খালেদা জিয়ার মুক্তি, শেখ হাসিনার নির্বাসন এবং ইতিহাসের শিক্ষা
বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার দ্বন্দ্ব, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ক্ষমতা সংগ্রাম এবং প্রতিহিংসার অধ্যায়গুলো এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতার মোড় পরিবর্তন হয়, রাজনীতির চালচিত্র পাল্টে যায়। একসময় যিনি প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার চেষ্টা করেন, তিনি নিজেই পরাজিত হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এই বাস্তবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে বর্তমান বাংলাদেশ— যেখানে একসময় কারাবন্দি খালেদা জিয়া আজ মুক্ত এবং লন্ডনে উন্নত চিকিৎসা নিচ্ছেন, আর যিনি একসময় তাঁকে চিকিৎসার সুযোগ না দিয়ে নির্দয়তা দেখিয়েছিলেন, সেই
শেখ হাসিনা আজ নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন ভারতে।
আসিফ নজরুল: কলমের শক্তিতে সত্যের উন্মোচন
আসিফ নজরুল—একজন সাহসী লেখক, গবেষক, আইনবিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং মানবাধিকারের নিরলস কর্মী।
জন্ম ১৯৬৬ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক। ১৯৯৯ সালে লন্ডন থেকে আন্তর্জাতিক আইনে পিএইচডি অর্জন করেন।
জার্মানি ও ইংল্যান্ডে পোস্টডক্টরাল ফেলো হিসেবে কাজ করেন।
একসময় সাপ্তাহিক বিচিত্রায় সাংবাদিক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। তাঁর রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ও সাহসী কলাম বহুবার বাংলাদেশকে সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। উপন্যাস ও গবেষণাগ্রন্থে সমান জনপ্রিয়, “নিষিদ্ধ কয়েকজন,” “অসমাপ্তির গল্প,” “পিএইচডির গল্প,” “মানবাধিকার”—এসব বই পাঠকদের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। তবে তাঁর সবচেয়ে আলোচিত ভূমিকা ছিল ২০২১ সালে, যখন তিনি শেখ হাসিনাকে অনুরোধ করেছিলেন মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ দিতে।
তিনি বলেছিলেন—
“আইন মানুষের জন্য, আইনের জন্য মানুষ নয়।”
কিন্তু শেখ হাসিনা সেই অনুরোধে কর্ণপাত করেননি। খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা তখন ভয়াবহ ছিল, তবুও তাঁকে বিদেশে যেতে দেওয়া হয়নি।
শেখ হাসিনার ক্ষমতা হারানো ও খালেদা জিয়ার মুক্তি
২০২৪ সালের নির্বাচনের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলে যায়। নির্বাচন বিতর্কিত হয় এবং জনগণের মধ্যে ক্ষোভ চরমে পৌঁছায়।
আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ শুরু হয়।
আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে থাকে।
শেখ হাসিনা ক্ষমতা হারিয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন এবং ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা আত্মগোপনে চলে যান, অনেকেই দেশ ছেড়ে পালান।
অন্যদিকে, আইন উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর আসিফ নজরুল আইনের ভিত্তিতে খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে মুক্তি দেন এবং উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
ইতিহাসের শিক্ষা: ক্ষমতার আসল মালিক
আল্লাহ এবং জনগণ
এই ঘটনাপ্রবাহ থেকে আমরা যে শিক্ষা পাই তা স্পষ্ট—
ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়: ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে, কোনো নেতা বা দল চিরকাল ক্ষমতায় থাকতে পারে না।
মানবিকতা সবকিছুর ঊর্ধ্বে: রাজনীতির নামে প্রতিহিংসা করলে একদিন তার প্রতিশোধ হয়।
প্রতিহিংসার রাজনীতি শেষ পর্যন্ত ব্যুমেরাং হয়: খালেদা জিয়ার ওপর শেখ হাসিনার যে নির্মম আচরণ ছিল, আজ সেটাই তাঁর নিজের জীবনে বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে। জনগণের রায়ই চূড়ান্ত: ক্ষমতার আসল মালিক জনগণ। জনগণ যখন রায় দেয়, তখন কেউ তা বদলাতে পারে না।
শেখ হাসিনা যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন তিনি প্রতিহিংসার রাজনীতি করেছেন, মানবিকতা দেখাননি। কিন্তু আজ ইতিহাসের প্রতিশোধ পরিপূর্ণ হয়েছে—যে খালেদা জিয়া একসময় কারাবন্দি ছিলেন, তিনি আজ মুক্ত, আর শেখ হাসিনা নিজের দেশ ছেড়ে বিদেশে নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। আসিফ নজরুলের লেখা আজ বাস্তবে পরিণত হয়েছে। তিনি একসময় মানবিকতা ও আইনের কথা বলেছিলেন, আজ সেই মানবিকতা বাস্তবায়িত হয়েছে।
এই সত্য চিরন্তন—আল্লাহর বিধানই শেষ কথা। কে কখন বাদশাহ হবে, কে কখন ফকির হবে—তা একমাত্র তিনিই জানেন।
##বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া একে অপরের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু একসময় তাঁরা ছিলেন একে অপরের সহযোগী, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে একসঙ্গে আন্দোলন করেছেন। পরে সময়ের পরিক্রমায় এই সম্পর্ক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, বিরোধ ও সংঘাতের দিকে মোড় নেয়।
তবে ইতিহাসের আশ্চর্য খেলায় একসময় যিনি ক্ষমতার শীর্ষে ছিলেন, তিনি ক্ষমতা হারিয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, আর যিনি একসময় কারাবন্দি ছিলেন, তিনি আজ মুক্তভাবে বিদেশে উন্নত চিকিৎসা নিচ্ছেন। আসিফ নজরুল ২০২১ সালের ২৬ নভেম্বর প্রথম আলোতে যে লেখা লিখেছিলেন, আজ তার প্রতিটি লাইন যেন বাস্তবতার ছায়া হয়ে ফিরে এসেছে।
দুই নেত্রীর অতীত সম্পর্ক ও যৌথ আন্দোলন
নব্বইয়ের দশকে সামরিক শাসক এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া একসঙ্গে মাঠে নামেন। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁরা একসঙ্গে আন্দোলন চালান, যার ফলে এরশাদের পতন ঘটে এবং দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।
এরপরও ২০০৭ সালে এক-এগারোর সময় যখন দুই নেত্রীই বন্দী হন, তখনও একে অপরের প্রতি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দেখা গিয়েছিল।
শেখ হাসিনা যখন বন্দী ছিলেন, খালেদা জিয়া তাঁর মুক্তির দাবি করেছিলেন।
পরে খালেদা জিয়াও বন্দী হলে, শেখ হাসিনা তাঁর জন্য খাবার পাঠিয়েছিলেন।
পারিবারিক অনুষ্ঠানেও তাঁদের মধ্যে সৌহার্দ্য বজায় ছিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সম্পর্ক শত্রুতায় রূপ নেয়। একসময় যাঁরা একসঙ্গে গণতন্ত্রের জন্য লড়েছিলেন, তাঁরাই পরবর্তীতে একে অপরের বিরুদ্ধে রাজনীতিকে প্রতিহিংসার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
খালেদা জিয়ার ওপর শেখ হাসিনার রাজনৈতিক হয়রানি
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর খালেদা জিয়ার ওপর নানা ধরনের হয়রানি শুরু হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা হলো—
বাড়ি থেকে উচ্ছেদ: ২০১০ সালে সেনানিবাসের বাড়ি থেকে খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদ করা হয়, যা তিনি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর থেকেই ব্যবহার করছিলেন।
বিতর্কিত বিচার: ২০১৮ সালে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় দুর্নীতির অভিযোগ এনে তাঁকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
জেলের অমানবিক অবস্থা: কারাবাসের সময় খালেদা জিয়ার চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত নাজুক, যা তাঁর স্বাস্থ্যের আরও অবনতি ঘটায়।
বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি না দেওয়া: ২০২১ সালে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় খালেদা জিয়া বিদেশে উন্নত চিকিৎসার আবেদন করলেও সরকার অনুমতি দেয়নি।
আইনমন্ত্রী তখন বলেছিলেন, আইনে সুযোগ নেই। অথচ আসিফ নজরুলসহ অনেক আইন বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন, “আইন মানুষের জন্য, আইনের জন্য মানুষ নয়। আইন বিশেষ আদেশের মাধ্যমে পরিবর্তন করা যেত।”
শেখ হাসিনার পরিণতি: ইতিহাসের প্রতিশোধ? ২০২৪ সালের নির্বাচনের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে বদলে যায়। নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে বিতর্ক সৃষ্টি হয়, গণবিক্ষোভ চরমে ওঠে, এবং জনগণের চাপের মুখে শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। শেষ পর্যন্ত, পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে শেখ হাসিনাকে দেশ ছাড়তে হয়। আজ তিনি ভারতে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন, যেখানে তিনি অতীতের প্রতিশোধ, ক্ষমতা হারানোর কষ্ট, এবং অনুশোচনার গ্লানি নিয়ে জীবনযাপন করছেন।
অন্যদিকে, যিনি একসময় কারাবন্দি ছিলেন, সেই খালেদা জিয়া আজ লন্ডনে উন্নত চিকিৎসা নিচ্ছেন এবং তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন আলোচনা শুরু হয়েছে,
আসিফ নজরুলের সেই লেখা ও আজকের বাস্তবতা
২০২১ সালে আসিফ নজরুল লিখেছিলেন”এ দেশে রাজনৈতিক ইতিহাসে তিক্ততা, হিংসা ও প্রতিহিংসার বহু নজির রয়েছে। চিরস্থায়ী বিতর্ক ও বিরোধের উপজীব্য হয়ে আছে বহু ঘটনা। সুচিকিৎসা না পেয়ে খালেদা জিয়ার চরম কিছু ঘটলে এটিও তেমন একটি ঘটনা হিসেবে থাকবে।” শেখ হাসিনা তখন মানবিক হতে পারেননি। কিন্তু আজ তিনি নিজেই ভিন্ন বাস্তবতার মুখোমুখি।
এই ঘটনা থেকে আমাদের শেখার বিষয়, ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়: রাজনীতিতে কেউই চিরদিন শাসক থাকে না। একদিন যিনি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন, অন্যদিন তিনিই হয়ে যেতে পারেন রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী।
মানবিকতা গুরুত্বপূর্ণ: প্রতিপক্ষের প্রতি মানবিক আচরণ দেখালে ভবিষ্যতে নিজেও তার সুফল পেতে পারেন।
প্রতিহিংসার রাজনীতি ক্ষতিকর: প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার চেষ্টাই শেষ পর্যন্ত নিজের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে। জনগণের রায়ই চূড়ান্ত: জনগণের সমর্থন ছাড়া কোনো নেতা ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেন না।
একসময় খালেদা জিয়ার প্রতি মানবিক আচরণের জন্য যে আবেদন করা হয়েছিল, আজ সেই ইতিহাস শেখ হাসিনার জন্য শিক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতির মঞ্চে ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, প্রতিদ্বন্দ্বিতা সবই ক্ষণস্থায়ী। ইতিহাস তার নিজের নিয়মেই প্রতিশোধ নেয়।
আজকের বাস্তবতা আমাদের মনে করিয়ে দেয়— কে কখন বাদশাহ, আর কে কখন ফকির হবে, তা একমাত্র আল্লাহই জানেন।
লেখকঃ যুগ্ম সম্পাদক ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় ব্যুরো প্রধান-
দৈনিক ভোরের আওয়াজ ও The Daily Banner,