সব সম্ভবের এই বাংলাদেশে বসবাস করি আমরা। এই দেশে “অসম্ভব” শব্দটি অভিধানে থাকলেও বাস্তবে তার কোনো অস্তিত্ব নেই।চাইলেই ঘুষ সম্ভব, এক চা খেতে খেতে কোটি টাকা আত্মসাৎ সম্ভব, রাতারাতি দখল হয়ে যেতে পারে জমি, বিলীন হয়ে যেতে পারে নদী।অফিসে না গিয়েও মাসের বেতন তোলা সম্ভব, রোগীকে ওষুধ না দিয়েই “সেবা” দেওয়া সম্ভব।এমনকি, হাসপাতালের বিছানায় মৃত্যু ঘটানো যায় চিকিৎসার নামেও—এও সম্ভব।
নারী নির্যাতন, শিশু ধর্ষণ, চুক্তিভিত্তিক খুন, ডাকাতি, মাদক বেচাকেনা, মানব পাচার, ছিনতাই—এসবের কিছুই অসম্ভব নয়।সবকিছু সম্ভব।তাই, আজ আমি অসম্ভবকে নিয়ে কিছু রম্যকথা বলবো।
কারণ, আমাদের দেশে অসম্ভবও সম্ভব।এক ডাক্তার বাবু এক রোগীকে দুটো বড়ি দিলেন—একটা খেতে হবে ঘুম থেকে ওঠার আগে, আর আরেকটা পরে।রোগী বাড়ি গিয়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে ভাবছে,“ঘুম থেকে ওঠার আগে ওষুধ খাই কী করে? আমি তো তখন ঘুমিয়ে থাকি!”অসম্ভব!আরেক রোগী, তাঁর কাহিনি আরও দুর্দান্ত। ডাক্তার বাবু বলেছিলেন—সকালে ঘুম থেকে উঠে, হাত-মুখ ধুয়ে খালি পেটে বড়ি খেতে।পরদিন সকালেই রোগী গিয়ে হাজির,ডাক্তারবাবু তখনও বিছানায়।চোখ কচলাতে কচলাতে বেরিয়ে এলেন—রোগী বলল, “স্যার, আপনি যে বলেছিলেন দুটো বড়ি খালি পেটে খাব, আমি একটা খাওয়ার পর খেয়াল করলাম—এবার তো আর পেট খালি রইল না! দ্বিতীয়টা খালি পেটে খাওয়া কী করে সম্ভব?”
এই হলো আমাদের দেশের ওষুধবিজ্ঞান! এখানে খালি পেটেও ভরা! নেপোলিয়ন বলেছিলেন—“অসম্ভব শব্দটি শুধু মূর্খদের অভিধানে পাওয়া যায়।” মহাবীর নেপোলিয়ন হয়তো মূর্খ ছিলেন না,
কিন্তু তাঁর জীবনে বহু অসম্ভবই সম্ভব হয়নি—সে কথাও ইতিহাস জানে। আসলে, সবই সম্ভব, যতক্ষণ না আপনাকে সেটা নিজে করতে হচ্ছে। কারণ, দায়িত্ব অন্যের ঘাড়ে চাপালে অসম্ভব কিছুই থাকে না।
তবে হ্যাঁ, কাঁকড়া কি সোজা হয়ে হাঁটতে পারে? গ্রিক নাট্যকার অ্যারিস্টোফেনেস বলেছিলেন—না, পারে না। কারণ সেটা তার প্রকৃতির বাইরে। তাই বলি, যে যা পারে, তার পক্ষেই তাই সম্ভব।
আমি নিজে কামাল উদ্দিন, আমি “মো. কামাল উদ্দিন”র মতোই লিখি। বিশ্বসাহিত্যের বিখ্যাত লেখকদের মতো হয়তো আমার লেখা নয়, কিন্তু তারা কেউ আমার মতোও লিখতে পারবে না—এটাই আমার গর্ব।গল্প আরও আছে। একদিন সকালে দেখি, এক অল্পবয়সী ছেলেটা বিশাল কাগজের বোঝা মাথায় নিয়ে ছুটে চলেছে। ডেকে বললাম, “এই কাগজ টানতে কষ্ট হচ্ছে না?” ছেলেটি হেসে বলল,
“স্যার, আমার কষ্ট হবে কেন? আমি তো শুধু বিলি করি, পড়ি না!” এই দেশে শুধু খবর নয়—সত্য-মিথ্যা, নীতি-অনীতি, আইন-সংবিধান—সবই বিলি হয়। পড়ার প্রয়োজন পড়ে না। গাঁজা-সেবনের গল্পও আছে। এক গাঁজাখোর প্রতিদিন গাঁজার আড্ডা থেকে বাড়ি ফেরে রাস্তার এক পাশ থেকে আরেক পাশে পেরিয়ে। সেদিন নেশা এমন চড়েছিল, সে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে লোকে জিজ্ঞেস করছে,
“দাদা, রাস্তার ওপারটা কোনদিকে?” একজন এপাশে দেখায়, আরেকজন ওপাশে।
বেচারা সারারাত দাঁড়িয়ে থেকে বলে, “সবাই আমাকে পাগল বানিয়ে ছাড়ল, এই এপাশ-ওপাশ মিলিয়ে রাস্তা পেরোনোই অসম্ভব!” কিন্তু গাঁজা কাটলে, হয়তো সে ঠিকই বাড়ি ফিরে গিয়েছিল। সবশেষে বলি, এক ফরাসি বিবাহবিচ্ছেদের গল্প। স্ত্রী এক গোয়েন্দা উপন্যাস কিনে এনেছেন, অনেক খুঁজে, অনেক উৎসাহে। স্বামী বজ্জাত! বইয়ের মলাটে লিখে রেখেছেন—“অপরাধী হচ্ছে রবার্ট।” সর্বনাশ! পুরো গল্পই স্পয়েল! স্ত্রী আদালতে মামলা ঠুকে দিয়েছেন—“গল্পের খুন করেছে এই লোক”। ফরাসি আদালত বিচারে বলেছে—এই সম্পর্ক আর সম্ভব নয়। ফলে, হলো বিবাহবিচ্ছেদ। এভাবেই, বিশ্বের বুকে ফ্রান্সে সম্ভব হয় অসম্ভব রায়। তবু বলি, আমাদের দেশে সত্যিই সব সম্ভব। আমরা উন্নয়ন করি, পরিকল্পনা করি, কথায় কথায় প্রতিশ্রুতি দিই—সব সম্ভব। সবচেয়ে বেশি সম্ভব হলো মিথ্যা বলা, আর মিথ্যা লেখা। কারণ, আমিও প্রতিদিন কাগজে অসম্ভবকে সম্ভব করি। লিখি, হাসি, কাঁদি—আর ভাবি, এই দেশ এক সম্ভবের জাদুঘর, আর আমরা হচ্ছি তার অসম্ভব বাসিন্দা।