জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনায় দুর্নীতিমুক্ত ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশের শপথ”
চট্টগ্রামে শহিদ পরিবার ও জুলাই যোদ্ধাদের সংবর্ধনায় প্রশাসন ও জনতার অঙ্গীকার”
চট্টগ্রামে ২০২৪ সালের ঐতিহাসিক ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’ দিবস উপলক্ষে ৫ আগস্ট মঙ্গলবার সকালে জেলা প্রশাসনের আয়োজনে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে শহিদ পরিবার ও আহত জুলাই যোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান এক অনন্য সংহতির দৃশ্যপট তুলে ধরে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. জিয়াউদ্দীন। তিনি বলেন, “জুলাই আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে—যখন জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়, তখন কোনো ষড়যন্ত্র টেকে না, কোনো অপশক্তি টিকে থাকতে পারে না।”
তিনি আরও বলেন, “জুলাই যোদ্ধারা বৈষম্যহীন ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের শপথ নিয়েছি। এটি একটি কঠিন যুদ্ধ, কিন্তু অসম্ভব নয়। আমাদের একার পক্ষে কিছুই সম্ভব নয়—এই যুদ্ধে আমাদের পাশে চাই আপনাদের, যাঁরা হৃদয়ে ধারণ করেন দেশপ্রেম, ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্রের চেতনা।”
পুষ্পস্তবক অর্পণ ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনী-অনুষ্ঠানের শুরুতে চট্টগ্রামের শহিদ শহীদুল ইসলাম ও মোহাম্মদ আলমের কবরস্থানে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসকসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা। পরে সার্কিট হাউস প্রাঙ্গণে শহিদ পরিবার ও আহত যোদ্ধাদের হাতে সম্মাননা স্মারক ও সরকার প্রদত্ত উপহার তুলে দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে ‘জুলাই অনির্বাণ ও দি আর্ট অব ডেমোক্রেসি’ শীর্ষক একটি চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হয়, যা উপস্থিতদের আবেগাপ্লুত করে তোলে।
প্রশাসনের প্রতিশ্রুতি ও সরকারের পদক্ষেপ-বিভাগীয় কমিশনার বলেন, “জুলাই মানে শুধু উৎসব নয়, আত্মমূল্যায়নের সময়। শহিদ ও আহত যোদ্ধাদের যথাযথ সম্মান জানাতে সরকার ইতোমধ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। যারা আহত হয়েছেন তাদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে, প্রয়োজনে পাঠানো হবে বিদেশে। নগদ সহায়তা, পুনর্বাসন ও তালিকাভুক্তির উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।”
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম তার বক্তব্যে জানান, “জুলাই শহিদদের কবর সংরক্ষণে মন্ত্রী পরিষদ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, শীঘ্রই তা বাস্তবায়ন হবে। এছাড়া শহিদদের স্মরণে জনবহুল এলাকায় একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হবে।”
তিনি আরও বলেন, “গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলনে শহিদদের আত্মত্যাগ জাতির অহংকার। তাঁদের স্মরণ করতে হবে কর্মে, নীতিতে ও সাহসে। বৈষম্যবিরোধী ও মানবিক রাষ্ট্র গড়ার জন্য জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনাকে ধারণ করতে হবে।” পুলিশ প্রশাসনের আত্মসমালোচনা ও আশাবাদ অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার হাসিব আজিজ বলেন, “জুলাই অভ্যুত্থান ছিল না কোনো রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে; এটি ছিল বৈষম্য, দুর্নীতি, নিপীড়নের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া।” তিনি জাতীয়তাবাদী শক্তির ঐক্যের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আহসান হাবীব পলাশ বলেন, “এই অভ্যুত্থানে পুলিশের ব্যর্থতা ছিল, যা আমাদের জন্য ব্যথার। কমিশন গঠনের মাধ্যমে এই ব্যর্থতার কারণ খুঁজে বের করা উচিত। আমরা বুঝি, পুলিশ জনগণের পাশে না থাকলে নিজেদের অস্তিত্বও বিপন্ন হয়।” তিনি আহ্বান জানান, “এই চেতনা ধরে রাখতে হবে—কিছু করতে হবে, লিখতে হবে, জানতে হবে। আপনারা যাঁরা লড়েছেন, এই দেশের ভবিষ্যৎ আপনাদের হাতেই।”‘ঐক্য’ রক্ষার আহ্বান ও সাইবার হুমকির বিষয়ে সতর্কতা জেলা পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সানতু বলেন, “জুলাই ঐক্য’ ভাঙার ষড়যন্ত্র চলছে। ফেসবুক ও ইউটিউবে কনটেন্ট ছড়িয়ে আপনাদের বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, এটি একটি সাইবার যুদ্ধের অংশ।” তিনি বলেন, “আপনারা যারা একসঙ্গে যুদ্ধ করেছেন, একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছেন, আপনাদের ঐক্যই শক্তি। শত্রুরা প্রস্তুত হচ্ছে ফিরে আসার জন্য। আমাদের সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।” গণতান্ত্রিক দল ও নাগরিক সমাজের উপস্থিতি অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আহমেদুল আলম চৌধুরী, জামায়াতে ইসলামীর নগর সেক্রেটারি অধ্যক্ষ নুরুল আমিন, ইসলামী আন্দোলনের সভাপতি জান্নাতুল ইসলাম, খেলাফত মজলিশের মাওলানা খুরমিদ আলম, আমার বাংলাদেশ পার্টির এডভোকেট গোলাম ফারুক প্রমুখ। আহত যোদ্ধারা—আরিফ উদ্দিন রুবেল, আরিফুল ইসলাম, ওমর ফারুক সাগর এবং আন্দোলনের সমন্বয়কারীরা—মোহাম্মদ রাকিব, রিদোয়ান সিদ্দিকী, মোহাম্মদ আলী ও ফাতেমা খানম লিজা, বক্তব্যে বলেন, “আমরা রক্ত দিয়েছি, জীবন দিয়েছি, আর কিছু চাই না—শুধু চাই, এই আন্দোলনের চেতনা যেন বিকৃত না হয়।” এই অনুষ্ঠান শুধু একটি স্মরণসভা ছিল না; এটি ছিল দেশের ভবিষ্যৎ গঠনে এক জাগরণী আহ্বান। বৈষম্যহীন, মানবিক, দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশের প্রত্যাশায় প্রশাসন, রাজনীতি ও নাগরিক সমাজ যে একমঞ্চে এসেছে, তা এক নতুন সম্ভাবনার দিকচিহ্ন।
এই চেতনা অমলিন থাকুক—জুলাই অভ্যুত্থান শুধু ইতিহাস না হয়ে হয়ে উঠুক চলমান সংগ্রামের চিরন্তন অনুপ্রেরণা।