“চেরাগি পাহাড়: ইতিহাস, সংস্কৃতি ও স্মৃতির আলোয় দীপ্ত এক চট্টগ্রাম, আর তার পুনর্জাগরণের নেপথ্যনায়ক মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দীন”
চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এক নাম—চেরাগি পাহাড়। শুধু একটি মোড় নয়, এটি চট্টগ্রামের ইতিহাস, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সাংবাদিকতার প্রাণভোমরা। জামালখান ও মোমিন রোডের সংযোগস্থলে এই জায়গাটি চট্টগ্রামের কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, নাট্যকার, শিল্পী, লেখক, সংস্কৃতিকর্মী ও পাঠকদের এক মিলনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। প্রতিদিন বিকেলে এই স্থানটি যেন হয়ে ওঠে এক মুক্তচিন্তার আঙিনা, যেখানে শব্দে শব্দে তৈরি হয় প্রতিদিনের চট্টগ্রাম।
চেরাগি পাহাড় নামটির পেছনে রয়েছে এক অলৌকিক কিংবদন্তি। ১৪ শতকে আরব থেকে ইসলাম প্রচারে আগত সুফি সাধক বদর আউলিয়া এক পাথরের ওপর আরোহন করে এগারোজন দরবেশসহ চট্টগ্রামে আগমন করেন। তিনি এক জনমানবহীন পাহাড়ে তার অলৌকিক চেরাগ হাতে উঠে গেলে জ্বীন-পরীরা তাকে বাধা দেয়। বদর আউলিয়া চেরাগ রেখে ফিরে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে সেই চেরাগের তেজে জ্বীন-পরীরা স্থান ত্যাগ করে। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে জনবসতি, আর পাহাড়টির নাম হয় চেরাগি পাহাড়। এখান থেকেই ‘বারো আউলিয়ার দেশ’ নামে চট্টগ্রামের একটি ঐতিহ্য গড়ে ওঠে।
এই পাহাড়টিকে কেন্দ্র করে তৈরি হয় এক সাংস্কৃতিক চেতনার কেন্দ্র। এখানেই রয়েছে চট্টগ্রামভিত্তিক প্রধান সংবাদপত্র দৈনিক আজাদীসহ বহু পত্রিকার কার্যালয়। আছে লিটল ম্যাগাজিন, সাংস্কৃতিক সংগঠন, বইয়ের দোকান, ছাপাখানা, প্রকাশনা সংস্থা, হকার সমিতি, টেলিভিশন চ্যানেলের অফিস এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। চেরাগি পাহাড়ে কেবল গঠিত হয়নি সাহিত্যচর্চার পরিমণ্ডল, এখানে দাঁড়িয়ে থেকেছে শহরের বিবেক।
কিন্তু আজ যে নান্দনিক, সুসজ্জিত, সম্মানজড়িত চেরাগি পাহাড় আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে—তা ছিল না সবসময়। একসময় এই জায়গাটি ছিল ঝোপঝাড়ে ঢেকে থাকা, অবহেলিত ও জনমানববিচ্ছিন্ন। এর পুনর্জাগরণ ঘটেছিল এক সাহসী নেতৃত্বের মাধ্যমে—তিনি হলেন মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দীন, যিনি ১৯৯১ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন। মেয়র নাছির উদ্দীনের দৃষ্টিশক্তি, রুচিবোধ ও ঐতিহাসিক মূল্যবোধের সম্মিলনেই এই ঝোপঝাড়পূর্ণ জায়গাকে রূপান্তরিত করা হয় এক আধুনিক স্মৃতিস্তম্ভে। তিনি উদ্যোগ নেন এখানে একটি চেরাগের প্রতিকৃতি, বাগান, বসার স্থানসহ সুসজ্জিত নান্দনিক কেন্দ্র গড়ে তোলার। তাঁর এই দূরদর্শিতায় জন্ম নেয় আধুনিক চেরাগি পাহাড়। ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে একই বিন্দুতে মিলিয়ে তিনি এ স্থানকে গড়ে তোলেন চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক হৃদয়স্থলে। আমার ব্যক্তিগত স্মৃতির পাতায়ও চেরাগি পাহাড় এক আবেগের নাম। আমি তখন ছাত্র সংগ্রাম কমিটির সভাপতি। আমরা চট্টগ্রামে পৃথক শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন করছিলাম। আমাদের আন্দোলনের খরচ জোগাড়ের জন্য সিটি করপোরেশন থেকে চেরাগি পাহাড়ের নকশা সংগ্রহ করে একটি ক্যালেন্ডার ছাপিয়ে রাস্তায় রাস্তায় বিক্রি করি। তখনো স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মিত হয়নি, কিন্তু নাছির উদ্দীনের উন্নয়ন পরিকল্পনা আমাদের অনুপ্রাণিত করেছিল।
৯ জুলাই ১৯৯৪ সালে আমরা পৃথক শিক্ষা বোর্ডের দাবিতে চট্টগ্রামজুড়ে হরতাল আহ্বান করি। তার আগে ২ জুন আমি চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে হরতালের ঘোষণা দিই। আবার ৩০ ডিসেম্বর ১৯৯৪ সালে “বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির” সম্মেলনের সূচনা হয় এই চেরাগি পাহাড়ে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে। সেই সম্মেলনের প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন মাননীয় মন্ত্রী আব্দুল্লাহ আল নোমান। এই চেরাগি পাহাড়েই সমাহিত আছেন চারজন বীর মুক্তিযোদ্ধা—বদিরুজ্জামান চৌধুরী, জাফর আহমেদ, দীপক বড়ুয়া ও মাহবুবুল আলম চৌধুরী। তাঁদের পাশে ঘুমিয়ে আছেন আরও অনেক অজানা সংগ্রামী আত্মা।
আজ যখন আমরা চেরাগি পাহাড়ের ছায়ায় দাঁড়িয়ে সাহিত্য, সংস্কৃতি, সাংবাদিকতা ও স্বাধীনতার চেতনা নিয়ে ভাবি, তখন একজন মানুষের কথা না বললেই নয়—তিনি হচ্ছেন মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দীন। যদি তিনি সেই সময় ঝোপঝাড় ভেদ করে একটি আধুনিক চেরাগি পাহাড় নির্মাণে সাহসী ভূমিকা না নিতেন, তবে হয়তো আজকের এই আলোকিত ঠিকানা থাকত না।
এই মহান উদ্যোগের জন্য আমি চট্টগ্রামবাসীর পক্ষ থেকে মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দীনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। তাঁর মতো মানুষেরা ইতিহাসের পৃষ্ঠায় শুধু নাম নয়, আলোর রেখা হয়ে থাকেন।
চট্টগ্রামের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও আন্দোলনের প্রতীক চেরাগি পাহাড় আজ শুধুই একটি স্থান নয়, এটি এক প্রজন্মের সংগ্রামের, সাহসের, শিল্পের ও স্বপ্নের স্মৃতিচিহ্ন।
লেখকঃ সাংবাদিক গবেষক টেলিভিশন উপস্থাপক ও সাবেক সভাপতি বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন ছাত্র সংগ্রাম কমিটি।