এক সময় এই দেশে সাংবাদিকতা মানেই ছিল আলোকিত পেশা, মানুষ দেখলে চোখে শ্রদ্ধা আর বিশ্বাসের ছায়া ফুটে উঠত। মানুষ ভাবত—এই ব্যক্তি সত্য কথা বলেন, অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন, সমাজের দর্পণ হয়ে উঠেছেন। এমনকি গ্রামে বসে যারা খবরের কাগজ পড়তেন, তারাও সাংবাদিকদের আলাদা মর্যাদায় দেখতেন। কিন্তু আজ? আজ অনেক জায়গায় সাংবাদিক পরিচয় দিতে গিয়ে লজ্জায় মাথা নিচু করতে হয়। কেন এই পরিবর্তন? কেন সাংবাদিকতা পেশাটি প্রশ্নবিদ্ধ, কলঙ্কিত ও জনসচেতনতার বদলে জনবিরক্তির কারণ হয়ে উঠেছে?
আমার তিন দশকের সাংবাদিকতা জীবনে বহু ঘটনা, বিপদ, চ্যালেঞ্জ ও সফলতার মুখোমুখি হয়েছি। দেশে-বিদেশে সাংবাদিকতা বিষয়ে বহু ফোরাম ও সম্মেলনে অংশ নিয়েছি। ২৮টি দেশে সাংবাদিকতা নিয়ে মতবিনিময় ও গবেষণার সুযোগ হয়েছে। এসব অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি—একজন প্রকৃত সাংবাদিক কেমন হন, কীভাবে সাংবাদিকতা সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হতে পারে। সেই তুলনায় বাংলাদেশে বর্তমানে সাংবাদিকতার চেহারা বড়ই করুণ।
বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই সাংবাদিকতা পেশায় আসছেন শুধুমাত্র পরিচয়, সুযোগ ও আর্থিক সুবিধা অর্জনের উদ্দেশ্যে। তাদের অনেকের কাছে ‘সত্য প্রকাশ’ বা ‘জনস্বার্থে প্রতিবেদন’ শব্দগুলো একেবারেই অবান্তর। তারা সাংবাদিকতা মানেই বোঝে টাকা, সুযোগ, ক্ষমতা, এবং পেমেন্ট! গত কয়েকদিন আগে আমি একটি জনসচেতনতামূলক সামাজিক কার্যক্রমের আয়োজন করেছিলাম। বিষয়টি জানাতে একটি অনলাইন চ্যানেলের তরুণী সাংবাদিক ফোন করলেন। শুরুতেই তিনি জানতে চাইলেন, “স্যার, প্রোগ্রামটা কি পেমেন্টের?” এই প্রশ্নটা আমার জন্য ছিল অত্যন্ত লজ্জাজনক ও বেদনাদায়ক। একজন সাংবাদিক হয়ে কেউ যদি সংবাদ কাভার করতে গিয়ে টাকা চায়, তাহলে কি তার ন্যূনতম নৈতিকতা, দায়বদ্ধতা বা পেশাগত শিক্ষা আছে? এটা কি ভিক্ষাবৃত্তি? না কি সাংবাদিকতার নামে গায়েবি চাঁদাবাজি? এমন প্রশ্ন করতে বাধ্য হচ্ছি কারণ এখন এই অপসাংবাদিকতা নতুন কোনো ব্যতিক্রম নয়, বরং নিত্যদিনের চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকাল অনেকেই অনলাইন চ্যানেল খুলে, ফেসবুকে লাইভ করে, বা ইউটিউব চ্যানেল চালু করে নিজেদের সাংবাদিক দাবি করছেন। অথচ তাঁদের নেই কোনো সাংবাদিকতা প্রশিক্ষণ, নেই পেশাগত নীতিমালা সম্পর্কে ধারণা, নেই তথ্য যাচাইয়ের দক্ষতা। শুধু একটি কার্ড, একটি বুম আর মোবাইল হাতে নিয়েই ‘সাংবাদিক’ পরিচয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, হোটেল, এনজিও অফিস বা সরকারি কার্যক্রমে গিয়ে ‘কভারেজ বাবদ’ টাকা দাবি করেন। এটা সরাসরি চাঁদাবাজি, আর কিছু নয়। এই চক্রের পেছনে আছে কিছু কুচক্রী ব্যবসায়ী, যারা একগুচ্ছ অদক্ষ যুবক-যুবতীকে সাংবাদিকতা নামক নকল পেশায় নিয়োজিত করে নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থসিদ্ধি করছে। এরা সাংবাদিকতা নয়, বরং তথ্য বিকৃত করে সুবিধা আদায় করে। সমাজে যারা সত্যিকারের সাংবাদিক, তারা আজ কোণঠাসা, নিঃস্ব, আর পদচ্যুত।
