চট্টগ্রামে সুপেয় পানির সংকট দিন দিন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। শহরের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগত নিচে নেমে যাচ্ছে, যার ফলে অনেক বাসা-বাড়ি ও প্রতিষ্ঠান পানির জন্য গভীর নলকূপ (ডীপ টিউবওয়েল) স্থাপন করেও পর্যাপ্ত পানি পাচ্ছে না। বিশেষ করে নগর এলাকায় প্রতি বছর প্রায় ছয় (৬) ফুট এবং উপজেলা পর্যায়ে প্রায় দুই (২) ফুট করে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে বিশুদ্ধ পানির সহজলভ্যতা কমে যাচ্ছে এবং পানির লবণাক্ততা বাড়ছে।
অন্যদিকে, কর্ণফুলী ও হালদা নদীর পানিতে মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। ওয়াসার তথ্যমতে, সাধারণত নদীর পানিতে লবণের সহনীয় মাত্রা প্রতি লিটারে দুইশত পঞ্চাশ (২৫০) মিলিগ্রাম থাকার কথা। কিন্তু বর্তমানে তা বেড়ে দুই হাজার পাঁচশত (২,৫০০) মিলিগ্রামে পৌঁছেছে। এর ফলে ওয়াসার পানি উৎপাদন দৈনিক প্রায় পাঁচ (৫) কোটি লিটার কমে গেছে, যা নগরবাসীর জন্য ভয়াবহ পানীয় সংকট তৈরি করেছে।
তথ্য সংগ্রহের উৎস
এই তথ্যটি আমি আমার বন্ধু ডাক্তার মনজুরুল করিম বিপ্লব এর মাধ্যমে পেয়েছি। তিনি ফেসবুকে একটি পোস্টের মাধ্যমে বিষয়টি সামনে আনেন, যেখানে চট্টগ্রামের পানি সংকট এবং এর স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা ছিল। এছাড়াও, নগরবাসীর অভিজ্ঞতা, ওয়াসার প্রতিবেদন এবং চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরামের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতেও এই তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।
গত কয়েকদিন ধরে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, তাদের অনেকেই ওয়াসার সরবরাহকৃত পানি ব্যবহার করতে পারছেন না, কারণ এতে তীব্র লবণাক্ততা রয়েছে। অনেকে অভিযোগ করেছেন যে, পানি ফুটিয়ে খাওয়ার পরও এর লবণাক্ততা কমছে না, যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠছে।
লবণাক্ত পানির স্বাস্থ্যঝুঁকি
১. উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগ
লবণাক্ত পানিতে সোডিয়ামের মাত্রা বেশি থাকায় এটি রক্তচাপ বাড়িয়ে দিতে পারে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
২. কিডনি সমস্যা
অতিরিক্ত লবণ শরীরে পানিশূন্যতা সৃষ্টি করে, যা কিডনির ওপর বাড়তি চাপ ফেলে এবং দীর্ঘমেয়াদে কিডনি বিকলের (Kidney Failure) সম্ভাবনা বাড়ায়।
৩. গর্ভবতী মায়েদের জন্য ঝুঁকি
গবেষণায় দেখা গেছে, লবণাক্ত পানি পান করলে গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ (Gestational Hypertension) হতে পারে, যা প্রি-এক্লাম্পসিয়া, অকাল প্রসব এবং কম ওজনের শিশুর জন্মের ঝুঁকি বাড়ায়।
৪. ত্বকের সমস্যা ও চুল পড়া
লবণাক্ত পানি ব্যবহারে ত্বকের সংক্রমণ, চুলকানি, এলার্জি এবং ফাঙ্গাল সংক্রমণ দেখা দিতে পারে। মেয়েদের ক্ষেত্রে এটি চুল পড়ার সমস্যা সৃষ্টি করে এবং মাথার ত্বকে খুশকি ও প্রদাহজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে।
৫. ডায়রিয়া ও হজমের সমস্যা
অতিরিক্ত লবণ শরীরের পানির ভারসাম্য নষ্ট করে, ফলে ডায়রিয়া, পেটের ব্যথা ও হজমের সমস্যা দেখা দিতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রে এটি মারাত্মক আকার নিতে পারে।
৬. হাড় দুর্বল হয়ে যাওয়া
লবণাক্ত পানি দীর্ঘদিন পান করলে শরীর থেকে ক্যালসিয়াম বের হয়ে গিয়ে হাড় দুর্বল হয়ে পড়ে, যা অস্টিওপোরোসিস (Osteoporosis) ও অস্থি ক্ষয়ের কারণ হতে পারে।
৭. আয়োডিনের ঘাটতি ও গলগণ্ড রোগ
অধিক লবণাক্ত পানি পান করলে থাইরয়েড হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে, যা গলগণ্ড বা থাইরয়েডের অন্যান্য সমস্যার কারণ হতে পারে।
সমাধান ও করণীয়
১. সুপেয় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা
চট্টগ্রাম ওয়াসাকে জরুরি ভিত্তিতে লবণাক্ত পানি সরবরাহ বন্ধ করে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করতে হবে।
২. বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও পুনঃব্যবহার
শহরের বিভিন্ন জায়গায় জলাধার তৈরি করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করতে হবে।
৩. নদী ও সাগরের পানি পরিশোধন করে ব্যবহার
রিভার্স অসমোসিস (RO) প্রযুক্তি ব্যবহার করে লবণাক্ত পানি পরিশোধন করতে হবে।
৪. ভূগর্ভস্থ পানির অপরিকল্পিত উত্তোলন বন্ধ করা
কার্যকর আইন প্রণয়ন করে পানির স্তর নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
৫. বন, পাহাড়, পুকুর ও খাল সংরক্ষণ
জলাভূমি রক্ষা না করলে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।
চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরামের সতর্ক বার্তা
এই সংকট নতুন নয়। গত বছরও আমরা চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরামের পক্ষ থেকে চট্টগ্রাম ওয়াসার দায়িত্বহীনতার বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এই পবিত্র রমজান মাসে মানুষ যদি বিশুদ্ধ পানি না পায়, তবে তা চরম অমানবিকতার পরিচয়। আমরা আবারও চট্টগ্রাম ওয়াসাকে কঠোরভাবে জানিয়ে দিতে চাই—
✅ অবিলম্বে লবণাক্ত পানি সরবরাহ বন্ধ করুন।
✅ সুপেয় পানির নিশ্চয়তা দিন।
✅ অন্যথায় আমরা আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবো।
জনগণের সুস্বাস্থ্য ও জীবন বাঁচাতে আমরা কোনো আপস করবো না!
লেখকঃ মহাসচিব,চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরাম,