বুদ্ধ পূর্ণিমা উপলক্ষে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য আয়োজন
শান্তি শোভাযাত্রা, তাৎপর্যমূলক আলোচনা ও মনোমুগ্ধকর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান–
পবিত্র বুদ্ধ পূর্ণিমা—বুদ্ধের জন্ম, বোধিলাভ ও মহাপরিনির্বাণের ত্রিস্মৃতি বহনকারী দিবস। এই দিনটি শুধু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য নয়, শান্তিকামী প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে উদ্দীপনার বাতিঘর হয়ে জ্বলে ওঠে। এই মহিমান্বিত দিবসকে উপলক্ষ করে গতকাল শনিবার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) প্রাঙ্গণজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এক পবিত্র, শান্তিপূর্ণ ও মানবিক আবহ। চমেক বৌদ্ধ ছাত্র সংসদ, বৌদ্ধ চিকিৎসক, নার্স এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্মিলিত উদ্যোগে আয়োজিত হয় দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য কর্মসূচি—যার মধ্যে ছিল শান্তি শোভাযাত্রা, তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা সভা এবং গভীর অনুভব ছড়ানো এক সাংস্কৃতিক আয়োজন।
শান্তি শোভাযাত্রা:
সকালবেলা যখন সূর্য তার স্নিগ্ধ কিরণ ছড়িয়ে দিচ্ছিল, তখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের নতুন একাডেমিক ভবনের সামনে থেকে শুরু হয় এক নীরব অথচ শক্তিশালী বার্তা বহনকারী শান্তি শোভাযাত্রা। হাতে শান্তির পতাকা, বুকে বুদ্ধের করুণা—এভাবে কলেজের শিক্ষক, চিকিৎসক, ছাত্র-ছাত্রী, নার্স ও কর্মচারীরা মিলে গড়ে তোলেন এক সম্প্রীতির দৃশ্যপট। পদযাত্রাটি মেডিকেল ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে শেষ হয় কলেজ কনফারেন্স হলের সামনে। শোভাযাত্রাটি যেন ছিল আধুনিক চিকিৎসা বিদ্যার বুকে বসে বুদ্ধের জীবনদর্শনের এক নীরব উচ্চারণ—যেখানে সহনশীলতা, অহিংসা ও মৈত্রীর বার্তা গর্জে ওঠে মৌন ভাষায়।
আলোচনা সভা:
শোভাযাত্রা শেষে কলেজের কনফারেন্স হলে শুরু হয় মূল অনুষ্ঠান “বুদ্ধ পূর্ণিমার তাৎপর্য” শীর্ষক আলোচনা সভা। সভাপতিত্ব করেন চমেক ডেন্টাল ইউনিটের বিভাগীয় প্রধান ও উদযাপন পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. মনোজ কুমার বড়ুয়া। উদ্বোধনী বক্তব্য দেন ইউএসটিসির প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক ডা. প্রভাত চন্দ্র বড়ুয়া। বক্তৃতায় তিনি বুদ্ধ দর্শনের সার্বজনীনতা এবং আজকের বৈশ্বিক সংকটে বুদ্ধের বাণীর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।
প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মোঃ জসিম উদ্দিন। তিনি বলেন, “বুদ্ধের জীবনাদর্শ চিকিৎসা শাস্ত্রের নৈতিক ভিত্তিকেও প্রভাবিত করে। একজন চিকিৎসকের যেমন প্রয়োজন সহানুভূতি ও সহিষ্ণুতা, তেমনি একজন মানুষ হিসেবেও আমাদের বুদ্ধের মৈত্রীর বাণী হৃদয়ে ধারণ করা উচিত।”
বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মোঃ তসলিম উদ্দিন, চমেক উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মোঃ আবদুর রব এবং মুখ্য আলোচক ছিলেন মোগলটুলী শ্মশানভূমি শাক্যমুনি বুদ্ধ বিহারের মহাপরিচালক শ্রদ্ধেয় ভদন্ত তিলোকাবংশ মহাথেরো। তিনি বুদ্ধের অহিংসা নীতির আলোকে আজকের পৃথিবীর অস্থির সময়ের দিকনির্দেশনা দেন।
স্বাগত বক্তব্য দেন অধ্যাপক ডা. রিপন কুমার বড়ুয়া এবং শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন সহকারী অধ্যাপক ডা. দেবযানী বড়ুয়া, শিক্ষক বাবু বিশ্বজিৎ বড়ুয়া এবং ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক সৌমেন বড়ুয়া।
অনুষ্ঠানে অতিথি বক্তা হিসেবে আরও বক্তব্য রাখেন দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও প্রতিষ্ঠানের খ্যাতনামা চিকিৎসক ও শিক্ষকগণ। তাঁদের মধ্যে ছিলেন:
* অধ্যাপক ডা. অসীম কুমার বড়ুয়া (আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজ)
* অধ্যাপক ডা. রমা বড়ুয়া (আই. এ. এইচ. এস)
* অধ্যাপক ডা. অনুপম বড়ুয়া (কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ)
* অধ্যাপক ডা. কল্যাণ কুমার বড়ুয়া (সাউদার্ন মেডিকেল কলেজ)
* ডা. ভাগ্যধন বড়ুয়া, ডা. বসুবন্ধু বড়ুয়া, ডা. প্রীতিশ বড়ুয়া, ডা. প্রীতি বড়ুয়া, ডা. বর্ণালী বড়ুয়া, ডা. ডেইজী বড়ুয়া, ডা. শ্রাবণী বড়ুয়া, ডা. সুদীপ বড়ুয়া, ডা. সুমিষ্ঠা বড়ুয়া, ডা. প্রসূণ বড়ুয়া, ডা. ঝুলন বড়ুয়া, ডা. শর্মিলা বড়ুয়া, ডা. সৈকত বড়ুয়া, ডা. মৃত্যুঞ্জয় বড়ুয়া ও ডা. স্নেহাশীষ বড়ুয়া প্রমুখ।
আলোচনা সভার শেষে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন বৌদ্ধ ছাত্র সংসদের সভাপতি দীপান্বিতা বড়ুয়া। তিনি বলেন, “এই আয়োজন শুধু এক উৎসব নয়, বরং এটি একটি উপলক্ষ—নিজেকে জানার, সমাজকে বোঝার এবং মানুষের জন্য কাজ করার।”
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান:
আলোচনা সভার পর আয়োজিত হয় এক হৃদয়গ্রাহী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যেখানে চমেক শিক্ষার্থী, চিকিৎসক ও নার্সরা অংশগ্রহণ করেন। পরিবেশিত হয় বুদ্ধ বন্দনা, ধর্মীয় সংগীত, আবৃত্তি ও নৃত্যনাট্য। অনুষ্ঠানটি দর্শকদের হৃদয় ছুঁয়ে যায় এবং মনে করিয়ে দেয়, ধর্ম কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং অন্তরের আলো, যা সমাজকে আলোকিত করে।
এই আয়োজনটি শুধু চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের জন্য নয়, বরং সমগ্র চট্টগ্রামবাসীর জন্য ছিল এক অনুপ্রেরণার বাতাস। বুদ্ধের বাণী—মৈত্রী, করুণা ও অহিংসা—আজকের সমাজে আরও বেশি প্রয়োজন, যেখানে বিভাজন নয়, সংহতিই হোক মূলমন্ত্র। চমেকের এই আয়োজন সেই মহতী চেতনারই বাস্তব প্রতিফলন।