“অপরাধী যতই শক্তিশালী হোক না কেন, পুলিশ প্রশাসনের চেয়ে শক্তিশালী নয়। অপরাধীকে আইনের আওতায় আসতেই হবে—কোনো উপায় নেই। এই ধরনের অপরাধী দেশ এবং সমাজের জন্য ভয়ংকর। তাদেরকে চিহ্নিত করে আইনের মাধ্যমে নির্মূল করতে হবে। আমি আমার পুলিশ প্রশাসন নিয়ে সন্ত্রাস ও অপরাধ রোধে কাজ শুরু করেছি। এরই ধারাবাহিকতায় শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদকে আটক করেছি।” — পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজ””
চট্টগ্রামের কুখ্যাত অস্ত্রধারী শীর্ষ সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদ ওরফে “বুড়ির নাতি সাজ্জাদ” অবশেষে পুলিশের জালে ধরা পড়েছে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার হাসিব আজিজের সরাসরি নির্দেশনায় একটি বিশেষ টিম ঢাকা বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্স এলাকায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করে। এ অভিযান নেতৃত্ব দেন উপ-পুলিশ কমিশনার (উত্তর) আমিরুল ইসলাম এবং অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মোঃ জাহাঙ্গীর আলম। সাজ্জাদের বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক হত্যাকাণ্ড, চাঁদাবাজি, অস্ত্র ব্যবসা ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অভিযোগ। সে চট্টগ্রামের অপরাধ জগতে বড় সাজ্জাদের (অবস্থান: ভারত) সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে কাজ করত এবং ভয়ংকর অপরাধ সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করত। তার গ্রেফতার চট্টগ্রামের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় সাফল্য বলে উল্লেখ করেছেন সিএমপি কমিশনার।
সিএমপি কমিশনারের কড়া বার্তা: “অপরাধীদের কোনো ছাড় নেই” সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ সংবাদ সম্মেলনে বলেন,
“চট্টগ্রামকে সন্ত্রাসমুক্ত করতে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সাজ্জাদ চট্টগ্রামে ভয় ও সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। আজ সে আইনের হাতে ধরা পড়েছে। কিন্তু শুধু সাজ্জাদ গ্রেফতারই আমাদের কাজ নয়, তার গডফাদারদেরও খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে। কোনো অপরাধী, যত শক্তিশালীই হোক, আইনের ঊর্ধ্বে নয়।” তিনি আরও জানান, সাজ্জাদ দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকে চট্টগ্রামের বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও নির্মাণ শিল্প সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় করত। কেউ চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে প্রকাশ্যে গুলি চালিয়ে ভয় সৃষ্টি করত। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ও সন্ত্রাসবিরোধী আইনে অন্তত ১৫টি মামলা রয়েছে।
তাহসিন হত্যাকাণ্ড: প্রকাশ্য গুলিতে ঝরে গেল এক নিরীহ প্রাণ-সাজ্জাদের অন্যতম নৃশংস অপরাধ ছিল চান্দগাঁও এলাকার যুবক আফতাব উদ্দিন তাহসিন (২৭)-এর নির্মম হত্যাকাণ্ড। গত বছরের ২১ অক্টোবর বিকেলে ব্যবসায়িক কাজে চান্দগাঁও থানাধীন অদূর পাড়া এলাকায় গেলে তাহসিনকে গুলি করে হত্যা করে সাজ্জাদ ও তার সহযোগীরা। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, তাহসিন ওমর ফারুকের চায়ের দোকানে বসে ছিলেন। হঠাৎ কালো নোহা গাড়িতে কয়েকজন সন্ত্রাসী এসে তাকে ঘিরে ধরে। সাজ্জাদ নিজেই শটগান বের করে কোমর থেকে পায়ের নিচ পর্যন্ত একাধিক গুলি চালায়। তাহসিন মাটিতে লুটিয়ে পড়লে আতঙ্কে আশপাশের মানুষ ছুটে আসে। কিন্তু ততক্ষণে সন্ত্রাসীরা দ্রুত পালিয়ে যায়।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাহসিনকে মৃত ঘোষণা করেন। তার পরিবার জানায়, বেশ কিছুদিন ধরেই তাহসিনকে হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। অবশেষে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। সাজ্জাদের অপরাধের দীর্ঘ তালিকা-সাজ্জাদের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানায় ১৫টি মামলা রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে: হত্যা,অস্ত্র ব্যবসা, অপহরণ, চাঁদাবাজি, পুলিশের ওপর হামলা,
এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি,২০২৪ সালের ৫ ডিসেম্বর অক্সিজেন মোড়ে পুলিশ সাজ্জাদকে ধরতে গেলে সে পুলিশের ওপর এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে পালিয়ে যায়। এতে দুই পুলিশ সদস্যসহ চারজন গুলিবিদ্ধ হন। তার এই দুঃসাহসিক অপরাধের পর সিএমপি কমিশনার তার গ্রেফতারে অর্থ পুরস্কার ঘোষণা করেন।
গডফাদাররা কি ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে?
