জনগণই প্রজাতন্ত্রের আসল স্যার: সরকারি চাকরিজীবীকে স্যার ডাকায় উপনিবেশিক মানসিকতা ও গণতন্ত্রের অসম্মান”–আজকের দিনটি এক সাহসী সিদ্ধান্তের দিন। আমাদের প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনুস আজ একটি মৌলিক ও মানবিক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন—সরকারি চাকরিজীবীদের ‘স্যার’ না ডাকতে বলা হয়েছে। এটা শুধু একটি ভাষাগত সংশোধন নয়, এটা একটি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। এখানে জনগণই রাষ্ট্রের মালিক, আর সরকারি কর্মচারীরা সেই মালিকের নিযুক্ত কর্মচারী। অথচ বাস্তব চিত্রটি সম্পূর্ণ বিপরীত—জনগণকে কর্মচারীদের সামনে ছোট হয়ে মাথা নত করে ‘স্যার’ বলতে হয়। এটি কেবল শব্দ নয়, এটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসা শ্রেণিবৈষম্যের ছাপ বহন করে।
‘স্যার’ একটি উপনিবেশিক সংস্কৃতির উত্তরাধিকার। ব্রিটিশ শাসনের আমলে ভারতীয়দের মনোজগতে এক ধরনের দাসত্ব ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যেখানে শাসক শ্রেণিকে স্যার বলা হতো, আর প্রজারা সবসময় মাথা নিচু করে থাকত। স্বাধীনতার পরও সেই মানসিকতা থেকে আমরা মুক্ত হতে পারিনি। আমাদের স্কুলে, অফিসে, থানায়, এমনকি হাসপাতালে গিয়েও সাধারণ মানুষকে এখনো “স্যার” বলতে হয়। অথচ যিনি স্যার বলে ডাকছেন, তিনিই করদাতা, তিনিই এই রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রকৃত পৃষ্ঠপোষক।
এখন সময় এসেছে এই বশ্যতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার। সরকারি কর্মচারীরা হলেন জনগণের সেবক। তাঁদের কাজ হচ্ছে জনগণের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করা, নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা, আইন মেনে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করা। একজন চিকিৎসক, শিক্ষক, পুলিশ কর্মকর্তা কিংবা সচিব—তাঁরা কেউই স্যার নন, তাঁরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। তাঁদের সম্মান প্রাপ্য, কিন্তু সেই সম্মান স্যারের দাস্য শব্দে নয়—বরং পেশাগত দক্ষতা, সততা ও দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে অর্জনযোগ্য। আমাদের সমাজে অনেকেই মনে করেন—স্যার না বললে নাকি শৃঙ্খলা থাকবে না, কর্তৃত্ব থাকবে না। এই ভাবনার অবসান হওয়া প্রয়োজন। সম্মান জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যায় না, সেটি আসে পারস্পরিক শ্রদ্ধা থেকে। আজকের সিদ্ধান্তটি সেই সম্মান ও শ্রদ্ধার পথে এক বড় পদক্ষেপ। অতএব, আসুন—আমরা শব্দ দিয়ে দাসত্ব না করি, আমরা শব্দ দিয়ে অধিকার প্রতিষ্ঠা করি। আজকের সিদ্ধান্তের জন্য প্রধান উপদেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই, এবং প্রত্যাশা করি, এটি যেন কেবল নির্দেশে সীমাবদ্ধ না থাকে—এর বাস্তবায়ন নিশ্চিত হোক সরকারি দপ্তরে, আদালতে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং সর্বত্র। জনগণ যেন আর কখনো নিজের কর্মচারীকে ‘স্যার’ না ডাকে, বরং আত্মমর্যাদার সঙ্গে বলে—”আপনি”। কারণ, জনগণই প্রজাতন্ত্রের আসল স্যার।
প্রয়োজনে আমি এটিকে ছোট সংস্করণ বা পত্রিকা কলামের আকারেও লিখে দিতে পারি। জানাবেন। বাংলাদেশে আমরা প্রায়শই একজন সরকারি কর্মকর্তা বা চাকরিজীবীকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করি। এটি এতটাই সাধারণ অভ্যাস হয়ে গেছে যে অনেকে মনে করেন, ‘স্যার’ ডাকা যেন সরকারি কর্মচারীদের প্রতি এক প্রকার বাধ্যতামূলক সম্মান প্রদর্শন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—এই ‘স্যার’ ডাকা কতটুকু আইনি, কতটুকু যৌক্তিক এবং এর পেছনে ইতিহাস কী? ‘স্যার’ শব্দের উৎস ও ইতিহাস: ‘স্যার’ শব্দটি এসেছে ইংরেজি থেকে। এটি মূলত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সময় ‘নাইটহুড’ পাওয়া সম্মানিত ব্যক্তিদের জন্য ব্যবহৃত একটি সম্মানসূচক উপাধি। যেমন—‘স্যার আইজ্যাক নিউটন’ বা ‘স্যার উইনস্টন চার্চিল’। অর্থাৎ, ‘স্যার’ ছিল একটি রাজকীয় স্বীকৃতি। বাংলাদেশ ও উপমহাদেশে এই ‘স্যার’ সংস্কৃতি আসে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে। সে সময় ব্রিটিশরা ‘আমরা শাসক, তোমরা প্রজা’—এই মানসিকতা জনগণের মাঝে প্রতিষ্ঠা করেছিল। ফলে ব্রিটিশ অফিসারদের প্রতি ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করতে বাধ্য করা হতো। এই সংস্কৃতি পরবর্তীতে পাকিস্তান এবং পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশেও চালু থেকে যায়, যদিও আজকের দিনে এর আর কোনও আইনগত ভিত্তি নেই।
‘স্যার’ ডাকা কি বাধ্যতামূলক বা বৈধ? না, বাংলাদেশের সংবিধান বা প্রশাসনিক আইন কোথাও বলা হয়নি যে সরকারি কর্মকর্তাকে ‘স্যার’ বলে ডাকতেই হবে। একজন সরকারি কর্মচারী জনগণের সেবক, মালিক নয়। তার দায়িত্ব জনগণের টাকায় পরিচালিত রাষ্ট্রীয় কর্ম সম্পাদন।
বাংলাদেশের সাবেক জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন একবার সংসদে বলেছিলেন— “কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে ‘স্যার’ ডাকা বাধ্যতামূলক নয়। নাগরিকরা চাইলে শুধু নাম ধরে, বা পদবী ধরে ডাকতে পারেন।”
বিশ্বের অন্যান্য দেশে কী হয়?
বিভিন্ন উন্নত দেশে সরকারি কর্মচারীদের এমন ‘স্যার’ কালচারের কোনও অস্তিত্ব নেই। উদাহরণ হিসেবে নিচে কিছু দেশের কথা তুলে ধরা হলো:যুক্তরাষ্ট্র: সরকারি কর্মকর্তাদের Mr., Ms., বা সরাসরি নাম ধরে ডাকা হয়। রাষ্ট্রপতি পর্যন্তও অনেক সময় শুধু President + Last Name এ সম্বোধিত হন। জার্মানি ও ফ্রান্স:
কর্মকর্তাদের সম্মান দেওয়া হয়, কিন্তু সেখানে জনগণের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ অত্যন্ত আনুষ্ঠানিক এবং সমানতার ভিত্তিতে হয়। জাপান: জাপানে ভদ্রভাবে কথা বলার সংস্কৃতি আছে, তবে সরকারি কর্মচারীকে ‘স্যার’ বলে ডাকার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। বরং নামের শেষে -san যোগ করে ভদ্রতা প্রকাশ করা হয়।
ভারত: অনেক জায়গায় এখনও ‘স্যার’ কালচার বিদ্যমান, তবে সরকারি নীতিমালায় কোথাও এটি বাধ্যতামূলক নয়। অনেক রাজ্যে সচেতন নাগরিকরা শুধু পদবী বা নাম ধরে ডাকেন।
নেপাল: সরকারি কর্মচারীদের সম্বোধনে ভদ্রতা বজায় রাখা হয়, কিন্তু ‘স্যার’ বলে ডাকাটা পশ্চিমা ঔপনিবেশিক অনুকরণ বলে বিবেচিত। কেন ‘স্যার’ সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসা দরকার?
এটা এক ধরনের মানসিক দাসত্বের পরিচায়ক। সরকারি কর্মচারীদের ‘মালিক’ নয়, ‘সেবক’ ভাবার সুযোগ তৈরি হয় না।
এতে নাগরিক অধিকার প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
গণতন্ত্রে ‘সমান মর্যাদা’র মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কীভাবে সম্বোধন করবেন? নিচের বিকল্পগুলো ব্যবহার করতে পারেন—‘আপনি’ — সাধারণ ভদ্র সম্মানসূচক সম্বোধন। ‘জনাব’, ‘মিসেস’, ‘মিস’ — প্রয়োজনে নাম বা পদবীর আগে যোগ করে। পদবী ধরে ডাকুন — যেমন “উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাহেব”, “মহাপরিচালক মহাশয়”, ইত্যাদি।
উপসংহার: রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা তাদের নিয়োজিত কর্মচারী মাত্র। ‘স্যার’ ডাকা যদি ব্যক্তিগত সম্মানবোধ থেকে আসে, তাহলে সমস্যা নেই। কিন্তু বাধ্যতামূলক বা ভয়ভীতির কারণে এই সম্বোধন হলে, তা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চরম অবমাননা। এখন সময় এসেছে এই উপনিবেশিক ধ্যানধারণা থেকে বেরিয়ে এসে সমান মর্যাদার রাষ্ট্র গড়ার।
“জনগণই রাষ্ট্রের মালিক, আর সরকারি চাকরিজীবী জনগণের চাকর।” — এই বোধটাই হওয়া উচিত গণতন্ত্রের ভিত্তি।