খোলা চিঠি–
মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা মহোদয় ড. মুহাম্মদ ইউনুস ( নোবেলজয়ী) অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান
বিষয়: আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, প্রশাসনের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ ও দলমুক্ত, নিরপেক্ষ রাষ্ট্র পরিচালনার প্রেক্ষাপটে জনগণের পক্ষ থেকে আবেদন।
মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা মহোদয়,
শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন,
আপনার নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ের ইতিহাস লিখছে। এক সময়কার হতাশাগ্রস্ত ও আতঙ্কগ্রস্ত এই জাতি আজ নতুন করে আশার আলো দেখতে পেয়েছে, কারণ রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রে এখন রয়েছেন আপনি—একজন বিশ্বস্বীকৃত নৈতিক নেতৃত্বের প্রতীক, মানবতার পথিকৃত, এবং একজন ব্যতিক্রমধর্মী চিন্তাবিদ।
আপনার প্রতি মানুষের এই আস্থা কেবল আপনার নোবেল পুরস্কারজয়ী পরিচয়ের কারণে নয়, বরং দীর্ঘদিন ধরে আপনি যে আদর্শিক ও নৈতিক অবস্থান গ্রহণ করে এসেছেন, সেই কারণে। দুর্নীতি, দলীয়করণ, প্রতিহিংসার রাজনীতি, এবং ক্ষমতার অপব্যবহারে জর্জরিত বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় আপনি হচ্ছেন নিরপেক্ষতার প্রতীক, যিনি কখনও ক্ষমতার লোভে রাজনীতি করেননি, বরং মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে কাজ করে গেছেন।
এখন আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটেছে। দেশের সর্বত্র এক ধরনের অস্থিরতা ও নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছে। সাধারণ মানুষ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে—বাড়ি থেকে বেরিয়ে কেউ নিশ্চিত নয়, নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারবে কিনা। সমাজে অরাজকতা ছড়িয়ে পড়েছে, যার ভয়াবহ বহিঃপ্রকাশ আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি মব জাস্টিসের মতো ভয়ানক প্রবণতায়। বিচারের পূর্বেই বিচার করে ফেলছে জনতা—এ যেন এক রক্তচক্ষুর অবাধ উৎসব। হত্যা, রাহাজানি, চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতন, ধর্ষণসহ প্রায় সকল ধরনের অপরাধ ভয়াবহ হারে বেড়েই চলেছে।
যেকোনো সময়, যেকোনো স্থানে, যে কারও উপর নেমে আসতে পারে সহিংসতার কালো ছায়া। সড়কে, বাজারে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, এমনকি নিজ বাড়িতেও মানুষ আজ নিরাপদ নয়। সামাজিক অস্থিরতা, রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা—সবকিছু মিলে জনজীবনে চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি যেন এক ভয়ানক অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে।
এই ক্রান্তিকালে, মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস, আমরা আশাবাদী যে আপনার নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। এই চিঠি তাই কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নয়, বরং দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ রক্ষায় এক বিবেকবান নাগরিকের ব্যাকুল আর্তি—আশা করি আপনি তা বিবেচনায় নেবেন হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে তার অনুরোধ জানিয়ে আপনার বরাবরে
এই খোলা চিঠি লিখলাম –
মাননীয় মহোদয়,
বর্তমান সময়ে রাষ্ট্রপরিচালনায় একটি বিপজ্জনক প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে—তা হলো বহুমুখী রাজনৈতিক চাপ ও প্রভাব। একদিকে বিএনপি মনে করছে তারা আগামীর শাসক দল, তাই প্রশাসন যেন তাদের ইচ্ছানুযায়ী চলে। তারা গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালা হয়ে পুলিশ, প্রশাসন এমনকি বিচারব্যবস্থাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চায়।
