“পুলিশ যখন কবি: রাজীব কুমার দাশের কলমে ক্ষুধার্ত সমাজের কবিতাকাব্য”
নির্মম বাস্তবতার ভেতরেও যিনি খোঁজেন আলো, মুখে নীরবতা, হৃদয়ে ঝরে কবিতার কলকল ধ্বনি ভালো। টর্চলাইট নয়, কলমই তাঁর অস্ত্র হয়ে ওঠে,
আবর্জনায় ঢাকা সমাজকে শব্দে নতুন রূপে ফোটে। বেথার বুক চিরে উঠে আসে যতো না বলা গল্প, রাজীব কুমার দাশের কবিতায় সেই ব্যথাও পায় পদলিপি-শিল্প।
নিরাপত্তার শৃঙ্খল ছাপিয়ে, তিনি কবিতার মুক্ত পাখি, পুলিশের ইউনিফর্মে লুকিয়ে এক সাহসী কবি থাকি। পুলিশ মানেই কড়া মুখ, কঠোর শাসন আর শৃঙ্খলার প্রতীক—এমন একটি চেনা ছবি বহুদিন ধরে আমাদের মানসপটে আঁকা। সাধারণ ধারণা হলো, পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে রস, সৌন্দর্য বা সৃজনশীলতার স্থান নেই। কিন্তু সেই প্রচলিত ধারণার মূলে আঘাত করেছেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা, যিনি আবার এক নিবেদিতপ্রাণ কবিও—তিনি রাজীব কুমার দাশ। দায়িত্বে নিষ্ঠাবান এই কর্মকর্তা দেখিয়েছেন, কঠোর পেশার ভেতরেও কোমল হৃদয়ের অস্তিত্ব থাকে। তিনি অপরাধ দমনে দৃঢ়, আবার মধ্যরাতে কলম তুলে নেন—তার কবিতায় উঠে আসে ক্ষুধার্ত মানুষের দীর্ঘশ্বাস, অবহেলিত জনজীবনের আর্তনাদ, প্রেমিক হৃদয়ের নীরব কান্না আর প্রতিবাদের বজ্রকণ্ঠ। আমি রাজীব কুমার দাশের বইগুলো পড়েই আজ তার বিষয়ে কিছু কথা লিখতে বসলাম। সাহিত্য পাঠ মানুষের চিন্তার দরজা খুলে দেয়, আর কিছু কিছু লেখকের লেখা সেই দরজা শুধু খুলেই দেয় না—মনের গভীরে আলোও ফেলতে থাকে। রাজীব কুমার দাশ তেমনই একজন লেখক, যিনি সাহিত্যের ভাষায় সমাজের অসঙ্গতি, মানুষের বিষণ্নতা, বিদ্রূপ, প্রতিবাদ আর প্রেমকে চিত্রিত করেন ভিন্নমাত্রায়। তার বইগুলো পড়ে মনে হয়েছে—এ যেন কেবল গল্প নয়, বরং সময়ের দলিল, বাস্তবতার আয়না।
“আমি আমার বিষণ্নতার সাথেই সুখী” বইটি আমাকে এক নিঃশব্দ আর্তনাদের সামনে দাঁড় করিয়েছে। এখানে বিষণ্নতা কোনো রোগ নয়—বরং জীবনের অংশ, সহচর। এই বইয়ের প্রতিটি বাক্য হৃদয়ে স্থির হয়ে বসে, আর পাঠক অনুভব করে—আমরাও কি এমন অনুভবের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি না?
