আব্দুল লতিফ ছিদ্দিকীর মন্তব্য ও মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা সংকট: আজকের শিক্ষা”
বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। সেই মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের রক্ত আর অগণিত বীর মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগে আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা নামের এই মহান অর্জন। যারা নিজের জীবন বাজি রেখে যুদ্ধক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, যারা মৃত্যুকে উপেক্ষা করে রক্ষা করেছিলেন আমাদের মা-বোনের সম্মান, তারা নিঃসন্দেহে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। অথচ আজ, স্বাধীনতার পাঁচ দশক পেরিয়ে এসে, সেই মুক্তিযোদ্ধাদেরই বারবার অপমানিত ও লাঞ্ছিত হতে দেখা যায়। এটি কেবল দুঃখজনক নয়, জাতির জন্য কলঙ্কজনকও বটে।
আজকের এই লেখাটি তাই কোনো রাজনৈতিক বিবেচনা নয়, বরং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে, এবং তাদের অপমানের ঘটনাকে একটি জাতীয় বেদনা হিসেবে আখ্যায়িত করেই লিখতে বসেছি। কারণ, মুক্তিযোদ্ধারা অপমানিত হলে তা শুধু একজন মানুষের নয়, পুরো জাতির সম্মানের অবমাননা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস আমাদের জাতীয় পরিচয়ের সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধ, শহীদের রক্ত আর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা আজও আমাদের আত্মমর্যাদার মূলভিত্তি। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, সেই মুক্তিযোদ্ধাদেরই বারবার অপমানিত হতে দেখা যায় স্বাধীন দেশের ভেতরেই। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, স্বাধীনতার জন্য বুকের রক্ত ঢেলে দেওয়া যোদ্ধারাও আজ নিরাপত্তাহীনতা ও লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছেন। এই দৃশ্য নিঃসন্দেহে জাতির জন্য এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। এমন প্রেক্ষাপটে হঠাৎই মনে পড়ে যায় ২০১৪ সালের এক ঘটনার কথা। সেই বছর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হিসেবে গিয়েছিলেন তৎকালীন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী আব্দুল লতিফ ছিদ্দিকী। সফরের সময় প্রবাসী বাংলাদেশিদের একটি অনুষ্ঠানে তিনি যে বক্তব্য দেন, তা মুহূর্তেই দেশের ভেতরে-বাইরে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
বিতর্কিত মন্তব্য- নিউইয়র্কের সেই অনুষ্ঠানে আব্দুল লতিফ ছিদ্দিকী প্রকাশ্যে বলেন—হজ “মানুষের সময় ও শ্রমের অপচয়”। তার দাবি ছিল, প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ হজে গিয়ে দেশের অর্থনীতিতে কোনো উৎপাদনশীল ভূমিকা রাখে না; বরং খাওয়া-দাওয়া করে অর্থ অপচয় করে। এখানেই থেমে থাকেননি তিনি; সমালোচনা করেন তাবলিগ জামাতকেও, যাকে তিনি “রাস্তাঘাট জ্যামের কারণ” বলে অভিহিত করেন। একজন মন্ত্রী হিসেবে, বিশেষ করে মুসলিম প্রধান একটি দেশে থেকে এ ধরনের বক্তব্য কেবলমাত্র বিতর্কিতই নয়, ধর্মপ্রাণ মানুষের জন্য ছিল অপমানজনক ও আঘাতজনক। মুহূর্তেই দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
প্রতিক্রিয়া-বাংলাদেশের বিভিন্ন ইসলামি সংগঠন, বিশেষ করে হেফাজতে ইসলাম, সরব হয়। তারা আব্দুল লতিফ ছিদ্দিকীকে “অবিশ্বাসী” ঘোষণা করে এবং তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি তোলে। সারাদেশে আন্দোলন শুরু হয়। মসজিদ-মাদ্রাসা থেকে শুরু করে সাধারণ মুসল্লিদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ দেখা দেয়।
ধর্মপ্রাণ জনগণের চাপ ও রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হন। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৪-এ তাকে মন্ত্রিসভা থেকে বরখাস্ত করা হয়। মন্ত্রিত্ব হারানোর পরও তার নিরাপত্তা প্রশ্নে তৈরি হয় জটিলতা। পরিণতি-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফেরার পরিবর্তে তিনি সরাসরি ভারত যান। দীর্ঘদিন তিনি দেশে ফেরার সাহস পাননি। অবশেষে কলকাতা হয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং ২০১৪ সালের ২৭ নভেম্বর আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। এরপর প্রায় সাত মাস কারাভোগের পর জামিনে মুক্তি পান।