অন্যদিকে এনসিপি মনে করছে, আন্দোলনের সফল ফল হিসেবে এই সরকার গঠিত হয়েছে। তাই সরকারের ওপর তাদের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব থাকবে—এমন মনোভাব নিয়েই তারা সরকারি নীতিনির্ধারণে প্রভাব ফেলতে চাইছে। আবার জামায়াতে ইসলামীও তারা চায় সরকারের সিদ্ধান্ত তাদের মতাদর্শ অনুসরণ করুক।
এই ত্রিমুখী চাপের মধ্যে পড়ে প্রশাসন কার্যত বিভ্রান্ত। পুলিশ সদস্যরা আইনানুগভাবে কাজ করতে গিয়ে দ্বিধায় পড়ে যাচ্ছে—কোন নির্দেশ মানবে, কাকে অনুসরণ করবে? এই পরিস্থিতি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে শিথিল করছে এবং অপরাধীদের সাহস বাড়াচ্ছে। অপরাধী যে দলেরই হোক না কেন, তাদের গ্রেপ্তার কিংবা শাস্তির ক্ষেত্রে বিভাজন লক্ষ্য করা যাচ্ছে—এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।
মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা,
প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেন রাজনৈতিক ছায়া থেকে বের হয়ে সত্যিকার অর্থে জনগণের সেবক হতে পারে—সেজন্য প্রয়োজন আপনার দৃঢ় অবস্থান। পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, সেনাবাহিনী—এই সব বাহিনীকে সাহস ও মনোবল দিয়ে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ দিতে হবে।
পুলিশ বাহিনীর মনোবল আজ প্রশ্নের সম্মুখীন, কারণ তারা বহুদিন ধরে দলীয় নির্দেশনার বাইরে চিন্তা করতে অভ্যস্ত হয়নি। এখন যখন একজন নিরপেক্ষ ও নৈতিক নেতৃত্ব রাষ্ট্রক্ষমতায়, তখনই তাদের নৈতিক সাহস ফিরে পাওয়ার উপযুক্ত সময়। আপনার পক্ষ থেকে একটি দৃঢ়, নিরপেক্ষ ও অনুপ্রেরণাদায়ী বার্তা তাদের মনোবল ফিরিয়ে আনতে পারে। অপরাধীর রাজনৈতিক পরিচয় নয়, তার অপরাধই যেন বিচারযোগ্য হয়ে ওঠে—এই বার্তা স্পষ্টভাবে জাতির সামনে তুলে ধরার সময় এখনই।
মাননীয় ইউনুস সাহেব,
এই দেশের সাধারণ মানুষ দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক বিভক্তি, দলীয় দখলদারিত্ব ও অনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারে ভুগেছে। মানুষ এখন দলমুক্ত, নিরপেক্ষ এবং জনবান্ধব প্রশাসন চায়। চায় এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থা, যেখানে রাজনৈতিক পরিচয় নয়, বরং নাগরিক পরিচয়ই মূল হবে। সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে দল নয়, নাগরিক অধিকারই মুখ্য হবে।
আপনার নেতৃত্বে গঠিত এই সরকার সেই আশার প্রতীক। আপনি হলেন সেই মানুষ, যাঁকে এই জাতি বিশ্বাস করে নিঃশর্তভাবে। অতীতে আপনি কখনও কোনো দলের ছায়ায় আশ্রয় নেননি। আপনি ছিলেন, এবং এখনও আছেন—মানবতার, ন্যায়বিচার ও উন্নয়নের পক্ষে। সেই অবস্থান থেকেই আপনার প্রতি আমাদের এই নিবেদন—
১. সকল রাজনৈতিক চাপ ও প্রভাবকে দৃঢ়ভাবে প্রতিহত করুন।
২. প্রশাসন ও পুলিশকে স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনের পরিবেশ তৈরি করুন।
৩. অপরাধীদের রাজনৈতিক পরিচয় দেখার সংস্কৃতি বন্ধ করুন—যে-ই হোক, অপরাধী মানেই শাস্তিযোগ্য।
৪. সেনাবাহিনী, র্যাব, বিজিবি সহ সকল বাহিনীকে আইন, সংবিধান ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে কাজ করার নির্দেশ দিন।
৫. দৃষ্টান্তমূলক কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে প্রশাসনের মনোবল ফিরিয়ে আনুন এবং জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করুন।
মাননীয় মহোদয়,
আপনি ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ের দায়িত্বে রয়েছেন। আপনি চাইলে এই দেশকে একটি সত্যিকার গণতান্ত্রিক, মানবিক ও সুবিচারভিত্তিক রাষ্ট্রে রূপান্তর করা সম্ভব। ভবিষ্যত প্রজন্ম যেন গর্ব করে বলতে পারে—এই দেশ একসময় ইউনুসের মতো একজন বিবেকবান মানুষের নেতৃত্বে একটি নতুন অধ্যায় শুরু করেছিল।
আপনার জন্য শ্রদ্ধা ও শুভকামনা রইল।
নিবেদক-
মো.কামাল উদ্দিন-
লেখক, সাংবাদিক, টেলিভিশন উপস্থাপন-
সদস্য – পেন ইন্টারন্যাশনাল।
মহাসচিব- চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরাম।