প্রযুক্তির এই দুনিয়া আমাদের জীবনকে বদলে দিয়েছে, নিঃসন্দেহে সহজ করে দিয়েছে অনেক কিছু। দূরত্বকে কাছাকাছি নিয়ে এসেছে মোবাইলের ছোট্ট পর্দা। কিন্তু এই পরিবর্তনের আড়ালে, কোথাও যেন আমরা খুঁজে পাচ্ছি এক বিষণ্নতা, এক শূন্যতা, যা আসলে আমাদের সম্পর্কগুলোকে দিন দিন অনিশ্চিত করে তুলছে। এই কথাটিই যেন জীবন্ত হয়ে ধরা দিল গত ৮ নভেম্বর, বড় মেয়ের জন্মদিনে। স্টেডিয়ামের পশ্চিম কর্ণার আমার শালা সারোয়ারের “PriOlento Restaurant & Cafe”বসে আছি আমি আর আমার স্ত্রী ও আমার দুই মেয়ে। আমার বউ পাশে বসে আছে সে, কিন্তু আমার দিকে তার কোন নজর নেই। আমিও নিজের মোবাইলের পর্দায় ততটাই মগ্ন – একটা লেখা সম্পাদনা করছিলাম পত্রিকায় পাঠানোর জন্য।
মনে হলো, এই তো আমাদের জীবনের একটি সত্যিকার প্রতিচ্ছবি! একে অপরের এত কাছাকাছি বসে আছি, অথচ মন যেন এক অদৃশ্য দেয়ালে আড়াল হয়ে আছে। আমাদের যে সম্পর্ক একদিন চোখে চোখ রেখে মধুর আলাপ, হাসির রোল আর মায়াবি উষ্ণতায় ভরে উঠত, আজ তার পরিবর্তে মোবাইলের আলোয় হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের হৃদয়ের সেতু যেন ক্রমশ ম্লান হয়ে যাচ্ছে প্রযুক্তির পর্দায় আটকে।
একটা সময় ছিল, যখন এই রকম মুহূর্তগুলোতে আমরা গল্পে মশগুল হতাম, স্মৃতিচারণা করতাম বা ভবিষ্যতের স্বপ্ন আঁকতাম। কথা বলার মুহূর্তগুলো ছিল খুব স্বতঃস্ফূর্ত আর গভীর। আজ সেই জায়গায় যেন এক অদ্ভুত নীরবতা, যেখানে আমরা সবাই থাকি, কিন্তু আর নিজেদের মধ্যে থাকতে পারি না। আমাদের প্রতিটি অনুভূতি, আমাদের আবেগ, যেগুলো একসময় খুব সাধারণভাবে একে অপরের মাঝে ভাগাভাগি করতাম, আজ সেগুলো মোবাইলের আড়ালে লুকিয়ে থাকে। এভাবে আমাদের জীবন এক রকম একাকীত্বে ভরে উঠছে। মোবাইলের সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত হয়তো প্রয়োজনের ছদ্মবেশে আসে, কিন্তু তাতে হারিয়ে যায় এমন অনেক অনুভূতি, যা একান্ত নিজেদের ছিল। সম্পর্কের মাধুর্য, কথার মায়া, একে অপরকে বোঝার চেষ্টা – সবই যেন মোবাইলের আলোর নিচে ফিকে হয়ে যায়। এই আসক্তি আমাদের হৃদয়ের গভীর টানগুলোকে দূরে সরিয়ে দেয়, দেয়াল তোলে সেই মানুষের মাঝেই যার কাছে আমরা সবকিছু উজাড় করে দিতে চেয়েছিলাম। তবে কি এই মোবাইলই আমাদের সম্পর্কগুলোকে একরকম বন্ধনের জাল থেকে মুক্তি দিয়ে ভঙ্গুর করে দিচ্ছে? কতটা না মায়া এই ছোট্ট পর্দায়, যে এত আপন মুহূর্ত, এত কথা, এত অনুভূতিকে চুরি করে নিচ্ছে আমাদের চোখের সামনে থেকেই! একসময় হয়তো আমরা নিজেদেরই আবিষ্কার করব এক অচেনা ভিড়ে, যেখানে কাছের মানুষ আছে, কিন্তু সেই স্নেহ, সেই আন্তরিকতা, সেই প্রাণের স্পর্শ যেন কোথাও নেই। মোবাইলের এই মায়ার আলো, এই স্বপ্নজাল থেকে কি বেরিয়ে আসতে পারব আমরা? নিজের ভালোবাসার মানুষকে, তার স্পর্শকে, তার মায়াকে কি আমরা আবার ফিরে পাব? হয়তো সময়ই এর উত্তর দেবে। কিন্তু এতটুকু বলতে পারি, আমাদের অন্তরের দূরত্ব আজ যদি আমরা কাটিয়ে না উঠি, তবে সেই সম্পর্কগুলোকে আমরা প্রতিদিন আরও একা করে তুলব, যেখানে হয়তো মোবাইল থাকবে – কিন্তু মানুষের হৃদয়ের স্পর্শ থাকবে না। সম্পর্কের উষ্ণতাকে ফিরিয়ে আনার জন্য হয়তো প্রয়োজন একটু সময়, একটু বোঝাপড়া আর অনেকখানি চেষ্টা। তবে মোবাইলের এই মায়াবী আলোকে দূরে ঠেলে অন্তরের নিবিড়তা, গভীরতা আর ভালোবাসাকে ফিরিয়ে আনতে পারলে, তবেই হয়তো এই আধুনিক জীবনের আসক্তি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারব আমরা।