এই ঘটনাটি শুধু একটি বিতর্কিত মন্তব্য বা একজন মন্ত্রীর পতনের ঘটনা নয়; বরং এটি দেখিয়ে দেয়, ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি অবমাননা এই দেশে কতটা তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। আল্লাহর বিচার-
ধর্মবিশ্বাসীদের কাছে বিষয়টি কেবল রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রতিক্রিয়ায় সীমাবদ্ধ ছিল না। তারা এটিকে দেখেছিলেন আল্লাহর বিধান ও ইসলামের অবমাননা হিসেবে। সেই সময় যারা আন্দোলনে নামেন, তারা বলেছিলেন—আল্লাহর কাছে এই অন্যায়ের বিচার হবেই।
আজ যখন দেখা যায়, আব্দুল লতিফ ছিদ্দিকী নিজেও জীবনের শেষ অধ্যায়ে নানা অপমান ও কষ্টের মুখোমুখি হয়েছেন, তখন অনেকেই একে আল্লাহর দুনিয়াবি বিচার হিসেবে দেখছেন। ইতিহাস হয়তো এর চূড়ান্ত রায় লিখবে, তবে সত্য হলো—একটি মন্তব্য তাকে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান প্রশ্নে-এখানে একটি বেদনাদায়ক তুলনা উঠে আসে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলেন, ধর্ম ও দেশের সম্মান রক্ষার জন্য। আজ সেই মুক্তিযোদ্ধাদের অপমানিত হতে হয় স্বাধীন দেশের ভেতরেই। আব্দুল লতিফ ছিদ্দিকীর মতো একজন মুক্তিযোদ্ধা—যিনি একসময় এই দেশ গঠনে ভূমিকা রেখেছিলেন—যখন ধর্ম সম্পর্কে এমন মন্তব্য করে বিতর্কিত হন, তখন তার প্রতি ঘৃণা জন্মায়। কিন্তু একইসঙ্গে আজ যখন দেখি অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের লাঞ্ছিত করা হচ্ছে, তখন সেটিও সমানভাবে আমাদের বিবেককে আহত করে। কারণ, তারা যে ভুল করেছেন বা বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন, তা সত্যি হোক বা মিথ্যা, আমাদের দায়িত্ব ছিল জাতির বীর সন্তানদের মর্যাদা রক্ষা করা।সাংবাদিকের নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি-একজন সাংবাদিক হিসেবে বিষয়টি দুই দিক থেকেই বিচার করতে হয়। একদিকে, আব্দুল লতিফ ছিদ্দিকীর মন্তব্য ছিল দায়িত্বজ্ঞানহীন, কষ্টদায়ক ও উসকানিমূলক। এর ফলে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়েছে, সামাজিকভাবেও তিনি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অন্যদিকে, আজ যে মুক্তিযোদ্ধাদের অপমানিত হতে দেখা যাচ্ছে, সেটিও সমানভাবে অন্যায়। তাদের সম্মান ভূলুণ্ঠিত হওয়া মানে পুরো জাতির সম্মান ভূলুণ্ঠিত হওয়া।
অতএব, ন্যায্য সমালোচনার জায়গায় সমালোচনা থাকতে হবে, কিন্তু ঘৃণা বা অপমান কোনোভাবেই কাম্য নয়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান সর্বদা অক্ষুণ্ণ রাখা আমাদের জাতিগত দায়িত্ব।
২০১৪ সালের সেই ঘটনাটি আমাদের জন্য একটি শিক্ষা হয়ে থাকা উচিত। দায়িত্বশীল কোনো পদে থেকে ধর্ম, সংস্কৃতি ও জনগণের আবেগকে অবমাননা করা কখনোই সমীচীন নয়। একইসঙ্গে, আমাদের মনে রাখতে হবে—যারা দেশের জন্য জীবন বাজি রেখেছেন, তাদের সম্মানহানি করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আব্দুল লতিফ ছিদ্দিকীর বিতর্কিত মন্তব্য যেমন আমাদের দেখিয়েছে কিভাবে একটি কথা একজন মানুষকে পতনের দিকে ঠেলে দিতে পারে, তেমনি সাম্প্রতিক সময়ের মুক্তিযোদ্ধা অপমানের ঘটনাগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়—জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের সম্মান রক্ষা না করলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। আল্লাহর কাছে সব ক্ষমতা নিহিত। তিনি দুনিয়াতেও বিচার করেন, আখেরাতেও করবেন। তবে মানুষের দায়িত্ব হলো ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা এবং যারা দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন তাদের সম্মান রক্ষা করা।
আব্দুল লতিফ ছিদ্দিকীর ২০১৪ সালের বিতর্কিত মন্তব্যের কারণে তিনি যে রাজনৈতিক ও সামাজিক পতনের মুখোমুখি হয়েছেন, সেটি আমাদের সবার জন্যই শিক্ষা। আর আজ যারা মুক্তিযোদ্ধাদের লাঞ্ছিত করছে, তাদের জন্যও এটি সতর্কবার্তা—কারণ ইতিহাস ও আল্লাহর বিচার থেকে কেউ রক্ষা পাবে না।