সাজ্জাদের গ্রেফতার নিঃসন্দেহে পুলিশের বড় সাফল্য, তবে প্রশ্ন থেকে যায়—সে একাই কি এই অপরাধ সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রক? তার পেছনে থাকা শক্তিশালী গডফাদাররা কি এবার আইনের আওতায় আসবে?
সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ জোর দিয়ে বলেছেন,
“সাজ্জাদের সঙ্গে যারা এই অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রক, তাদের কাউকে ছাড়া হবে না। গডফাদাররা যত শক্তিশালীই হোক, চট্টগ্রাম পুলিশ তাদের খুঁজে বের করবে।” সাধারণ মানুষ এখন অপেক্ষায়, চট্টগ্রামের অপরাধ জগতের আসল নিয়ন্ত্রকরা কখন ধরা পড়বে। পুলিশের এই অভিযান কি শুধু সাজ্জাদ গ্রেফতারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি সত্যিকারের অপরাধীদের শিকড় উপড়ে ফেলা হবে? পুলিশের পরবর্তী পদক্ষেপই এর উত্তর দেবে। সাজ্জাদকে আটকের সময় তার ডাকাত-স্বভাবের স্ত্রী তামান্নাও তার সঙ্গে ছিল, কিন্তু বসুন্ধরা সিটিতে কৌশলে পালিয়ে যায়। সাজ্জাদ যখন পুলিশের হাতে ধরা পড়ে, তখন চিৎকার করে “তামান্না! তামান্না!” বলতে থাকে—কিন্তু কোথায় পাবে সেই তামান্নাকে, যে নিজের স্বামীকে বিপদের মুখে ফেলে রেখে পালিয়ে গেল!
তামান্নার টিকটক পোস্টই সাজ্জাদের অবস্থান ফাঁস করে দেয়, যার ভিত্তিতেই তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়। অথচ এখন সেই তামান্নাই ফেসবুক লাইভে এসে আবোল-তাবোল কথা বলছে, যেন সে নির্দোষ! ঘটনা যেন একেবারে সিনেমার মতো—কিন্তু বাস্তবতা আরও ভয়ংকর।
প্রশাসনের উচিত সাজ্জাদের স্ত্রী তামান্নাকে দ্রুত গ্রেফতার করা, কারণ সে শুধু সাজ্জাদের অপকর্মে সহযোগিতা করেনি, বরং প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। সাজ্জাদের অস্ত্র কোথায় আছে, তা একমাত্র তামান্নাই জানে। বিশেষ করে, সাজ্জাদ কখনো খালি হাতে থাকত না—তার কাছে সবসময় অস্ত্র থাকত। কিন্তু গ্রেফতারের সময় কোনো অস্ত্র উদ্ধার হয়নি। তাহলে কি সেই অস্ত্র তামান্নার কাছেই ছিল? না হলে সাজ্জাদ কি আগের মতো গুলি চালিয়ে পালানোর চেষ্টা করত না? এর আগেও সে পুলিশের ওপর গুলি চালিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। তাই তামান্নার ভূমিকা একেবারেই সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। তাকে দ্রুত আইনের আওতায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা জরুরি।
চট্টগ্রামের অপরাধ জগতে এক আতঙ্কের নাম ছিল ছোট সাজ্জাদ। হত্যা, অস্ত্র ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত এই সন্ত্রাসী দীর্ঘদিন ধরে পুলিশের ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল। তবে পুলিশের নিরলস প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত ধরা পড়েছে এই শীর্ষ সন্ত্রাসী। গত শনিবার রাতে ঢাকার বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সে ঈদের কেনাকাটা করার সময় সাজ্জাদকে গ্রেপ্তার করা হয়। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের সাদা পোশাকধারী একটি দল পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সেখানে অবস্থান নেয়। সাজ্জাদ যখন শপিংমলের একটি দোকানে প্রবেশ করে, তখনই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সাজ্জাদের গ্রেপ্তার চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বস্তির বাতাস বইয়ে দিয়েছে। পুলিশের এই সফল অভিযান প্রমাণ করে যে, অপরাধী যতই শক্তিশালী হোক না কেন, আইন ও প্রশাসনের কাছে তাকে মাথা নত করতেই হবে। সমাজ থেকে সন্ত্রাস নির্মূলের এই প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকুক—এটাই সবার প্রত্যাশা।
ঃঅনুসন্ধান চলছে——