চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমির পরিবেশ যেন সেদিন বদলে গিয়েছিল এক সুরেলা রঙধনুতে। ২২ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে অনুষ্ঠিত হলো স্বরলিপি সাংস্কৃতিক অঙ্গণের ১১তম বর্ষপূর্তি উৎসব। এই এক সঙ্গীত, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের মেলবন্ধনের গল্প, যা শুধুমাত্র একটি প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘ পথচলার স্মৃতি নয়; বরং চট্টগ্রামের মাটির ঘ্রাণ আর সুরের অনুরণনকে চিরকালীন রূপ দেয়ার এক অসাধারণ প্রয়াস।
বিকাল থেকেই শিল্পকলা একাডেমি ভরে উঠেছিল আমন্ত্রিত অতিথি, শিল্পী ও দর্শকদের উপস্থিতিতে। একদিকে জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন, অন্যদিকে সুরের ঐন্দ্রজালিক পরিবেশ—এ যেন এক আলোকোজ্জ্বল সাংস্কৃতিক অভিযাত্রার সূচনা। অনুষ্ঠানের শুরু থেকে সমাপ্তি: এক গানের গল্প অনুষ্ঠানের সূচনা হয় স্বরলিপির পরিচালক সামশুল হায়দার তুষারের প্রাণবন্ত বক্তব্যের মধ্য দিয়ে। তিনি সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, “এই ১১ বছরের যাত্রা শুধু আমাদের একক প্রচেষ্টা নয়; এটি সকলের ভালোবাসার ফসল। আজকের দিনটি আমাদের জন্য এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা।” উদ্বোধনী পর্বে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বরেণ্য বংশীবাদক ওস্তাদ ক্যাপ্টেন আজিজুল ইসলাম। তার সুরের যাদু যেন পুরো পরিবেশকে এক অন্য জগতে নিয়ে গেল। সিটি কপোরেশন এর মেয়র ডাক্তার শাহাদাত হোসেন প্রধান অতিথি হিসেব উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও তিনি কিন্তু সময়ের কারণে উপস্থিত হতে না পারলেও সেই সূরেলাতে যা বলেছেন-
“স্বরলিপি শুধু একটি সংগঠন নয়; এটি আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। আমি এর উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি।”৷ সাংস্কৃতিক পরিবেশনা: যেখানে সুরে বাঁধা স্মৃতি-
অনুষ্ঠানের মঞ্চে একের পর এক শিল্পীদের পরিবেশনায় মুগ্ধ হয়েছেন সবাই। ইকবাল হায়দার, মিলন তিথি, সোমা মূৎসুদ্দি প্রমুখ কণ্ঠশিল্পীদের গান, আবৃত্তি এবং নৃত্যের মাধুর্য দর্শকদের হৃদয়ে ছাপ ফেলে যায়। সংগীত ও নৃত্যের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল যেন এক আবেগময় যাত্রা। অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ ছিল স্বরলিপির ১১তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা “সুরেলা”। এই স্মরণিকার মোড়ক উন্মোচনের সময় হলভর্তি মানুষ হাততালিতে ফেটে পড়ে। স্মরণিকার প্রতিটি পৃষ্ঠা যেন চট্টগ্রামের সুর, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের এক চিরস্থায়ী রূপ। “সুরেলা”: চট্টগ্রামের সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি” -সুরেলা” স্মরণিকা ছিল এ উৎসবের প্রাণ। এর মধ্যে লেখা, ছবি এবং স্মৃতিচারণা মিলিয়ে চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক অমূল্য দলিল। স্মরণিকার প্রথমেই রয়েছে সুফি জগতের প্রাণপুরুষ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারির সুযোগ্য পুত্র সৈয়দ মোহাম্মদ হাসানের লেখা “কিছু কথা”। এছাড়া, “চাটগাঁইয়া গানের ঐতিহ্য: এক অমূল্য রত্নের অবলম্বন” শিরোনামে আমার লেখা ছিল এর অন্যতম আকর্ষণ। স্মরণিকায় আরও অনেক গুণী লেখকের লেখা সজ্জিত ছিল। সাংবাদিক আবসার উদ্দিন অলি লিখেছেন “আধুনিক গানের সময়কাল” শিরোনামে। সেলিম আকতার পিয়াল, শিরিন আকতার আইভি, জাহিদ তানছির, আরেফিন রিয়াদ এবং সাংবাদিক আশিফ ইকবালের লেখাগুলি স্মরণিকাকে অনন্য এক মর্যাদা দিয়েছে। স্মরণিকায় স্থান পেয়েছে আলহাজ্ব এস.এম. ফরিদ, সনজিত আচার্য্য এবং অনুপ পালিত রাসকের মতো গুণী শিল্পীদের স্মৃতিচারণা। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই স্মরণিকা উৎসর্গ করা হয়েছে।একটি নতুন স্বপ্নের সূচনা
এই বর্ষপূর্তি উদযাপন শুধুমাত্র একটি অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি ছিল আমাদের সুর, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের প্রতি ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধার এক নতুন সূচনা। অনুষ্ঠানের শেষে পরিচালক সামশুল হায়দার তুষার বলেন, “এই যাত্রা যেন থেমে না যায়। আগামীতে আমরা আরো বড় পরিসরে আমাদের সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দেব।”
শেষ কথা: যেখানে সুর বাঁধে আমাদের জীবন-স্বরলিপি সাংস্কৃতিক অঙ্গণের ১১তম বর্ষপূর্তি শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের উদযাপন নয়; এটি ছিল আমাদের ঐতিহ্যের প্রতি অঙ্গীকার। “সুরের মূর্ছনায় হোক স্বপ্ন গাঁথা নতুন সময়ের অভিযাত্রা”—এই শ্লোগান নিয়ে স্বরলিপি একটি নতুন যুগের পথপ্রদর্শক হয়ে রয়ে যাবে। আসুন, আমরা সবাই এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অংশ হই, সুরের মূর্ছনায় বাঁধি আমাদের জীবন, এবং চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাই।চাটগাঁইয়া গানের ঐতিহ্য: এক অমূল্য রত্নের অবলম্বন- চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক উজ্জ্বল দিক হলো চাটগাঁইয়া গান। এটি কেবল একটি সঙ্গীতধারা নয়; বরং এটি আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং জীবনের গভীর অভিব্যক্তির প্রতীক। চাটগাঁইয়া ভাষায় লেখা গানগুলোর প্রতিটি শব্দ, সুর এবং ছন্দ যেন এই অঞ্চলের প্রকৃতি, মানুষের আবেগ ও ঐতিহ্যের প্রতিধ্বনি। এর মাধুর্য অতুলনীয় এবং এর বৈচিত্র্য এক কথায় অমোঘ। চাটগাঁইয়া গান আমাদের শেকড়ের পরিচয় দেয়; এটি চট্টগ্রামের মাটির ঘ্রাণ এবং মানুষের জীবনযাত্রার চিত্রপট তুলে ধরে।
চাটগাঁইয়া গানের ইতিহাস শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বয়ে চলেছে। একসময় এই গানগুলি শুধু চট্টগ্রামের গ্রামাঞ্চলেই গীত হতো, আজ তা সারা দেশের মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। বিশেষত, চাটগাঁইয়া ভাষার গানগুলোর সুর এবং লিরিক্সে যে আন্তরিকতা, সরলতা এবং সুরের মাধুর্য রয়েছে, তা অন্য কোনো আঞ্চলিক গানে দেখা যায় না। এটি চট্টগ্রামের প্রকৃতির মতোই শান্ত, অথচ গভীর।
