রাশিয়া—একটি দেশ যেখানে ঠান্ডা শুধু প্রকৃতিরই নয়, মানুষের জীবনযাত্রারও অঙ্গ। সেখানে গরম রাখার জন্য শুধু খাবারই নয়, রঙিন পানীয় পান করার রীতিও রয়েছে। আর সে পানীয়ের স্বাদ আর মজায় যেন এক ভিন্ন রকমের রহস্য লুকিয়ে থাকে। আমি যখন ২০০১ সালে দিল্লি হয়ে আলজেরিয়ার বিশ্ব যুব সম্মেলনে যাচ্ছিলাম, তখন রাশিয়াতে চারদিনের যাত্রা আমার জীবনের এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে। সে সময়ে, রাশিয়ার পরিবেশ, নারী, সৌন্দর্য এবং তাদের পানীয়—সবকিছু এক সাথে এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়েছিল।
রাশিয়াতে যে পানীয় পান করা হয়, তা সেখানকার ঠান্ডা আবহাওয়ার সঙ্গে এক অদ্ভুত সম্পর্ক তৈরি করেছে। যে দেশে বরফ পড়ে, সেখানে তাপমাত্রা কমানোর জন্য, মানুষের শরীর গরম রাখতে হয়ে থাকে রঙিন পানীয়। কিন্তু এই পানীয় শুধুই শরীর গরম রাখার জন্য নয়, তার সাথে মিশে থাকে এক ধরনের আলাদা আনন্দ, এক ধরনের নেশা। আমি নিজেই যখন একদিন রাশিয়াতে তাদের সাথে পানীয়ের রোমাঞ্চে যোগ দিয়েছিলাম, তখন বুঝতে পারলাম, এটা শুধু পানীয় নয়, এক বিশেষ সাংস্কৃতিক অভ্যাস। আর সে অভ্যাসের মধ্যে যে মজা রয়েছে, তা এক কথায় বলে শেষ করা সম্ভব নয়। রাশিয়ার নারীদের সৌন্দর্য এবং তাদের চোখের চাহনি এক অন্য জগতের চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাদের কথার মধ্যে এক ধরনের সাবলীলতা ছিল, যা অন্য কোথাও কখনো অনুভব করিনি। তাদের নীরব চাহনিতে যেন এক ধরনের নেশা মিশে ছিল—নেশা নয়, তবে সুরভিত প্রেমের কোনো অদৃশ্য বাহক। তাদের হাসি, তাদের কথা, তাদের উপস্থিতি—এ সবই যেন একটা গল্পের মতো আবহ তৈরি করেছিল। আমি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, “এমন সৌন্দর্য এবং যাদু না দেখলে জীবন অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।”
রাশিয়ার নারীরা যেমন বাহ্যিক সৌন্দর্যে দুনিয়াকে মাতিয়ে রেখেছে, তেমনি তাদের মনও ছিল অতি সুন্দর। তাদের কথায় ছিল এক অদ্ভুত মিষ্টিতা, যা একজন পুরুষের মনকে পাগল করে দিতে পারে। আর আমি বুঝলাম, সেখানে মাতাল হওয়ার জন্য শুধু পানীয় পান করা প্রয়োজন নয়, তাদের রূপ, হাসি, চোখের চাহনি দেখলেও এক রকম মাতাল হয়ে যেতে হয়। তবে আমি যে মাতাল হয়েছিলাম, তা শুধু রাশিয়ার সেই পানীয় পান করে নয়, বরং রাশিয়ার রূপের ও সৌন্দর্যের ভালোবাসায় মত্ত হয়ে। আমার আত্মা যে সুরে ভাসছিল, তা ছিল এক গভীর সুধার মদ, যেখানে প্রেমের জোয়ার ছিল অন্তর থেকে অন্তরে ছড়িয়ে পড়া।
রাশিয়া আমাকে শুধু মন্ত্রমুগ্ধ করেনি, তাদের প্রতিটি মুহূর্ত, পানীয় এবং তাদের জীবনযাপনের ধরনও আমার জন্য এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিল। সেখানে পানীয় পান করা শুধু শরীরকে উষ্ণ রাখার উপায় ছিল না, বরং এটি ছিল এক সামাজিক অনুষ্ঠানের অংশ, যেখানে সবাই একে অপরকে কাছাকাছি অনুভব করতো। রাশিয়াতে পানীয় পান করার সময়, সেই মুহূর্তগুলো যেন ছিল এক আলাদা রকমের জীবনদর্শন—পানির মধ্যে যেন মিশে ছিল ঐতিহ্য, ইতিহাস এবং এক অদৃশ্য সেতু, যা পুরুষ ও নারীর হৃদয়কে এক করতে সহায়তা করত।
আমার সেই চারদিনের সফরটিতে যা আমি অনুভব করেছিলাম, তা কোনও সাহিত্যিকের কল্পনাতেও স্থান পেতে পারে। রাশিয়ার নারীরা যে শুধুমাত্র বাহ্যিকভাবে সুন্দর নয়, তাদের অন্তরের সৌন্দর্যও ছিল সত্যিই অতুলনীয়। তাদের কথায়, তাদের হাসিতে, তাদের অঙ্গভঙ্গিতে যেন এক বিশেষ জাদু ছিল, যা আমাকে প্রতি মুহূর্তে নতুন করে মাতাল করে তোলে। এবং সেজন্যই, আমি বলবো—যতবারই রাশিয়াকে মনে করবো, ততবারই আমার মনে পড়বে সেই সুন্দর রাতের স্মৃতি, যেখানে পানীয়, গান এবং তাদের গল্পের মধ্যে আমি ডুব দিয়েছিলাম।
এমন মাতাল করা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে, আমি বুঝতে পেরেছিলাম—রাশিয়া শুধু একটা দেশ নয়, এটি একটি অভূতপূর্ব প্রেমের গল্প, যা আপনাকে নিজের অজান্তেই পাগল করে দেয়। সেখানে পানীয় পান করাটা যেন কোনো সাধারিত প্রথা নয়, বরং এক প্রেমময় অভিজ্ঞতা, যা মন ও মস্তিষ্ককে নেশায় ভরিয়ে দেয়।
রাশিয়া কখনও মন থেকে মুছে যেতে পারে না। তাদের পানীয়, তাদের রূপ, তাদের কথায় একটা অন্য জগতের চিত্র ভাসে। রাশিয়াতে আমি বুঝেছি—ভালোবাসা, সৌন্দর্য আর পানীয়ের মধ্যে মিলিয়ে এমন এক জাদু সৃষ্টি হয়, যা কেবলমাত্র ওই দেশের মাটিতেই পাওয়া যায়। আর সেই অভিজ্ঞতাকে বাঁচিয়ে রাখতে, আমি মনে করি—তবে আমার রাশিয়াতে কাটানো সময়ের মতো এমন মধুর, রোমান্টিক ও সাহিত্যময় মুহূর্ত আর কোথাও কখনো আসবে না।
রাশিয়ার হৃদয়স্পর্শী সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় এক অদ্ভুত মেলবন্ধন তৈরি হয়েছিল, যেখানে একে অপরকে গান, সাহিত্য, পানীয় আর কথামালায় জীবনের গভীর অনুভূতিগুলো ভাগ করে নেওয়ার এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা হয়ে উঠেছিল। সেই সন্ধ্যা ছিল এক অসাধারণ অনুষ্ঠানের সাক্ষী, যেখানে রাশিয়ার মহান লেখক ও কবিরা একত্রিত হয়ে নিজেদের অন্তরের কথাগুলি শোনাচ্ছিলেন। এই ছিল এক উল্লাসময় পরিবেশ, যা যেন কোনো রূপকথার গল্পের মতো ভেসে বেড়াচ্ছিল।
এ অনুষ্ঠানে রাশিয়ার সাহিত্য দুনিয়ার বিখ্যাত দুই নারী লেখিকা লিউডমিলা উলিৎসকায়া এবং ভেরা ক্বোজমিনা তাদের সাহিত্য ও সৃষ্টিশীলতা দিয়ে এই সন্ধ্যাকে আরও স্মরণীয় করে তুলেছিলেন। উলিৎসকায়া, যিনি আধুনিক রুশ সমাজের মানসিকতা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য তুলে ধরেছেন, সেখানে এসে বলেন, “সাহিত্য আমাদের জাতির আত্মা, এটি এক জীবন্ত অস্তিত্ব। এটি এমন কিছু যা আমাদের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতকে একসূত্রে বাঁধে।” তার কথাগুলো যেন আমাদের হৃদয়ে গভীর দাগ রেখে যায়।
তার পাশেই ছিলেন ভেরা ক্বোজমিনা, যিনি রাশিয়ার মানুষের জীবনযাত্রা এবং তাদের প্রেম ও যন্ত্রণা নিয়ে বহু গল্প লিখেছেন। ক্বোজমিনা তার সাহিত্যে যা লিখেছেন, তা সোজা মানুষের হৃদয়ের ভেতর প্রবাহিত হয়েছে। তিনি বলেছিলেন, “প্রেম কেবল এক অনুভূতি নয়, এটি আমাদের অস্তিত্বের অন্যতম শক্তি। যা দিয়ে আমরা পৃথিবীকে নতুনভাবে দেখি, এবং আমাদের জীবনকে নতুন অর্থে ধারণ করি।”
এমন একটি অনুষ্ঠানে, যেখানে রাশিয়ার সাহিত্য এবং সংস্কৃতির নানান দিক একসাথে মিশে গিয়েছিল, সেখানে এক বিশেষ পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল। গান, পানীয়, কবিতা এবং সাহিত্যের সুরে মিলিত হয়ে, রাশিয়ার সাহিত্যিকরা একেকটি নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিলেন। গানের সুর যেন রাশিয়ার প্রাচীন ইতিহাসের কথা বলছিল, সেই সুরে মিশে ছিল পেট্রোগ্রাদ (বর্তমান সেন্ট পিটার্সবার্গ) থেকে মস্কো পর্যন্ত রাশিয়ার ঐতিহ্য, সংগ্রাম এবং তার নতুন প্রজন্মের আশা।
গানের পরিবেশনা ছিল স্বপ্নীল, যেখানে সঙ্গীতজ্ঞরা চিরকালীন রাশিয়ান সুরে ডুব দিয়ে, জীবন আর সাহিত্যের মিশ্রণে একটি অনন্য মেজাজ সৃষ্টি করছিলেন। প্রতি সুরের সাথে মনে হচ্ছিল, রাশিয়ার প্রাচীন কাহিনিগুলো আবার জীবন্ত হয়ে উঠছে। তারা গাইছিলেন এক আধুনিক ভাষায়, তবে রাশিয়ার শাশ্বত গীতিমালা যেন ফিরে ফিরে আসছিল। গানের সুরে মিশে ছিল দেশটির মুক্তির ইতিহাস, সংগ্রাম, বিপ্লব এবং প্রেমের নিঃস্বার্থতা।
এক গ্লাস পান, তার পর সে পানীয়ের স্বাদ, আর সে স্বাদের মধ্যে রাশিয়ার মাটি ও মানুষের অনুভূতির পীড়ন ছিল। এটি ছিল এক ধরনের শ্রদ্ধা, সাহিত্যের প্রতি এবং সেই সাহিত্যিকদের প্রতি, যারা বিশ্বব্যাপী রাশিয়ার সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করছেন। পানীয় আর গানের সুরে, কথার আদান-প্রদান ছিল এক বিশেষ প্রতীক, যা শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং পুরো জাতির অনুভূতির চিত্র তুলে ধরেছিল।
এই বিশেষ অনুষ্ঠানটি ছিল এক নতুন যুগের সূচনা, যেখানে রাশিয়ার সাহিত্যের ও সংস্কৃতির প্রতি বিশ্ববাসীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়েছিল। পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন দেশের সাহিত্যিকরা এসে একত্রিত হয়েছিলেন, এবং তাদের সাহিত্যের মাধ্যমে তারা এই পৃথিবীটিকে আরেকটু সুন্দর করার, একে অপরকে জানার এবং ভালোবাসার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
অবশেষে, যখন সন্ধ্যা গভীর হয়ে আসে, আলো ম্লান হয়ে যায়, তখনও সেই সুর, সেই পানীয়, সেই সাহিত্যের স্বাদ রয়ে যায়। রাশিয়ার সাহিত্য, তার সংস্কৃতি, তার ইতিহাস, তার মানুষ—এগুলো যেন এক ঐক্যবদ্ধ সুরের মতো পুরো পৃথিবীকে বলছিল, “আমরা এক, আমাদের ভালোবাসা এক, আমাদের সাহিত্য এক।”
রাশিয়ার সাহিত্যের মতো, এই সন্ধ্যাটি ছিল এক অমলিন চিহ্ন, যা পৃথিবীজুড়ে সবসময় মনে থাকবে। এটি শুধুমাত্র একটি অনুষ্ঠান ছিল না, বরং রাশিয়ার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও তার গভীর মানবিক মূল্যবোধের এক মহা উৎসব ছিল।