-বিশেষ অনুসন্ধানঃ–
“চট্টগ্রামের জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর:সংকটের আবরণে লুকানো এক সাংস্কৃতিক রত্ন”
চট্টগ্রামের হৃদয়ে স্থাপিত দেশের একমাত্র জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর আজকাল সময়ের ভারে ক্লান্ত। তবে এর দেয়ালে দেয়ালে লুকিয়ে আছে হাজার বছরের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও অস্তিত্বের গল্প। এ যেন বাংলাদেশের নৃ-তাত্ত্বিক ইতিহাসের জ্যান্ত দলিল, যেখানে প্রতিটি প্রদর্শন যেন এক একটি জীবন্ত গল্প বলছে—আমাদেরই অগোচরে হারিয়ে যাওয়া মানুষের, সমাজের, সংস্কৃতির কথা।
জন্মের ইতিহাস: জাতির পরিচয়ের এক নির্ভরযোগ্য দলিল-১৯৬৫ সালে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে ১ দশমিক ২৫ একর জায়গায় প্রতিষ্ঠা করা হয় এই জাদুঘরটি। ১৯৭৪ সালের ৯ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মো. ইউসুফ আলী এর দ্বার উন্মুক্ত করেন সর্বসাধারণের জন্য। উদ্দেশ্য ছিল একটিই—বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জীবনচর্যাকে দলিল আকারে সংরক্ষণ এবং নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা। এটি শুধুমাত্র চট্টগ্রামের গর্ব নয়, বরং পুরো দেশের জাতিগত ইতিহাস ও বৈচিত্র্যের সজীব প্রামাণ্যচিত্র।
জাদুঘরের ভেতরের ঐশ্বর্য চারটি গ্যালারি ও একটি কেন্দ্রীয় মিলনায়তন নিয়ে সাজানো এই জাদুঘরে রয়েছে ২৯টি বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এবং ভারত, পাকিস্তান, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া ও কিরগিজস্তানের কিছু জাতিগোষ্ঠীর জীবনের বাস্তবচিত্র। সংগ্রহে রয়েছে শতবর্ষ পুরোনো নকশিকাঁথা, বাঁশের তৈরি হুক্কা, পিতলের অলংকার, আদিম তীর-বল্লম, ফুলদানি, পাথরের ব্যবহৃত পাত্র, কাঠের তৈরি বসার আসন, বাঁশের নৌকা, রঙিন পোশাক—সবই একেকটি সাংস্কৃতিক ইতিহাসের জীবন্ত নিদর্শন। বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে রয়েছে ১৯৮৯ সালে ভেঙে ফেলা বার্লিন প্রাচীরের একটি অংশ, যা মুক্তচিন্তার প্রতীক হয়ে রয়েছে। ইতিহাসবিদ ও
বিশেষজ্ঞদের কণ্ঠে জাদুঘরের প্রয়োজনীয়তা-চট্টগ্রামের ইতিহাসবীদ- সোহেল মোহাম্মদ ফখরুদ্দিন বলেন:“এই জাদুঘর শুধুমাত্র একটি ভবন নয়, এটি একেকটি জাতির স্মৃতিচিহ্ন। প্রতিটি প্রদর্শনী হচ্ছে নৃগোষ্ঠীর ভাষা, বোধ, আচার ও সাংস্কৃতিক প্রবাহের ধারক। কিন্তু দুঃখজনক হলো, এটি আজ আমাদের অবহেলায় ঝুঁকির মধ্যে পড়ে আছে। আধুনিকায়ন, গবেষণা সহযোগিতা ও আন্তর্জাতিক মানের প্রদর্শনীর মাধ্যমে একে জাতির অহংকারে পরিণত করা সম্ভব।” চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরামের চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার মনোয়ার হোসেন বলেন:“আমরা চট্টগ্রামের স্বার্থ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে এসেছি। এই জাদুঘরকে ঘিরে এক বিশাল আন্তর্জাতিক পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা যায়, যদি সরকারের সদিচ্ছা থাকে। আমরা নাগরিক ফোরাম থেকে দাবি জানাচ্ছি, এই জাদুঘরকে জাতীয় গুরুত্বের প্রতিষ্ঠান ঘোষণা করে একটি স্বাধীন ‘জাতিতাত্ত্বিক গবেষণা ইনস্টিটিউট’ গঠন করা হোক।” আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিভঙ্গি-ড. হ্যান্স মুলার, বার্লিনের Ethnologisches Museum-এর সিনিয়র কিউরেটর, যিনি একসময় চট্টগ্রামের জাদুঘর পরিদর্শন করেন, বলেন:
“এটি একটি অতুলনীয় সম্ভার। পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশেও এত বিস্তৃত এবং বহুমাত্রিক নৃগোষ্ঠী-ভিত্তিক সংগ্রহশালা নেই। এর সামগ্রীগুলো আধুনিক কিউরেশন ও ডিজিটাল আর্কাইভিংয়ের মাধ্যমে রক্ষা করা জরুরি, নইলে আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক মণিমুক্তি হারাতে পারি।” ড. আয়শা তাকাসাকি, ওসাকা ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ এথনোলজির প্রাক্তন পরিচালক বলেন: “বাংলাদেশের এই জাদুঘরটির ভবিষ্যৎ এক বিশাল সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। এটিকে UNESCO হেরিটেজ মিউজিয়ামের তালিকাভুক্ত করার মতো উদ্যোগ নেওয়া উচিত। কিন্তু তার আগে স্থান, সংরক্ষণ পদ্ধতি, প্রদর্শনী, ভাষা উপস্থাপন ও আন্তর্জাতিক গবেষণার সুযোগ আরও সম্প্রসারিত করতে হবে।”
সমস্যার চিত্র-এই সম্ভারের বিপরীতে রয়েছে ভবনের জরাজীর্ণতা, জনবল সংকট, আধুনিক প্রযুক্তির অভাব ও সড়কজট। ৩০টি পদের মধ্যে বর্তমানে কর্মরত মাত্র ১৬ জন। বর্ষায় ছাদ চুইয়ে পানি পড়ে, ভিজে যাচ্ছে সংরক্ষিত সামগ্রী।
ডিজিটাল ডিসপ্লে, ইন্টারেক্টিভ গাইড, অডিও-ভিজ্যুয়াল সাপোর্ট নেই। সামনের সড়কে জলাবদ্ধতা, প্রবেশপথে নেই দর্শনার্থী-বান্ধব ব্যবস্থা। আধুনিক গবেষণা সুবিধা নেই, নেই কোনো আর্কাইভ-ব্যবস্থাপনা। উপযুক্ত সংরক্ষণ ও আধুনিকায়নের দিকনির্দেশনা-
বিশ্বের আধুনিক জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরগুলো যেভাবে কাজ করে, বাংলাদেশেও তেমন কিছু করা সম্ভব। যেমন: ডিজিটাল আর্কাইভিং ও ক্যাটালগিং: প্রতিটি সামগ্রীর উচ্চ রেজুলেশনের ছবি ও ইতিহাস যুক্ত করে অনলাইনে প্রকাশ। ভিজ্যুয়াল রিয়ালিটি (VR) ও অগমেন্টেড রিয়ালিটি (AR): দর্শনার্থীরা যেন সময়ের স্রোতে হারিয়ে যাওয়া নৃগোষ্ঠীর জীবনে প্রবেশ করতে পারে ভার্চুয়াল চশমা দিয়ে। ইন্টারেক্টিভ ডিসপ্লে ও কিউআর স্ক্যানার: প্রতিটি প্রদর্শনীর পাশে থাকবে তথ্য সম্বলিত স্ক্যানযোগ্য বারকোড। গবেষণাগার ও লাইব্রেরি: যেখানে গবেষকরা দেশি-বিদেশি নৃগোষ্ঠীর উপর কাজ করতে পারবেন। বিশেষ দিবস ও শিক্ষামূলক আয়োজন: স্কুল-কলেজ পর্যায়ে জাদুঘর ভ্রমণকে অন্তর্ভুক্ত করা। রক্ষার শপথ, গৌরবের প্রত্যাশা- চট্টগ্রামের এই জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর কেবল একটি স্থাপনা নয়, এটি জাতির চেতনাভিত্তি। যেভাবে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো তাদের নৃগোষ্ঠীর ইতিহাস সংরক্ষণে আন্তরিক, বাংলাদেশকেও একইরকম সচেতন ও আধুনিক হতে হবে। না হলে আমরা হারিয়ে ফেলব এমন এক সংস্কৃতির খনি, যার মূল্য কোনো অর্থে মাপা যাবে না। সময় এসেছে জাদুঘরটির প্রতি দায়িত্বশীল মনোভাব দেখানোর—সাংস্কৃতিক সুরক্ষা, আধুনিকায়ন এবং আন্তর্জাতিকীকরণের মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানকে পরিণত করা হোক দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নৃ-তাত্ত্বিক গবেষণা ও পর্যটন কেন্দ্রে। নিম্নে চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরামসহ বিভিন্ন সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষাকারী সংগঠনের পক্ষ থেকে চট্টগ্রামের জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর রক্ষা ও আধুনিকায়নের লক্ষ্যে প্রদত্ত প্রস্তাবনাসমূহ বাংলা সিরিয়াল নম্বরসহ উপস্থাপন করা হলো:১। জাতীয় গুরুত্বের প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরকে “জাতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য” হিসেবে ঘোষণা ও সংরক্ষণের জন্য আলাদা আইন প্রণয়ন।
২। স্বতন্ত্র পরিচালনা পর্ষদ গঠন স্থানীয় বিশিষ্টজন, ইতিহাসবিদ, গবেষক, এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের প্রতিনিধি নিয়ে একটি দক্ষ ও স্বাধীন পরিচালনা পর্ষদ গঠন। ৩। জাদুঘরের অবকাঠামোগত সংস্কার জরাজীর্ণ ভবন ভেঙে আধুনিক, জলবায়ু নিয়ন্ত্রিত স্থাপত্য শৈলীতে নতুন ভবন নির্মাণ। ৪। নতুন গ্যালারি ও প্রদর্শনী আধুনিক ডিজিটাল ডিসপ্লে ও অডিও-ভিজ্যুয়াল গ্যালারির সংযোজন, বিশেষ করে শিশু-কিশোর ও তরুণ প্রজন্মের জন্য আলাদা সেকশন। ৫। গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা জাদুঘরের আওতায় “জাতিতাত্ত্বিক গবেষণা ও নথিপত্র সংরক্ষণ কেন্দ্র” প্রতিষ্ঠা। ৬। বিদ্যমান জনবল সংকট দূরীকরণ জাদুঘরের সব শূন্যপদ দ্রুত পূরণ ও পেশাগত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনবল নিয়োগ। ৭। ডিজিটালাইজেশন ও ভার্চুয়াল ট্যুর সমস্ত সংগ্রহের ডিজিটাল ক্যাটালগ তৈরি এবং ভার্চুয়াল ট্যুরের ব্যবস্থা চালু। ৮। বার্ষিক আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন জাতিতাত্ত্বিক বিষয়ক গবেষণা, অভিজ্ঞতা ও সংস্কৃতি বিনিময়ে প্রতিবছর আন্তর্জাতিক কনফারেন্স আয়োজন।
৯। স্কুল-কলেজ পর্যায়ের শিক্ষা সফরের অংশ করা শিক্ষার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলক শিক্ষা সফরের অন্তর্ভুক্তি এবং শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ। ১০। পর্যটন খাতে সংযুক্তি জাদুঘরকে চট্টগ্রামের পর্যটন মানচিত্রে গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে উন্নত গাইডলাইন, সাইনবোর্ড ও যাতায়াত ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। ১১। আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সম্পৃক্ততা-চট্টগ্রামের সাহিত্য-সংস্কৃতি সংগঠনগুলোর সঙ্গে নিয়মিত অংশীদারিত্বমূলক কর্মসূচি পরিচালনা। ১২। পৃষ্ঠপোষকতা ফান্ড গঠন
সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ‘জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর উন্নয়ন ফান্ড’ গঠন। ১৩। ইউনেস্কো স্বীকৃতির জন্য উদ্যোগ
এই জাদুঘরকে ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ।১৪। বার্ষিক সাংস্কৃতিক উৎসব আয়োজন নৃগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী নৃত্য, সংগীত, খাদ্য ও হস্তশিল্প নিয়ে বার্ষিক উৎসব আয়োজন।১৫। সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ আইন বাস্তবায়ন তদারকি-ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ঐতিহ্য ও অধিকার রক্ষায় বিদ্যমান আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়নের দাবি।
লেখকঃ সাংবাদিক গবেষক টেলিভিশন উপস্থাপক ও মহাসচিব, চট্টগ্রাম নাগরিক ফেরাম।