চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার এওছিয়া ইউনিয়নের ছনখোলা এলাকায় ডাকাত সন্দেহে স্থানীয় জনতার গণপিটুনিতে দুইজন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয়েছেন। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হয়েছে একটি বিদেশি পিস্তল ও আটটি গুলির খোসা, যা সম্প্রতি থানায় হামলার সময় লুণ্ঠিত হয়েছিল। নিহতদের পরিচয় পাওয়া গেছে— তারা হলেন মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন (৪৫) ও মোহাম্মদ ছালেক (৩৫)।
ঘটনার সূচনা: মসজিদের মাইকে ঘোষণা সোমবার (৩ মার্চ) রাত ১০টার দিকে চারটি সিএনজি অটোরিকশাযোগে একদল ব্যক্তি ছনখোলা এলাকায় প্রবেশ করে। সন্দেহজনক গতিবিধি দেখে স্থানীয়দের সন্দেহ হয়। এরপর মসজিদের মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয়, “এলাকায় ডাকাত প্রবেশ করেছে, সবাই সতর্ক হন!”
এরপর শত শত গ্রামবাসী দলবদ্ধ হয়ে চারপাশ থেকে সিএনজি অটোরিকশাগুলো ঘিরে ফেলে। এ সময় গাড়িতে থাকা ব্যক্তিরা পালানোর চেষ্টা করে এবং গুলি ছুড়তে শুরু করে। এতে পাঁচজন গ্রামবাসী গুলিবিদ্ধ হন। আহতদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
নিহত নেজাম ও তার অপরাধচক্র স্থানীয়রা জানান, নেজাম দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া ও লোহাগাড়ায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। প্রবাস থেকে ফিরে সে নারী পাচার, চাঁদাবাজি, জমি দখল, ডাকাতি ও অপহরণের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।
তাকে অর্থায়ন করত দুই ব্যক্তি— দুবাইয়ের
নারী পাচারকারী মহিউদ্দিন ওসমান ও রিয়াদ হোসেন। তারা মূলত মধ্যপ্রাচ্যে নারী পাচারের সিন্ডিকেট পরিচালনা করত এবং সেই অর্থ দিয়ে নেজাম তার ক্যাডার বাহিনী চালাত। নেজামকে সাতকানিয়ার স্থানীয় রাজনীতির একটি প্রভাবশালী অংশের আশ্রয়-প্রশ্রয়ও ছিল, যা তাকে বারবার গ্রেপ্তার এড়াতে সাহায্য করে আসছিল।
থানা হামলার অস্ত্র উদ্ধার: নতুন মোড় নিল তদন্ত- স্থানীয়দের গণপিটুনিতে নিহত নেজামের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল ও আটটি গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়। পুলিশ তদন্ত করে নিশ্চিত হয়েছে, এই অস্ত্রটি সম্প্রতি আগস্ট মাসে চট্টগ্রামের যে কোন একটি থানায় হামলার সময় লুণ্ঠিত অস্ত্রের অংশ।
সাতকানিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. জাহেদুল ইসলাম বলেন,
“নিহত ব্যক্তিদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া অস্ত্রটি সম্প্রতি থানায় হামলার সময় লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে একটি। এটি কিভাবে নেজামের হাতে এলো, কারা তাকে সরবরাহ করেছিল— তা আমরা খতিয়ে দেখছি।” সন্ত্রাসের শিকার নিরীহ মানুষ-
স্থানীয়দের অভিযোগ, নেজামের ক্যাডার বাহিনী দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন অসহায় পরিবারকে ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদা আদায় করত। এক প্রবাসী আবসারের পরিবার তার ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। নেজামের লোকজন আবসারের শালাকে অপহরণ করে আটকে রাখে এবং মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে এবং আবসারের একটি খরিদ কৃত জায়গা নেজামের নির্দশে মহিউদ্দিন ওসমান ও রিয়াদ দখল করেনিয়েছে, আবসার তাদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছে বলে আবসার দৈনিক ভোরের আওয়াজ পত্রিকাকে জানান। এছাড়াও, নেজাম একাধীক জমি দখল ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমে সরাসরি যুক্ত ছিল বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন,
তার বাহিনীর বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ থাকলেও রাজনৈতিক আশ্রয়ে সে রেহাই পেয়ে আসছিল। রাজনৈতিক আশ্রয়দাতারা কারা?
