আষাঢ়ের এক স্নিগ্ধ সন্ধ্যা
আকাশজুড়ে মেঘের আনাগোনা, বাতাসে জলের গন্ধ—ঠিক যেন সদ্য লেখা একটি কবিতা, যার প্রতিটি পঙ্ক্তিতে আর্দ্রতা, প্রত্যাশা আর একরাশ নৈঃশব্দ্যের শিহরণ। চট্টগ্রামের পুরনো শহরের বুকজুড়ে বয়ে চলা এই সন্ধ্যায়, বলাকা প্রকাশনের ঘরে আলো জ্বলে উঠল বইয়ের পাতায়, চোখের তারায়, আর কিছু অমলিন স্মৃতির জলছবিতে।
সেখানে মিলিত হয়েছেন তিন সাহিত্যপ্রাণ, তিন ভিন্ন স্বরের যোদ্ধা—তবু এক স্বপ্নের সুরে বাঁধা তাদের হৃদয়।
গবেষক লেখক জামাল উদ্দিন, ইতিহাসের পাতায় যিনি খুঁজে ফেরেন জাতির অগোচর দিনলিপি, যিনি শব্দের শরীরে গেঁথে রাখেন সময়ের প্রতিচিহ্ন। সঙ্গে আছেন সাংবাদিক লেখক মহসিন কাজী, যাঁর কলম যেন সমকালীন জীবনের স্পষ্ট প্রতিবিম্ব—সত্য ও সাহস যার লেখার মূলভিত্তি। আর আছেন প্রাজ্ঞ চিন্তক ও লেখক মাওলানা ইকবাল ইউসুফ, যিনি ধর্ম, সমাজ ও রাজনীতিকে এক অভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন, ভাবেন, লিখে ফেলেন নিঃশব্দ ঝড়ের মতো করে। তিনজন মুখোমুখি, আর মাঝখানে এক পুরনো চায়ের কেটলি—যার ধোঁয়া উড়ছে ঠিক আষাঢ়ের মেঘের মতো, ভারী, ধীর, প্রগাঢ়। ডালপুরির সুবাস ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে, যেন হারিয়ে যাওয়া ছাত্রজীবনের কোন বিকেল ফিরিয়ে আনে।
স্মৃতির দরজা খুলে পড়ে গেল নানা দিন, নানা রাতের ইতিহাস।—“সেই সময়টায় কলম চালানো মানে ছিল জীবন বাজি রাখা,” বললেন জামাল উদ্দিন, চোখে পুরনো দিনের ঝলক। —“আর এখন?” প্রশ্ন করলেন মহসিন কাজী, “লেখা মানে দায়িত্ব। ইতিহাসের কাছে দায়বদ্ধতা।” মৃদু হেসে মাওলানা ইকবাল ইউসুফ বললেন, “আমরা লিখি কারণ আমরা নিঃশ্বাস নিতে চাই। সত্যকে ভালোবাসি বলেই কলম হাতে নিই।” আড্ডাটা শুধু কথোপকথন ছিল না, ছিল আত্মার নিরব সংলাপ। একদিকে সাহিত্য, অন্যদিকে ইতিহাস—আর তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল বন্ধুত্ব, শ্রদ্ধা ও এক অদৃশ্য মানবিক বন্ধন। চায়ের কাপ বদলেছে, কথার ধারা ঘুরেছে সাহিত্যে, সমাজে, রাজনীতিতে—তবে যা অপরিবর্তনীয়, তা হলো তাদের অভিন্ন চেতনা: কলমকে সজীব রাখা, বাক্যকে সত্যের দীপ্তিতে দীপ্ত করা।
আষাঢ়ের সন্ধ্যা আরও গাঢ় হয়ে এলে আলো জ্বলে উঠল মনজুড়ে—বলাকা প্রকাশনের ছোট্ট কক্ষে যেন বসে আছে সময় নিজেই, মাথায় আলোর মালা পরে, হাতে এক খোলা খাতা নিয়ে। তিনজন লেখক, তিনটি আলাদা পথ—তবু আজ সন্ধ্যায় তারা যেন এক দৃষ্টির রূপরেখা হয়ে উঠেছেন।এই আড্ডা শুধু একটি মুহূর্ত নয়, এটি হয়ে থাকল এক অনন্য রাত্রির স্মারক— যেখানে চা ছিল বাহানা, ডালপুরি ছিল সংযোগসূত্র, আর কথারা ছিল কবিতার মতো—প্রবাহমান, প্রাণবান, চিরকালীন।