প্রদীপের মৃত্যুদণ্ডে পর্দা নামল একটি অধ্যায়ের কিন্তু তার পৃষ্ঠপোষক ডিআইজি গোলাম ফারুক আজও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে কেন!
ওসি প্রদীপ কুমার দাশ—এক সময়ের পুলিশ কর্মকর্তা, আজ গণমানুষের চোখে রক্তাক্ত আতঙ্কের প্রতীক। মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলায় তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হচ্ছে। কিন্তু এই বিচারের মাধ্যমে কি প্রকৃত অপরাধচক্রের সমাপ্তি ঘটেছে? নাকি শুধুই এক দালালকে শাস্তি দিয়ে মূল গডফাদারদের রেহাই দেওয়া হচ্ছে? একজন ওসি থেকে রক্তখেকো ঘাতক হয়ে ওঠা:
প্রদীপ কুমার দাশের অপরাধের তালিকা শুধু সিনহা হত্যাকাণ্ডে সীমাবদ্ধ নয়। কক্সবাজারের টেকনাফে দায়িত্ব পালনকালে তিনি ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে কথিত বন্দুকযুদ্ধে হত্যা করেছেন প্রায় ১৪৪ জন—যাদের অধিকাংশই ছিল নিরীহ জেলেরা, কৃষক কিংবা গরিব মাদকসেবী। এই বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে অভিযোগ রয়েছে।এছাড়া:,ঘরে ঢুকে লুটপাট ও নির্যাতন,নারীদের ধর্ষণ ও হয়রানি,গোপন ভিডিও করে ব্ল্যাকমেইল মাসে কোটি টাকার চাঁদাবাজি,,ইয়াবা ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ,সীমান্তে মানবপাচার চক্রে জড়িত থাকা এসব অপকর্মের মাধ্যমে ওসি প্রদীপ গড়ে তোলেন শত শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের পাহাড়। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার নামে ৩৬ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ করে, যা ছিল মাত্র দৃশ্যমান অংশ। ডিআইজি গোলাম ফারুকের নাম উঠে আসে কেন?প্রদীপের টেকনাফে পদায়নের নেপথ্যে ছিলেন তৎকালীন চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. গোলাম ফারুক। জনশ্রুতি ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, প্রদীপকে মহেশখালী থেকে টেকনাফে বদলির জন্য ঘুষ হিসেবে দেওয়া হয়েছিল এক কোটি টাকা। প্রদীপ এই বদলির জন্য তার গোপন টাকা দিয়ে দেন সরাসরি ডিআইজি গোলাম ফারুককে।
প্রদীপের টেকনাফে যোগদানের পর থেকেই শুরু হয় রক্তের রাজত্ব। সে সময় কক্সবাজার ছিল কথিত ‘ক্রসফায়ারের শহর’। কেউই নিরাপদ ছিল না। অভিযোগ আছে, এই সময় প্রদীপ তার আয়কৃত অর্থের একটি বড় অংশ নিয়মিত ভাগ করে পাঠাতেন উপরের কর্মকর্তা—ডিআইজি গোলাম ফারুকসহ একাধিক কর্মকর্তাকে। এই মদদের কারণেই প্রদীপ ছিল পুরো প্রশাসনিক কাঠামোর বাইরে, অস্পৃশ্য। ডিআইজি গোলাম ফারুক পরে পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে পদোন্নতি পান। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কখনো কোনো তদন্ত হয়নি, হয়নি বিচারও। অথচ তার সংশ্লিষ্টতা এখনো অনেক মিডিয়া রিপোর্ট, গোয়েন্দা তথ্য এবং উচ্চপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের সাক্ষ্যে উঠে এসেছে।
মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ড: চূড়ান্ত পাপের বিস্ফোরণ-২০২০ সালের ৩১ জুলাই টেকনাফের শামলাপুর চেকপোস্টে সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানকে গুলি করে হত্যা করে প্রদীপ ও তার সহযোগীরা। ঘটনাটি তোলপাড় সৃষ্টি করে জাতীয়ভাবে। সেনাবাহিনী, মিডিয়া, মানবাধিকার সংস্থা এবং সাধারণ মানুষ একজোট হয়ে এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করে। এরপরই শুরু হয় ওসি প্রদীপের পতন। কিন্তু প্রদীপ ও লিয়াকতের বিচার কার্যকর হলেও, যারা তাদের নিয়োগ, পৃষ্ঠপোষকতা, নিরাপত্তা ও উৎসাহ জুগিয়েছেন—তারা আজও নেপথ্যে নিরাপদ। এর মধ্যে অন্যতম গোলাম ফারুক। বিচারহীনতা ও প্রশাসনিক দায়: এখানে প্রশ্ন একটাই—এই বিচার কি সম্পূর্ণ? যদি প্রদীপ ঘুষ দিয়ে পোস্টিং পান, যদি উপরমহল জানতেন তার কর্মকাণ্ডের কথা, তবু যদি কেউ থামাননি—তবে তাদের দায় নেই কেন? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়, পুলিশ সদর দপ্তর এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের উচিত ছিল এই গোটা নেটওয়ার্কের ওপর স্বাধীন ও স্বচ্ছ তদন্ত চালানো। কিন্তু সেটা হয়নি। ফলে যারা শুধু এক কর্মকর্তার নামে দায় চাপিয়ে মূল গডফাদারদের আড়ালে রেখে দিয়েছে, তাদের প্রতিও রয়েছে জনরোষ।
ওসি প্রদীপ নিভে গেলেও, তার ছায়া—ডিআইজি গোলাম ফারুক ও তার মতো ক্ষমতার পাহাড়ে বসা দুষ্কৃতিকারীরা আজও অন্ধকারে রয়ে গেছেন। একদিন এই প্রশ্ন অবশ্যই উঠবে—‘প্রদীপের বিচার হলো, কিন্তু তার কারিগরের বিচার কবে হবে?’ এই প্রশ্ন শুধু মেজর সিনহার জন্য নয়, শত শত নিহত নিরীহ মানুষের জন্য, যারা বিচার না পেয়েই হারিয়ে গেছে অতল গহ্বরে। অন্যদিকে, সেই সময়ের পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ছিলেন বেনজীর আহমেদ। তিনি র্যাবের মহাপরিচালকের পদ থেকে সরাসরি আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তখন বেনজীর শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন। র্যাবে কর্মরত থাকা অবস্থায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্ব দেওয়া বেনজীর, আইজিপি হওয়ার পরেও সেই নৃশংসতা থেকে নিজেকে বিরত রাখেননি।
এই সময়েই কক্সবাজারের টেকনাফে ওসি প্রদীপ কুমার দাশ বেপরোয়া হয়ে একের পর এক মানুষ হত্যা করতে থাকেন। গণহত্যার পর্যায়ে পৌঁছানো এই হত্যা-যজ্ঞে তখনকার ডিআইজি গোলাম ফারুকের মাধ্যমে ওসি প্রদীপকে নিরাপত্তা ও পৃষ্ঠপোষকতা দিতেন বেনজীর আহমেদ নিজেই। তাদের এই আশ্রয়-প্রশ্রয়ে ওসি প্রদীপ রক্ত-পিপাসু এক হিংস্র জানোয়ারে পরিণত হন। প্রদীপ শুধু মানুষ হত্যা করেনি, সে রক্ত চুষে খেয়েছে। আইন, মানবতা, কিংবা শাসনের কোনো সীমারেখা তার জন্য ছিল না। সে ছিল রাষ্ট্রীয় ছত্রচ্ছায়ায় বেড়ে ওঠা এক পিশাচ, যার হাতে পড়ে অসংখ্য নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।