নেজাম বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় ছিল। সেই জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত, তার ফলে প্রশাসন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেরি করেছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
স্থানীয় রাজনীতিবিদ ইকবাল তারেক বলেন, মাহ্ফুজ ছিল নেজামের প্রতি পক্ষ, তার হচ্ছে সাবেক এমপি সামশুল ইসলামের অনুসারী অন্যদিকে নেজাম হচ্ছে শাহাজাহান চৌধুরীর অনুসারী,
“নেজাম দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় সন্ত্রাস চালিয়ে আসছিল। রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় থেকে সে বারবার পার পেয়ে যেত। এবার সাধারণ মানুষই তার বিচার করেছে।” গণপিটুনির পরও এলাকাজুড়ে আতঙ্ক , নেজামের মৃত্যুর পরও সাতকানিয়ায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। তার ক্যাডার বাহিনীর সদস্যরা আত্মগোপনে চলে গেছে, তবে স্থানীয়রা শঙ্কিত যে তারা আবার সংঘবদ্ধ হয়ে প্রতিশোধ নিতে পারে। পুলিশ জানিয়েছে, তারা এলাকায় অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে।
পুলিশ ও প্রশাসনের অবস্থান-
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম বলেন,
“এই ঘটনার তদন্ত চলছে। নেজামের সঙ্গে কারা কারা যুক্ত ছিল, কারা তাকে সহায়তা করত— তা আমরা খুঁজে বের করব। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়।” এদিকে, সাতকানিয়া থানায় এখনো কোনো মামলা হয়নি। তবে নিহতদের বিরুদ্ধে একাধিক পুরনো মামলা রয়েছে, যা নতুন করে তদন্তের আওতায় আনা হবে। নিহতদের জানাজা ও দাফন সম্পন্ন- মঙ্গলবার (৪ মার্চ) দুপুর ২টায় নিহতদের জানাজা শেষে নিজ নিজ পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। তবে তাদের পরিবারের সদস্যরা এখনো প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করেননি।
জনগণের দাবি: অপরাধীদের মূল হোতাদের আইনের আওতায় আনতে হবে
সাধারণ মানুষ বলছে, শুধু নেজামের মৃত্যু দিয়ে সমস্যার সমাধান হবে না। তার পিছনে থাকা মহিউদ্দিন, ওসমান ও রিয়াদ হোসেন ও অন্যান্য সহযোগীদের গ্রেপ্তার করতে হবে, যাতে এই ধরনের অপরাধচক্র আবার সংগঠিত হতে না পারে।
এলাকাবাসীর একজন বলেন,
“নেজাম তো শেষ, কিন্তু তার গডফাদাররা এখনো বাইরে। প্রশাসন যদি সত্যিই অপরাধ দমন করতে চায়, তাহলে তাদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে।”নেজাম বাহিনীর পতন সাতকানিয়ায় একটি বড় ঘটনা। তবে এই চক্রের শেকড় অনেক গভীরে। পুলিশের ওপর হামলা করে অস্ত্র লুট, নারী পাচার কারিদেরকে আশ্রাদাতা ও বিভিন্ন অপকর্মের সাথে জড়িত ছিল বলে প্রতিয়মান— এসবের সাথে আরো যারা জড়িত, তাদের সবাইকে বিচারের আওতায় আনা না হলে পরিস্থিতি আবারও খারাপ হতে পারে। এখন দেখার বিষয়, প্রশাসন কতটা কঠোর পদক্ষেপ নেয়।
প্রতিবেদকের মন্তব্য:
সাতকানিয়া জামায়াতের অন্যতম শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত, যেখানে তাদের উল্লেখযোগ্য ভোটব্যাংক রয়েছে। তবে কিছু সন্ত্রাসী ও অপরাধী চক্রের অপকর্মের কারণে দলটির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে, যা স্থানীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ জনগণ কেউই চান না। এ ধরনের ঘটনার সঠিক তদন্ত করা জরুরি, যাতে নিরীহ কেউ হয়রানির শিকার না হয় এবং প্রকৃত অপরাধীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিরপেক্ষভাবে প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা যায়।