“গুহীরান্ডি”—একটি শব্দ, একটি নারী, একটি সমাজচিত্র। এ বইয়ে রাজীব দাশ তুলে ধরেছেন এমন এক জীবনের গল্প, যাকে সমাজ পায়ের নিচে ফেলেছে, অথচ সে বুক উঁচিয়ে বাঁচতে চায়। এই বই পাঠককে কাঁদায়, কিন্তু একসাথে সাহসও জোগায়।
“গোশালা কোচিং সেন্টার” নামটা শুনে মনে হয় হাসির গল্প, কিন্তু ভিতরে লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের কোচিং নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি এক তীব্র ব্যঙ্গ। হাসির আড়ালে যে গভীর বেদনা, তা বুঝে নিতে হয় পাঠকের অনুভূতির চোখ দিয়ে।
“ঘর”—এই বইটি যেন সম্পর্ক, নিঃসঙ্গতা আর স্মৃতির নীরব আলাপ। ঘর এখানে আশ্রয়ও, আবার বিষাদও। রাজীব দাশ পাঠককে এমন এক ঘরে নিয়ে যান, যেখানে একাকীত্ব শব্দহীন শব্দের মতো বেজে চলে।
“KCN”—একটি রহস্যোপন্যাস, যার প্রতিটি পৃষ্ঠা গা ছমছমে উত্তেজনায় পূর্ণ। সমাজের গোপন বিষ, চরিত্রের ভাঙচুর আর নারীর প্রতিরোধ একসাথে মিশে গড়ে তুলেছে এক শক্তিশালী বার্তা।
আর “নষ্ট গল্পে চটি-নটি জীবন”—শুধু এক খোলামেলা সাহিত্যের উপস্থাপন নয়, বরং এটি এক ভয়ঙ্কর বাস্তবতার বিশ্লেষণ। চটি সাহিত্য কিভাবে বিকৃত রুচির জন্ম দেয়, কীভাবে সমাজ ও প্রজন্মকে ভেতর থেকে পচিয়ে দেয়—তা-ই লেখক সাহসিকতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। প্রতিটি বই যেন একেকটি আলাদা পৃথিবী। রাজীব কুমার দাশ এই সময়ে দাঁড়িয়ে সাহসের সঙ্গে লিখছেন, যা পাঠকের চিন্তা ও বিবেচনাকে নতুনভাবে নাড়া দেয়। তার লেখা আমাকে কাঁপিয়েছে, প্রশ্ন তুলেছে, এবং ভাবতে বাধ্য করেছে। সে কারণেই আমি মনে করি—এ সময়ের পাঠকের উচিত এই লেখকের সাহিত্যে ডুবে যাওয়া, কারণ তার লেখায় আছে আত্মার সঙ্গে আত্মার সংলাপ। আমি সেই কবি পুলিশ রাজিব কুমারের কথাই পাঠকের কাছে তুলে ধরছি -পুলিশ মানেই কড়া মুখ, কঠোর শাসন আর শৃঙ্খলার প্রতীক—আমাদের বহুদিনের চেনা চিত্র। অনেকেই বলে থাকেন, পুলিশ মানেই বেরসিক, তাদের মধ্যে রসকষের অভাব, সৃজনশীলতার স্থান নেই। কিন্তু এই প্রচলিত ধারণাকে ভেঙে চুরমার করেছেন একজন মানুষ—পুলিশ কর্মকর্তা, অথচ কবিতার মানুষ; তার নাম রাজীব কুমার দাশ। পেশাগত জীবনে তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা পুলিশ অফিসার, আর অন্তরে-বাহিরে তিনি একজন নির্মোহ, মানবতাবাদী কবি। রাজীব দাশ প্রমাণ করেছেন, কঠোর পেশার ভেতরেও কোমল হৃদয় বেঁচে থাকে। যিনি চোখে চোখ রেখে অপরাধের বিরুদ্ধে দাঁড়ান, তিনিই আবার গভীর রাতে কলম হাতে তুলে নেন—তাঁর শব্দের মুদ্রায় তুলে আনেন অনাহারী মানুষের হাহাকার, অবহেলিত জনজীবনের দীর্ঘশ্বাস, প্রেমিক হৃদয়ের নিঃশব্দ চিৎকার এবং প্রতিবাদের বজ্রনিনাদ। আমার সৌভাগ্য, রাজীব আমার ছোট ভাইয়ের মতো। দীর্ঘ দিন ধরে তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয়। চট্টগ্রামের মাটি ও মানুষের গন্ধ লেগে থাকা এই প্রতিভাবান মানুষটির বেড়ে ওঠা আমার চোখের সামনেই। বাংলা টেলিভিশনের সাহিত্যভিত্তিক টকশোতে আমি তাকে একাধিকবার উপস্থাপন করেছি। তার কণ্ঠে উচ্চারিত কবিতাগুলো শোনার পর বারবার মনে হয়েছে—এই মানুষটি পুলিশ নয়, যেন একটি চলমান কবিতা। রাজীব দাশের কবিতা নিছক অলঙ্কারপ্রেমী শব্দজালের ফাঁদ নয়। তার কবিতা বাস্তব, সংবেদনশীল এবং তীক্ষ্ণ। তিনি লিখেছেন—
“ললাটে এখনো ক্ষুধার পিদিম জ্বলে/ সভ্যতার প্রভাতফেরি ভোরে খড়ম পায়ে এখনো আমাদের হাঁটা হয়নি।”
এই একটি পঙক্তিতেই তিনি তুলে ধরেছেন অনাহার, সমাজের শোষণ, আর সভ্যতার প্রতারক মুখোশের ছবি।
আরও এক স্থানে তিনি লিখেছেন—
“তুমি অবিশ্রান্ত সুখের ঋণে কাবুলিওয়ালা জর্দা-পান পোলাও মুখে হেঁটে চলেছো মাঠ-ঘাট আলপথ হয়ে টেকনাফ তেঁতুলিয়া পেরিয়ে সুন্দরবন”
এ যেন বাংলাদেশের খাঁটি এক জীবনচিত্র, যেখানে অভাব-দারিদ্র্য আর জীবনের সংগ্রাম একই ক্যানভাসে আঁকা।
তার কবিতার অন্য এক প্রান্তে ধরা পড়ে তীব্র প্রতিবাদ, সাহসিকতা এবং সময়ের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা—
“আমরা কী ই বা এমন দোষ করিলাম? ছিনাইয়া লইব পদক… বজ্রমুষ্ঠি কিল ঘুসি!”
এখানে তিনি কবিতার নামে পদকভিক্ষা করা, অনৈতিক দাসত্বের বিরুদ্ধে উচ্চারণ করেন তীব্র প্রতিরোধের ভাষা।
এই কবি কেবল কবিতার প্রেমিক নন—তিনি একজন আত্মসমালোচক, সমাজের দর্পণ এবং প্রতিবাদের মুখপত্র। আজ যখন কবিতা অনেকের জন্য এক কর্পোরেট রচনা, যখন কবিরা পদকের আশায় শব্দের আত্মাকে বিক্রি করছেন, তখন রাজীব দাশ দাঁড়িয়ে আছেন বিপরীত মেরুতে। তিনি পদক লেখেন না, লেখেন সত্যের জন্য, সাহসের জন্য, আর মানবতার জন্য।
রাজীব দাশের কবিতাগুলো পড়ে মনে হয়, পুলিশ পেশা তাকে রুখে দিতে পারেনি। বরং সেই পেশার মধ্য দিয়েই তিনি সমাজের গভীরে পৌঁছে গেছেন—সেখান থেকেই উঠে এসেছে তার কবিতার খনি। কেউ হয়তো ভাববে—পুলিশ কি আর কবি হয়? আমার উত্তর, অবশ্যই হয়। ইতিহাসে আমরা বহু পুলিশ কর্মকর্তা পেয়েছি, যাঁরা কালজয়ী সাহিত্যিক ছিলেন। আর সেই তালিকায় রাজীব কুমার দাশ এক গর্বিত সংযোজন।
তার বহু বই প্রকাশিত হয়েছে—সব বইতেই কবিতার বিষয়, ভাব, গঠন ও ভাষা দিয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন, তিনি নিছক কবি নন—তিনি কবিতা-বিষয়ে অত্যন্ত দক্ষ, এক কথায় বলতে গেলে কবিতার কারিগর। তার কবিতা কেবল বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা ছড়িয়ে পড়ে পাঠকের অনুভবে, চিন্তায় ও চেতনায়।
আমি গর্বিত, কারণ এই কবিকে আমি চিনি। আমি তার লেখার একজন সত্যিকারের ভক্ত। সে শুধু আমার ভাই নয়, আমাদের চট্টগ্রামের কৃতি সন্তান, আমাদের গর্ব। আজ যখন বাংলা কবিতার দুর্দিন চলছে, তখন রাজীব দাশ যেন কবিতার জন্যই জন্মেছেন—নিরন্তর কবিতা, সাহসিকতা ও সত্যের জন্য কলম চালিয়ে যাচ্ছেন।
আমার বিশ্বাস, যদি তিনি নিয়মিত লেখেন, তবে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর একটি উজ্জ্বল স্থান নিশ্চিত হবে। সময় তার মূল্যায়ন করবে, পাঠক তাকে মনে রাখবে—একজন কবি হিসেবে, একজন মানুষ হিসেবে, এবং একজন সাহসী পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে, যার হৃদয়ে কবিতার তানপুরা সারাক্ষণ বাজে।
লেখক পরিচিতি: সাংবাদিক, কলাম লেখক ও সাহিত্য সংগঠক ও
সদস্য, পেন ইন্টারন্যাশনাল।