নাছিম—একটি নাম নয়, একটি আদর্শ। এক বুক সাহস আর সততার প্রতীক। ফটিকছড়ির আজাদী বাজারের এই সন্তান জীবনের প্রতিটি ধাপে সত্যের পাশে থেকেছেন, মানুষের পাশে থেকেছেন, সমাজের পাশে থেকেছেন। নিঃস্ব মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই ছিল তাঁর জীবনের পরম আনন্দ। তিনি কারও মুখে অভাবের আর্তনাদ শুনলে থেমে যেতেন, নিজের সবকিছু বিলিয়ে দিতে দ্বিধা করতেন না। পথহারা কাউকে দেখলে পথ দেখাতেন, না খেয়ে থাকলেও অন্যকে খাইয়ে তৃপ্তি পেতেন। তাঁর জন্য নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য কখনোই বড় ছিল না। বড় ছিল মানুষের জন্য কিছু করতে পারা।
কিন্তু যে সমাজে আজ তিনি নিজেকে নিঃসঙ্গ বোধ করেন, সেই সমাজের মানুষগুলোর বেশিরভাগই একসময় ছিলেন তাঁর খুব আপন। যাদের সুখে দুঃখে তিনি একাকার হয়ে গিয়েছিলেন, তারাই এক সময় তাঁর পিঠে ছুরি বসিয়েছে। সেই আঘাত শুধু রক্তাক্ত করেনি তাঁকে, নুইয়ে দিয়েছে বিশ্বাস, আস্থা আর ভালোবাসার মর্মস্পর্শী স্বপ্নগুলোকে।
সবচেয়ে বেদনাদায়ক ছিল যখন আপন ভাই স্ত্রীর কথায় প্ররোচিত হয়ে দূরে সরে যায়। ভাই হয়ে ওঠে বিরোধী পক্ষের সহযোগী। যার সঙ্গে এক ছাদের নিচে বেড়ে ওঠা, যার সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক, সেই ভাই যখন শত্রুর সঙ্গে হাত মেলায়, তখন বিশ্বাস হারায় ভিত্তি। এই বিশ্বাসভঙ্গের পরেই আসে আরও গভীর ক্ষত—প্রিয় বন্ধু যাকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবেসেছিলেন, যে বন্ধুকে প্রতিষ্ঠিত করতে নিজের সমস্ত কিছু নিঃশেষ করেছেন, সেই বন্ধু লোভের বশে নেমে পড়ে ষড়যন্ত্রের খেলায়। সেই বন্ধু এখন এমনকি হত্যার পরিকল্পনায় যুক্ত অন্যজনের সহযোগী! এ যেন বিশ্বাসঘাতকতার চূড়ান্ত রূপ।
নাছিম জানেন, তিনি একা। কারণ যাদের তিনি নির্দ্বিধায় ভালোবেসেছিলেন, যাদের জীবনে আলো দিতে চেয়েছিলেন, তারাই আজ তাঁর জীবনের অন্ধকারের উৎস। কিন্তু তবুও তিনি পিছপা নন। কারণ তিনি বিশ্বাস করেন—সত্য কখনো পরাজিত হয় না। মিথ্যা যত বড়ই হোক, সত্যের কাছে তার কোনও অস্তিত্ব নেই। তিনি জানেন, সময়ই একদিন সত্যকে সামনে এনে দাঁড় করাবে। তিনি আপোষ করেন না, আপোষ করেননি, ভবিষ্যতেও করবেন না।
নাছিমের জীবন যুদ্ধে ভয় ছিল না কখনো। তিনি বাঘের মতো বুক চিতিয়ে দাঁড়ান অন্যায়ের বিরুদ্ধে। কাপুরুষদের মতো মোনাফেকদের সামনে মাথা নোয়ান না, বরং তাঁদের মুখোশ খুলে দেন জনগণের সামনে। তিনি বিশ্বাস করেন—সত্যের সামনে মিথ্যার কোনও জায়গা নেই।
তাঁর সবচেয়ে বড় ভুল ছিল সবার প্রতি অন্ধ বিশ্বাস, সবার প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। কিন্তু এখন বুঝেছেন, সবাই সেই ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নয়। তাই তিনি তাঁর মনের দুঃখকে শক্তিতে রূপান্তর করে এগিয়ে চলেছেন। তাঁর একমাত্র ভরসা আল্লাহর ওপর। তিনি জানেন—ইনশাআল্লাহ, একদিন সত্য জয়ী হবে, মিথ্যার মুখোশ খুলে পড়বে, আর তিনি বুক চিতিয়ে বলবেন—”আমি হার মানিনি।”
নাছিম শুধু একজন প্রবাসী ব্যবসায়ী নন, তিনি এক সংগ্রামী, এক আদর্শের নাম। জীবনের শুরুটা খুব সহজ ছিল না। ফটিকছড়ির এক সুনামধন্য পরিবারে জন্ম নিয়েও তিনি পেয়েছিলেন কষ্টের স্বাদ। তাঁর বাবা-মা ছিলেন সৎ, পরিশ্রমী মানুষ, যাঁদের শিক্ষা ও মূল্যবোধই নাছিমের জীবনের ভিত গড়ে দেয়। শৈশব থেকেই বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখতেন তিনি, নিজের এলাকা, সমাজ, পরিবারকে গর্বিত করার আকাঙ্ক্ষা ছিল তাঁর মধ্যে।
পরবর্তীতে প্রবাসে পাড়ি জমান তিনি। কিন্তু হাতে ছিল না বড় মূলধন, ছিল না তেমন কোনো পরিচিত মহল। ছিল শুধু একরাশ স্বপ্ন, অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতা। সেই জায়গা থেকেই শুরু হয় তাঁর পরিশ্রমের পথচলা। প্রতিকূলতার পাহাড় পেরিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। তাঁর সাফল্যের পেছনে রয়েছে দিনের পর দিন কঠোর শ্রম, রাত জেগে কাজ, এবং কখনো না হারা মানসিক শক্তি। তাঁর স্ত্রী ছিলেন জীবনের প্রতিটি ঘাত-প্রতিঘাতে সাহসের উৎস, সন্তানরা ছিলেন অনুপ্রেরণার বাতিঘর। এই পরিবারই নাছিমের সবচেয়ে বড় শক্তি।
প্রবাসে নানা কষ্ট সয়েও তিনি সৎপথে থেকেছেন, অসততা আর প্রতারণাকে স্পর্শ করেননি কখনো। তাঁর ব্যবসায়িক নীতিমালার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল সততা, বিশ্বস্ততা ও মানুষের কল্যাণ। গ্রাহক ও কর্মচারীদের প্রতি দায়িত্বশীলতা ছিল তাঁর নৈতিক অঙ্গীকার। প্রতিটি প্রতিশ্রুতি তিনি রেখেছেন। কখনো কারো ক্ষতি করে সাফল্য অর্জন করতে চাননি।
নাছিম বিশ্বাস করেন—একজন মানুষ তখনই প্রকৃত সফল, যখন তাঁর কাজ অন্যের শ্রদ্ধা অর্জন করে। তাই তিনি জীবনের সব কাজেই সেই শ্রদ্ধা অর্জনের চেষ্টা করেছেন। শুধু নিজের জন্য নয়, নিজের জন্মভূমি, সমাজ, এলাকার মানুষের জন্যও কিছু করতে চেয়েছেন। ফটিকছড়িতে শিক্ষা, চিকিৎসা, ও সমাজসেবামূলক কাজে তিনি ও তাঁর পরিবার নানা অবদান রেখেছেন। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বৃত্তি, অসহায় পরিবারে সহায়তা, এলাকার উন্নয়নমুখী নানা উদ্যোগ তাঁকে সমাজের কাছে একজন আলোকবর্তিকা করে তুলেছে।
নাছিমের জীবনদর্শন আমাদের শেখায়—সততা, আদর্শ, এবং মানুষের কল্যাণে আত্মনিয়োগই প্রকৃত জীবনের অর্থ। তিনি এমন এক মানুষ, যাঁকে শুধু সফল ব্যবসায়ী বললে ছোট করে দেখা হয়। তিনি একজন অনুপ্রেরণাদায়ী নেতৃত্বের নাম। তাঁর জীবন হলো এক মহাকাব্য, যা বলে—”সত্যের পথে যারা থাকে, তাদের একদিন ইতিহাস লিখে দেয়।”
নাছিমের জীবন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সত্যের পথ কাঁটার হলেও তা সম্মানের। মিথ্যার আরাম, সুবিধাবাদিতা আর কপটতা হয়তো ক্ষণিকের সুখ দেয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত একলা নাছিমের মতো সত্যবাদী মানুষেরাই জেতে। কারণ তাঁরা আল্লাহর ওপর ভরসা করে, মানুষের কল্যাণে নিবেদিত থাকে, এবং জীবনের প্রতিটি ধাপে নিজেদের আদর্শে অবিচল থাকে। এমন মানুষের গল্প বলা শুধু সম্মান নয়, দায়িত্ব। কারণ সমাজ যখন নৈতিকতা হারায়, তখন নাছিমদের মতো মানুষের জীবন আমাদের সামনে তুলে ধরে এক উজ্জ্বল আদর্শের আলো।