় ১৬৯৪ খ্রিস্টাব্দে। মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরসূরি পুত্র মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন (ফুল গাড়ী খাঁ) ১৬৯৫ সালে চরণদ্বীপে বসতি স্থাপন করেন। এই বসতি স্থাপন শুধু একটি পরিবারের
নয়, বরং একটি গোষ্ঠীর দীর্ঘ ইতিহাসের সূচনা।
ফরিদ উদ্দিন ছিলেন ধার্মিক, ন্যায়পরায়ণ এবং সমাজসেবী। তিনি “ফকির মুহাম্মদ” নামেও পরিচিত ছিলেন তাঁর অনুসারীদের কাছে। তিনি ধর্মীয় মূল্যবোধ, সামাজিক শৃঙ্খলা এবং স্থানীয় প্রশাসনের উন্নয়নে অবদান রাখেন। তাঁর নেতৃত্বে চরণদ্বীপে একটি স্থায়ী সমাজ কাঠামো তৈরি হয়, যা আজও আমাদের পরিচয়ের অংশ। জমিদার নজর মোহাম্মদ খাঁ সম্ভবত পারস্য (বর্তমান ইরান) অঞ্চলের কোনো নবাব বা প্রশাসনিক বংশ থেকে বংশগতভাবে এসেছিলেন, অর্থাৎ তিনি বিদেশি (পার্সিয়ান) বংশোদ্ভূত। নিম্নে বিস্তারিত তুলে ধরা হলো: নজর মোহাম্মদ খাঁ—দেশীয় নন; পার্সিয়ান (পারস্য) বংশ তথ্যসূত্র অনুযায়ী, নজর মোহাম্মদ খাঁ ছিলেন একজন সপ্তদশ শতকের এক গুরুত্বপূর্ণ জমিদার, যাঁর বংশে পরবর্তী সময়ে মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন (ফুল গাড়ী খাঁ) চরণদ্বীপে বসতি শুরু করেন। পুরনো বংশানুক্রমিক রেকর্ড অনুযায়ী, নজর মোহাম্মদ খাঁ নবাব শায়েস্তা খাঁ থেকে জমিদারির অংশ প্রাপ্ত হন ([turn0search0])।”অনুসারে, “নবাব” উপাধি সাধারণত মোঘল প্রশাসনিক বংশ বা পার্সিয়ান প্রভাবিত রাজা/শাসকদের নিকট পরিচিত, যারা পূর্বে ইরান বা পারস্য অঞ্চল থেকে আসা বংশে সম্পর্কিত হতে পারে।
তাই এই প্রেক্ষাপট থেকে অনুমেয়:নজর মোহাম্মদ খাঁ দেশীয় বাঙালি না, বরং পারস্যজ ধর্মীয়/রাজনৈতিক বংশ থেকে আসা।তিনি নবাব শায়েস্তা খাঁ-এর সাথে সম্পর্কিত, যিনি দূত বা শাসক হিসেবে পার্সিয়ান বংশ থেকে চট্টগ্রামে এসেছিলেন। সারমর্ম:-বিষয়তথ্যকোথা থেকে এসেছিলেন?পার্স্য বা পার্সিয়ান বংশ (ইরানীয়/মোগল-যুগের প্রশাসনিক বংশ) থেকে আসা সম্ভাবনা রয়েছে।উল্লেখযোগ্য প্রমাণ তিনি “নবাব শায়েস্তার” অধীনে জমিদারি পেয়েছিলেন—যিনি পার্সিয়ান/মোগল প্রশাসকের পরিচিতি বহন করেন। এই তথ্যটি স্থানীয় ঐতিহাসিক গবেষণার মৌখিক বা দলিলভিত্তিক তথ্য নিয়ে যাচাই করা যেতে পারে—যথা জমিদারির নথিপত্র, পারিবারিক দলিল বা খতিয়ানে বংশসূত্র উল্লেখ থাকলে। আপনি চাইলে, আমি এ বিষয়ে আরও গভীর অনুসন্ধানে সহায়তা করতে প্রস্তুত আছি।পারিবারিক কবরস্থান: ইতিহাসের সাক্ষী-নজর মোহাম্মদ গোষ্ঠীর পারিবারিক কবরস্থান প্রায় তিন শতাব্দী পুরোনো। এটি কেবল সমাধিস্থল নয়; এটি আমাদের শেকড়, আমাদের আদি ইতিহাসের দৃশ্যমান নিদর্শন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই কবরস্থান আমাদের পরিবারকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে আমরা এক জমিদার বংশের উত্তরসূরি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই কবরস্থান নিয়ে সংকট দেখা দেয়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এর একটি অংশকে “সরকারি খাস জমি” হিসেবে দেখানো হয় এবং রাস্তা নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। এতে ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব হারানোর আশঙ্কায় গোষ্ঠীর সদস্যরা আদালতে মামলা করেন। এ ঘটনা প্রমাণ করে যে কবরস্থান শুধু ধর্মীয় নয়, সামাজিক ও ঐতিহাসিক প্রতীকেরও ধারক। জমিদারি ও তালুকদারি উপাধি- নজর মোহাম্মদ গোষ্ঠীর জমিদারি পরিচয়ের সাথে পরবর্তী সময়ে যুক্ত হয় তালুকদারি উপাধি। ইতিহাস বলছে, কোনো এক সময়ে ব্রিটিশ শাসকরা আমাদের পরিবারকে “তালুকদার” উপাধি প্রদান করেছিল। তালুকদার মানে জমিদার বা ভূমির মালিক। এই উপাধি ছিল মর্যাদা ও ক্ষমতার প্রতীক। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কর্ণফুলী নদীর ভাঙনে আমাদের পূর্বপুরুষদের অনেক জমি-জমা নদীতে বিলীন হয়ে যায়। ফলে জমিদারির সম্পদ ধীরে ধীরে হ্রাস পায়। জমি হারানোর সঙ্গে সঙ্গে তালুকদার উপাধিও ব্যবহার করা বন্ধ হয়ে যায়। তবুও ইতিহাসে আমরা সেই জমিদার-তালুকদার পরিবারের উত্তরসূরি হিসেবেই পরিচিত। চরণদ্বীপ: ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট- চরণদ্বীপ ইউনিয়ন অবস্থিত বোয়ালখালী উপজেলার উত্তর প্রান্তে, কর্ণফুলী নদীর তীরে। পূর্বে শ্রীপুর-খরনদ্বীপ, দক্ষিণে পোপাদিয়া ও কধুরখীল, পশ্চিমে কধুরখীল এবং উত্তরে কর্ণফুলী নদী পার হয়ে রাউজান। এই ভৌগোলিক অবস্থান চরণদ্বীপকে একটি গুরুত্বপূর্ণ জনপদে পরিণত করেছে। কর্ণফুলীর পাড়ের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি, নদীপথের যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং স্থানীয় হাটবাজার কেন্দ্রিক সংস্কৃতি চরণদ্বীপকে একটি ঐতিহাসিক কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। এখানেই নজর মোহাম্মদ গোষ্ঠী জমিদারি ও সামাজিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
সমাজ ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা- নজর মোহাম্মদ গোষ্ঠীর ইতিহাস শুধু জমিদারি বা উপাধি নিয়ে সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি সামাজিক ইতিহাস। কৃষি, নদীভিত্তিক অর্থনীতি, স্থানীয় হাটবাজার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান—সব মিলিয়ে একটি সমাজ কাঠামো তৈরি হয়েছিল, যার ধারাবাহিকতা আজও বিদ্যমান। বোয়ালখালী থানার গঠন হয় ১৯১০ সালে এবং এটি উপজেলা হিসেবে স্বীকৃতি পায় ১৯৮৩ সালে। এই প্রশাসনিক উন্নয়নের ধাপগুলোতেও নজর মোহাম্মদ গোষ্ঠীর বংশধররা ভূমিকা রেখেছেন, যা সমাজে তাঁদের প্রভাবের সাক্ষ্য বহন করে।জমিদারির পতন ও নতুন বাস্তবতা- সময়ের সাথে সাথে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়। কর্ণফুলী নদীর ভাঙন আমাদের পরিবারের জমিদারি সম্পত্তি ধ্বংস করে দেয়। জমিদারির ঐশ্বর্য হারিয়ে গেলেও আমাদের ইতিহাস মুছে যায়নি। আজ আমরা হয়তো জমিদার নই, তালুকদারও নই, কিন্তু আমরা সেই গৌরবময় ইতিহাসের উত্তরসূরি। এটি আমাদের জন্য শুধু গর্ব নয়, দায়িত্বও। কারণ ইতিহাসকে সংরক্ষণ করা মানে শিকড়কে রক্ষা করা। নজর মোহাম্মদ গোষ্ঠীর ইতিহাস তিন শতাব্দীরও বেশি সময়ের এক জীবন্ত দলিল। জমিদারি, তালুকদারি, পারিবারিক কবরস্থান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক নেতৃত্ব—সব মিলিয়ে এই ইতিহাস শুধু একটি পরিবারের নয়, চরণদ্বীপের সমাজ ও সংস্কৃতিরও ইতিহাস।
আজ কর্ণফুলী নদী হয়তো আমাদের জমি কেড়ে নিয়েছে, সময় হয়তো আমাদের উপাধি মুছে দিয়েছে, কিন্তু আমাদের ইতিহাস এখনও জীবন্ত। আমরা উত্তরসূরিরা সেই ইতিহাসের ধারক ও বাহক। লেখক, গবেষক ও সাংবাদিক হিসেবে আমার দায়িত্ব হলো এই ইতিহাসকে প্রজন্মান্তরে পৌঁছে দেওয়া—যাতে আমাদের শেকড় কখনো বিস্মৃত না হয়। আমি নজর মোহাম্মদ গোষ্ঠীর আদি ইতিহাস নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ ও গবেষণামূলক লেখা প্রস্তুত করেছি।
তবে-অন্য এক ইতিহাসের দেখা যায়-চরণদ্বীপ দরবার শরীফ, চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার চরণদ্বীপ গ্রামে অবস্থিত একটি ঐতিহ্যবাহী সুফি দরবার। এর নামকরণ ও প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে গভীর আধ্যাত্মিক ও ঐতিহাসিক তাৎপর্য। নামকরণের ইতিহাস গ্রামের নাম ‘চরণদ্বীপ’ হওয়ার পেছনে একটি আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা রয়েছে। ধারণা করা হয়, হযরত মাওলানা শাহ চরণদ্বীপি (ক.)-এর আগমনের পূর্বেই এই গ্রামটির নাম ‘চরণদ্বীপ’ রাখা হয়েছিল। এটি এমন একটি স্থান হিসেবে চিহ্নিত ছিল যেখানে আধ্যাত্মিক সাধনা ও অলির আগমন ঘটেছিল। উল্লেখযোগ্যভাবে, ষোড়শ শতাব্দীতে শাহসুফি আলাউদ্দিন ফকির ও শাহসুফি জামাল উদ্দিন ফকির (প্রকাশ জঙ্গলী পীর) এই অঞ্চলে এসেছিলেন এবং আধ্যাত্মিক সাধনা করতেন। তাঁদের আগমনে এই স্থানটি আধ্যাত্মিক গুরুত্ব লাভ করে।
চলবে–