একজন মানুষ, যিনি শুধু একজন আবৃত্তিকার নন; শুধু একজন উপস্থাপক নন; শুধু একজন লেখক, সাংবাদিক, নাট্যকার কিংবা সংগীতশিল্পীও নন— তিনি যেন একটি চলমান শিল্পজগত, একটি বহুমাত্রিক প্রতিভার নাম। তিনি হলেন দিলরুবা খানম। এই নামটি আমাদের সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে শুধু একটি পরিচয় নয়, বরং এক গভীর ভালোবাসা, এক নির্মল শ্রদ্ধা, এবং এক নিঃসঙ্গ পথে নিজের অদম্য প্রচেষ্টায় নিজেকে তৈরি করে তোলার এক বর্ণাঢ্য ইতিহাস।
দিলরুবা খানম— এক বিস্ময়। আন্তর্জাতিক মানের আবৃত্তিকার ও উপস্থাপিকা হিসেবে তাঁর পরিচিতি দীর্ঘদিন ধরে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বমঞ্চেও বিস্তার লাভ করেছে। আমরা যারা তাঁকে চিনি, জানি কিংবা তাঁর কণ্ঠে আবৃত্তি শুনে কেঁদে উঠেছি বা হাততালি দিয়ে অনুষ্ঠান মাতিয়েছি— তারা জানি, এই মানুষটি যেন এককভাবে একটি সাংস্কৃতিক ইতিহাস বহন করে চলেছেন।
তার জীবনের আদি ঠিকানা ঢাকায় হলেও, চট্টগ্রামই তাঁর দ্বিতীয় জন্মভূমি, যেখানে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে এই অঞ্চলকে আলোকিত করেছেন। কিন্তু ইতিহাস শুধুই তাঁর পঠনের বিষয় নয়, বরং তিনিই নিজে এখন এক জীবন্ত ইতিহাস হয়ে উঠেছেন। তাঁর প্রতিভার পরিধি এতটাই বিস্তৃত যে একে একখণ্ড মহাকাব্য না বলে উপায় নেই। শুধু একটি মাইক্রোফোন, একটি মঞ্চ, আর তাঁর কণ্ঠ— তাহলেই পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে কবিতা। কবিতাকে যিনি নিজের শরীর ও আত্মায় ধারণ করেন, আবেগ ও বাক্যকে একাকার করে মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে দিতে পারেন— তিনি হলেন দিলরুবা খানম। তাঁর মুখস্থ কবিতার সংখ্যা শত শত। বিশেষ করে কাজী নজরুল ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনন্য সৃষ্টি— ‘বিদ্রোহী’ থেকে ‘রক্তকরবী’ কিংবা ‘অগ্নিবীণা’র থেকে ‘গীতাঞ্জলি’— সব যেন তাঁর কণ্ঠে এক নতুন প্রাণ পায়।
শুদ্ধ উচ্চারণ, সুরেলা ভঙ্গি এবং আবেগময় কণ্ঠে তার আবৃত্তি যেন শ্রোতাদের হৃদয়ের তারে সরাসরি আঘাত করে। তিনি শুধু কবিতা বলেন না, তিনি সেই কবিতাকে বাঁচিয়ে তোলেন।
একজন সফল উপস্থাপিকা শুধু অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন না— তিনি একটি অনুষ্ঠানকে প্রাণবন্ত করে তোলেন, দর্শকদের মনোযোগ ধরে রাখেন, এবং অতিথি ও দর্শকদের মধ্যে একটি মেলবন্ধন তৈরি করেন। দিলরুবা খানম এই দায়িত্ব এতটা নিখুঁতভাবে পালন করেন যে, যেকোনো অনুষ্ঠান যেন তাঁর জন্য অপেক্ষা করে থাকে।
৬৬টির বেশি সম্মাননা পেয়েছেন কেবল উপস্থাপনার জন্য। সরকারি তালিকাভুক্ত পেশাদার উপস্থাপিকা হিসেবে তিনি প্রমাণ করেছেন, দক্ষতা ও দায়িত্ববোধ নিয়ে কাজ করলে একজন উপস্থাপিকাও অনুষ্ঠানের মুখ্য ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠতে পারেন।
২০০২ সাল থেকে তাঁর লেখালেখির শুরু হলেও সেই ২০০০ সালেই তিনি ফটোগ্রাফি কোর্স সম্পন্ন করেন। সাহিত্যের প্রতি তাঁর ভালোবাসা জন্মগত। তাঁর লেখা বইয়ের সংখ্যা তিনটি— প্রতিটি বইয়ে ফুটে উঠেছে তাঁর চিন্তার গভীরতা, সমাজের প্রতি তাঁর মমত্ববোধ, এবং মননশীল দৃষ্টিভঙ্গি।
একজন সাংবাদিক হিসেবে তাঁর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা এবং সত্য প্রকাশে নির্ভীকতা, একজন নাট্যকার হিসেবে তাঁর সংলাপ নির্মাণ এবং মানবিক প্রেক্ষাপটের বুনন, সবমিলিয়ে দিলরুবা খানম হয়ে উঠেছেন এক অনন্য নাম।
যিনি হাজার হাজার মঞ্চে দাঁড়িয়ে কথা বলেছেন, কবিতা বলেছেন, গান গেয়েছেন, সঞ্চালনা করেছেন— তিনিই তো প্রকৃত অর্থে একজন সাংস্কৃতিক সৈনিক। তিনি থেমে যাননি। থেমে যাওয়ার মানুষ তিনি নন। তাঁর যাত্রা এখনো চলমান, অদম্য, নিরলস, এবং পরিপূর্ণ এক মানবিকতায় উদ্ভাসিত।
দিলরুবা খানম শুধু গান গাইতেই জানেন না, তিনি গান লেখেন, সুর করেন। তাঁর প্রতিটি শিল্পচর্চা একটি ভাবনার ফসল, হৃদয়ের উপচে পড়া আবেগ। তাঁর গানগুলোতে যেমন সুর আছে, তেমনি আছে অর্থ, আবেদন এবং মননশীলতা।
এই বহুমাত্রিকতা তাঁর মৌলিক শক্তি। একজন নারী হয়েও তিনি সব বাধা পেরিয়ে আজ যে জায়গায় পৌঁছেছেন, তা কেবল প্রতিভা দিয়ে নয়, বরং কঠোর শ্রম, আত্মবিশ্বাস, এবং শিল্পের প্রতি ভালোবাসা দিয়েই সম্ভব হয়েছ। তিনি শুধু একজন শিল্পী নন, একজন নিবেদিত প্রাণ সমাজকর্মী। বিশেষ করে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে মানবসেবার একটি বড় অংশ তিনি নিজের জীবনদর্শনে রূপ দিয়েছেন। তাঁর দেশপ্রেম কেবল মুখের বুলি নয়— তাঁর প্রতিটি কর্মকাণ্ডে, প্রতিটি সিদ্ধান্তে, এবং জীবনযাত্রায় সেই ভালোবাসার ছাপ স্পষ্ট।
দিলরুবা খানম আপোষ করেননি। পেশার মূল্যায়ন, শিল্পীর সম্মান, এবং ন্যায্য পারিশ্রমিক— এই তিনটি বিষয় নিয়ে তিনি বরাবরই সচেতন। তাঁর কথা, “একটি অনুষ্ঠানের প্রাণ হচ্ছে উপস্থাপিকা। তাঁর কণ্ঠে, তাঁর কথায় অনুষ্ঠান জীবন্ত হয়। অথচ সেই মানুষকেই অবহেলা করা হয়, অবমূল্যায়ন করা হয়। এটা চলতে পারে না।” এই আত্মমর্যাদা, এই দৃঢ়তা তাঁকে একজন শিল্পীর পাশাপাশি একজন আত্মপ্রতিষ্ঠ নারী হিসেবেও গৌরবান্বিত করেছে। সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হলো— এতসব গুণ থাকা সত্ত্বেও দিলরুবা খানমের মধ্যে কোনো অহংকার নেই। তিনি সাদাসিধা জীবনযাপন করেন, বিনয় তাঁর ভূষণ। যে কেউ তাঁর সান্নিধ্যে এলেই অনুভব করে এক আন্তরিকতার উষ্ণতা, এক মানবিক শুভ্রতা।তিনি বলেন, “আমরা মানুষ, আমাদের উচিত একজন মানুষকে শ্রদ্ধা করা। গুণীজনের গুণের স্বীকৃতি দিতে শিখতে হবে।” এই মানবিক বোধ তাঁর প্রতিটি কাজে প্রতিফলিত হয়।
দিলরুবা খানম শুধু বাংলাদেশে নন, বিদেশেও তাঁর খ্যাতি সমানভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে তিনি একটি পরিচিত মুখ, যাঁর কণ্ঠস্বর মানেই এক টুকরো বাংলাদেশ, এক চিলতে আবেগ, এক আত্মিক ভালোবাসা।
আজকের এই শিল্পের বাজারে যেখানে কৃত্রিমতা, নাটকীয়তা, এবং বাহুল্য পরিবেশনার ছড়াছড়ি, সেখানে দিলরুবা খানম এক শুদ্ধতার প্রতীক। তাঁর কণ্ঠের মাধুর্যে যেমন শ্রোতা মোহিত হয়, তেমনি তাঁর চিন্তা, ভাষা, এবং চলনে এক অভিজাত সৌন্দর্য প্রকাশ পায়।
এই জাতির গর্ব, এই দেশের গুণী সন্তান, এই শুদ্ধ শিল্পী— দিলরুবা খানম আমাদের এক আশীর্বাদ। তাঁকে নিয়ে লেখার শেষ নেই। যতই লিখি, মনে হয়— কিছু না কিছু বাদ থেকেই যাচ্ছে। তাঁকে নিয়ে আলাদা করে জীবনীগ্রন্থ লেখা উচিত, যেন আগামীর প্রজন্ম জানে— এমন একজন নারী ছিলেন আমাদের মাঝে, যিনি শুধু শিল্পী ছিলেন না— ছিলেন এক জীবনচর্চাকারী। আমি এক সাধারণ মানুষ, যার জ্ঞান সীমিত। কিন্তু দিলরুবা খানমকে আমি জানি— হৃদয়ের গভীরতা দিয়ে। তাঁর মতো শিল্পী, তাঁর মতো মেধাবী, সৎ, এবং নিবেদিত প্রাণ মানুষ আমাদের সমাজে বিরল। আমি তাঁর প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা জানাই, তাঁর আগামী পথযাত্রা হোক আরও উজ্জ্বল, আরও মহিমান্বিত।
শুভকামনায় ভরে থাকুক তাঁর জীবন।