এই লেখায় আমি বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই তথাকথিত সাংবাদিক হান্নান রহিম-এর কথা। তার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশ পায় দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকা, পরে আমি নিজেও বিষয়টি অনুসন্ধান করে লিখি আমার সময়ের আলো ও দৈনিক ভোরের আওয়াজ-এ।আমাদের আগে কউ নিউজ করেননি হান্নান এর বিরুদ্ধে-হান্নান রহিম ছিল তথাকথিত ‘পেমেন্ট সাংবাদিকতা’র দৃষ্টান্ত। সে গেস্ট হাউসে গিয়ে দম্পতিদের হয়রানি করেছে, প্রমাণপত্র দাবি করেছে, অনৈতিকভাবে তল্লাশি চালিয়েছে এবং নিজের পরিচয়ে চাঁদাবাজির চেষ্টা করেছে। তার বিরুদ্ধে দেশের বহু গণমাধ্যম প্রতিবেদন করেছে, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব প্রতিবাদ জানিয়েছে, এবং অবশেষে পুলিশ প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে।
চান্দগাঁও থানার অফিসার ইনচার্জ আফতাব উদ্দিন সাহসিকতার সঙ্গে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করেছেন। এটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। এ ধরনের পদক্ষেপ আরও দরকার, আরও চিহ্নিত করা দরকার এমন মুখোশধারী ‘সাংবাদিকদের’, যারা সত্যিকারের সংবাদকর্মীদের মর্যাদাকে ধ্বংস করছে।
আমার বই ‘সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের কথা’-তে আমি লিখেছি—সাংবাদিক প্রধানত দুই প্রকার। প্রথমত, যারা সাংবাদিকতা করেন বিবেকের তাড়নায়। তারা সমাজের জন্য কাজ করেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়েন, মানুষের কণ্ঠস্বর হন। দ্বিতীয়ত, যারা সাংবাদিকতা করেন পেটের তাড়নায়। তারা সংবাদ তৈরি করে না, বরং সুযোগ খোঁজে, কে টাকা দেবে, কে বিজ্ঞাপন দেবে, কার সঙ্গে থাকলে সুবিধা হবে। এদের মাধ্যমে জন্ম নেয় পক্ষপাতদুষ্ট সংবাদ, গুজব, ষড়যন্ত্র এবং দায়িত্বহীন সাংবাদিকতা।
আরও বলেছি—সাংবাদিক দুই শ্রেণির:
নামি-ধামি সাংবাদিক: যাঁদের পেছনে রয়েছে বছরের পর বছর শ্রম, মেধা, সততা ও পাঠক-দর্শকের আস্থা।
নামধারী সাংবাদিক: যাঁদের পরিচয় কেবল একটি কার্ড আর চড়া গলায় বলা “আমি সাংবাদিক”! আজ সাংবাদিকতা পেশা এক সংকটময় সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। এখনই যদি ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে সামনে আমাদের সমাজ আর গণতন্ত্র উভয়ই হুমকির মুখে পড়বে। আমি বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল, গণমাধ্যম কমিশন, তথ্য মন্ত্রণালয়, জাতীয় সাংবাদিক সংগঠনগুলোর প্রতি আহ্বান জানাই— অনলাইন মিডিয়া লাইসেন্সের জন্য কঠোর শর্ত আরোপ করুন, প্রতিটি অনলাইন চ্যানেলের সাংবাদিকদের তালিকা যাচাই করুন,সাংবাদিকতার জন্য বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ ও রেজিস্ট্রেশন চালু করুন,চাঁদাবাজ সাংবাদিকদের আইনের আওতায় আনুন এবং মিডিয়াগুলোকে শুদ্ধ করুন,আপনারা যদি সাংবাদিকতা করতে চান, তাহলে আগে এ পেশার নৈতিকতা, ইতিহাস ও দায়বদ্ধতা বুঝুন। এটি ব্যবসা নয়, এটি একটি সামাজিক অঙ্গীকার। আপনার একটি লাইভ, একটি ছবি কিংবা একটি শব্দ—একটি পরিবারের জীবন বদলে দিতে পারে, একজন মানুষকে রক্ষা করতে পারে বা ধ্বংস করে দিতে পারে। তাই অনুরোধ, সাংবাদিকতা করুন বিবেক নিয়ে, শ্রদ্ধা নিয়ে, সততা নিয়ে। আমার এই লেখা কারও কারও কাছে কঠিন বা তিক্ত লাগতে পারে। কিন্তু সত্য সবসময় মিষ্টি হয় না। কেউ যদি এই লেখায় নিজের মুখ দেখতে পান, তবে সেটা নিজের কাজের প্রতিফলন—আমার কলমের দায় নয়। আজ সময় এসেছে—সাংবাদিকতা পেশাকে ব্যবসার ময়লা থেকে মুক্ত করার। আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ই সম্ভব হবে এই পেশাকে তার গৌরবময় অবস্থানে ফিরিয়ে আনা।
লেখকঃ সাংবাদিক, গবেষক টেলিভিশন উপস্থাপনক-এবং”সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের কথা”গ্রন্থ লেখক।