“চেয়ারম্যান পরিবারের দখলবাজির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে রক্তাক্ত চন্দ্রপুর: মসজিদের সম্পত্তিকে কেন্দ্র করে হামলায় আহত ৪, থানায় মামলা”
চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার পুকুরিয়া ইউনিয়নের চন্দ্রপুর এলাকায় শত বছরের পুরনো একটি মসজিদের সম্পত্তিকে কেন্দ্র করে ঘটে গেছে চাঞ্চল্যকর ও নিন্দনীয় এক হামলার ঘটনা। ২০২৫ সালের ১০ মে, সকাল ৯টার দিকে স্থানীয় এক্যাইত্য পুকুরপাড় বাজারে মসজিদের আওতাধীন দোকানদারদের উপর এই হামলা চালায় ইউপি চেয়ারম্যান আসহাব উদ্দীনের ছেলে নেজাম উদ্দীন, যুবলীগ নেতা কুতুব উদ্দীন, ভাড়াটে সন্ত্রাসী দিদার ও চেয়ারম্যান নিজে।
এই হামলায় গুরুতর আহত হন দোকানদার মিজানুর রহমান, নুর হোসাইন, তারেকুর রহমান এবং জসিম উদ্দিন। স্থানীয়রা জানান, মারধরের পর মিজানুর রহমান রক্তাক্ত অবস্থায় অচেতন হয়ে পড়লে তাকে দ্রুত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানা গেছে।
শতবর্ষী মসজিদের ইতিহাস ও দখলের পাঁয়তারা
চন্দ্রপুর শাহী জামে মসজিদটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২৯ সালে। এটি এলাকার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্যতম স্তম্ভ। মসজিদের মোতোয়াল্লীরা এবং এলাকার সাধারণ জনগণ মিলে দীর্ঘদিন ধরে এই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করে আসছিলেন। মসজিদের ওয়াকফকৃত সম্পত্তি, বিশেষ করে বাজার এলাকার দোকানঘরগুলো থেকে প্রাপ্ত ভাড়ার টাকা দিয়েই চলে আসছিল মসজিদের খরচ ও মোহাম্মদিয়া ফোরকানিয়া মাদ্রাসার কার্যক্রম।
কিন্তু সম্প্রতি, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আসহাব উদ্দীন মসজিদের এই আয়ের ওপর নজর দেন। তিনি দোকানঘরের ভাড়া নিজ হাতে নিতে চান এবং ঐতিহ্যবাহী মসজিদের নাম পরিবর্তন করে ‘বশরত আলী জামে মসজিদ’ রাখতে উদ্যোগ নেন। এ নিয়ে এলাকায় তীব্র অসন্তোষ তৈরি হয়। স্থানীয়রা এই নাম পরিবর্তনকে মসজিদের ইতিহাস ও সাম্প্রদায়িক ঐক্যের ওপর হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছেন।
হামলার প্রেক্ষাপট
চেয়ারম্যানপন্থী সন্ত্রাসীরা ঘটনার দিন দোকানদারদের কাছে ভাড়ার টাকা দাবি করলে, দোকানদাররা জানিয়ে দেন যে তারা এখনও পুরোনো কমিটিকেই বৈধ মনে করেন এবং তাদের কাছেই ভাড়া প্রদান করবেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে নেজাম উদ্দীন ও তার সহযোগীরা লাঠিসোটা ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে দোকানগুলোর ওপর হামলা চালায়। দোকানদারদের উপর চলে বেধড়ক মারধর।
এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, “আমরা জানতাম তারা ক্ষমতার দাপটে কিছু একটা করবেই। কিন্তু এমন নির্মমতা হবে, তা কল্পনাও করিনি। মসজিদের ভাড়া নিজেদের নামে নিতে না পেরে মানুষ পেটানো—এটা কোন সভ্য সমাজে হতে পারে?”
আসহাব উদ্দীনের বিতর্কিত রাজনৈতিক চরিত্র
চেয়ারম্যান আসহাব উদ্দীনের অতীত রাজনৈতিক ইতিহাসও বিতর্কে ঘেরা। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তিনি নিজেকে ক্ষমতাসীন দলের ঘনিষ্ঠ বলে প্রচার করতেন। বর্তমান বিএনপি সরকারের আমলে আবার নিজেকে বিএনপির কর্মী বলে পরিচয় দিচ্ছেন। একাধিকবার রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার জন্য তিনি দলে দলে ঘুরেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
তিনি সাবেক এমপি মোস্তাফিজের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত হলেও, বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ার পর জেলা বিএনপি তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বহিষ্কার করে। এলাকাবাসী তাকে “সুযোগসন্ধানী” ও “রাজনৈতিক মুখোশধারী” বলে অভিহিত করেন।
তার ছেলে জয়নালও রাজনৈতিকভাবে প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন দখল ও চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। জয়নালের নামেও একাধিকবার জমি দখল, পাহাড় কাটা, নদী চর দখল ও অবৈধ ব্যবসার অভিযোগ জমা হয়েছে স্থানীয় প্রশাসনে।
এলাকাবাসীর আতঙ্ক ও প্রতিবাদ
ঘটনার পর চন্দ্রপুর এলাকায় চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বাজারের অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। ভুক্তভোগী পরিবার ও স্থানীয়রা একত্রিত
হয়ে বাঁশখালী থানায় একটি লিখিত মামলা দায়ের করেছেন এবং দ্রুত দোষীদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
একজন প্রবীণ নাগরিক বলেন, “মসজিদের টাকা আত্মসাৎ করতে গিয়ে যারা রক্ত ঝরালো, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না হলে এই সমাজে ন্যায়বিচারের আর কোনো স্থান থাকবে না।”
প্রশাসনের ভূমিকা
স্থানীয় প্রশাসন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে বলে জানা গেছে, তবে এখনো পর্যন্ত কোনো আসামিকে গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া যায়নি। এলাকাবাসীর দাবি, অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে দ্রুত বিচারের আওতায় না আনা হলে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হবে। চন্দ্রপুরের এই হামলা শুধু কয়েকজন দোকানদারের উপর শারীরিক নির্যাতন নয়, এটি একটি সমাজ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের শতবর্ষী ঐতিহ্যের উপর নগ্ন আঘাত। যারা ধর্মের নামে রাজনীতি করে, তারাই যখন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান দখল করে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে, তখন সমাজে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো ছাড়া বিকল্প থাকে না।