এক ঐতিহ্যের ক্ষয়- কিন্তু বর্তমান যুগে এই অমূল্য ঐতিহ্যের ওপর যেন এক মেঘের ছায়া পড়েছে। চাটগাঁইয়া গানের সেই সোনালি দিন আর নেই। নতুন প্রজন্মের মধ্যে এই ভাষার গান সৃষ্টি কিংবা পরিবেশনায় আগ্রহের অভাব স্পষ্ট। যদিও কিছু গান রচিত হচ্ছে, তাতে চাটগাঁইয়া ভাষার স্বকীয়তা এবং শুদ্ধতা বজায় থাকছে না। সাধু ভাষার অনুপ্রবেশ এবং আধুনিক ধাঁচের মিশ্রণে এই গানগুলোর নিজস্বতা হারিয়ে যাচ্ছে।
চাটগাঁইয়া ভাষার গান ছিল এ অঞ্চলের মাটির গন্ধমাখা, যা সরাসরি মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যেত। কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম সেই গানের গভীরতা এবং আন্তরিকতাকে যথাযথভাবে অনুভব করতে পারছে না। ফলে চাটগাঁইয়া গানের ঐতিহ্য একটি সংকটময় অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সংরক্ষণ ও পুনরুজ্জীবন: শিল্পীদের ভূমিকা চাটগাঁইয়া গানের ঐতিহ্য রক্ষা এবং এর সঠিক সংরক্ষণের জন্য গীতিকার, সুরকার এবং শিল্পীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। তাদের প্রচেষ্টাই পারে এই গানকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে নিয়ে যেতে। চাটগাঁইয়া ভাষার গানের মূল সৌন্দর্য বজায় রাখতে হলে ভাষার শুদ্ধতা এবং সুরের গভীরতাকে গুরুত্ব দিতে হবে।
চাটগাঁইয়া ভাষায় গান রচনা, সুর তৈরি এবং পরিবেশনা এক বিশেষ দক্ষতার দাবি রাখে। চট্টগ্রামের মাটি এবং মানুষের সাথে গভীরভাবে যুক্ত না থাকলে এই গানগুলোর মাধুর্য এবং অনুভূতি ফুটিয়ে তোলা অসম্ভব। অন্য কোনো অঞ্চলের গীতিকার বা সুরকার হয়তো চাটগাঁইয়া ভাষার গান লিখতে পারেন, কিন্তু এর মূল অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য তারা তুলে ধরতে পারবেন না।
চাটগাঁইয়া গানের অনন্যতা চাটগাঁইয়া ভাষার গানে যে আন্তরিকতা, সরলতা এবং মাধুর্য রয়েছে, তা অন্য কোনো আঞ্চলিক গানেই দেখা যায় না। এই গানগুলোতে রয়েছে চট্টগ্রামের জীবনের ছবি, গ্রামীণ প্রকৃতির রূপ এবং মানুষের আনন্দ-বেদনার গল্প। চাটগাঁইয়া গান শুধুমাত্র একটি সাংস্কৃতিক ধারাই নয়, এটি আমাদের গর্ব এবং আত্মপরিচয়ের প্রতীক। চাটগাঁইয়া গান আমাদের ঐতিহ্য, যা একাধারে অতীতের স্মৃতি, বর্তমানের সত্য এবং ভবিষ্যতের আশা। এই গান আমাদের জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। এটি আমাদের শেকড়ের কথা মনে করিয়ে দেয়, আমাদের ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা জাগায়। শেষ কথা: চাটগাঁইয়া গানের ভবিষ্যৎ
চাটগাঁইয়া গানের ঐতিহ্য এক অমূল্য রত্ন। আমরা যদি এই গানকে সঠিকভাবে সংরক্ষণ এবং পুনরুজ্জীবিত করতে পারি, তবে এটি কেবল চট্টগ্রামের মানুষের গর্ব নয়, সারা দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে উঠবে।
এখন সময় এসেছে এই ঐতিহ্যকে পুনর্জীবিত করার। আমরা যদি আমাদের শিল্পীদের উৎসাহ দিই, চাটগাঁইয়া ভাষায় গান লেখার এবং পরিবেশনার সুযোগ তৈরি করি, তবে এই গান চিরকালীন হয়ে থাকবে।
চাটগাঁইয়া গানের এই মাধুর্য এবং ঐতিহ্য আমাদের হৃদয়ে জাগ্রত হোক, সুরের মূর্ছনায় ভরে উঠুক আমাদের জীবন। আসুন, আমরা সবাই মিলে এই অমূল্য সম্পদ রক্ষা করি এবং চাটগাঁইয়া গানকে আগামী প্রজন্মের জন্য এক উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে রেখে যাই।
লেখকঃ যুগ্ম সম্পাদক-দৈনিক ভোরের আওয়াজ ওThe Daily banner, গবেষক, এবং টেলিভিশন উপস্থাপক