একটি পরিবারের শান্তি কীভাবে তছনছ হয়ে যেতে পারে, তা দেখার জন্য পটিয়ার ভুক্তভোগী ইউনুচের পরিবারের দিকে তাকালেই যথেষ্ট। একজন সাধারণ দোকানদার, যিনি সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করে তার পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করেন, আজ মিথ্যা মামলার কারণে চোখের জল ফেলছেন। শিশুসন্তান, বৃদ্ধ, যুবক—সবাই আজ এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্নে নিমজ্জিত।
অন্যায়, অবিচার, এবং ষড়যন্ত্রের জালে আটকে যাওয়া এই পরিবারটি আজ রাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা চায় না সহানুভূতি, তারা চায় ন্যায়বিচার। তারা চায় সত্য প্রকাশ হোক। একজন নিরপরাধ ব্যক্তি ও তার পরিবারের প্রতি এই নির্মম আচরণ শুধু তাদের নয়, আমাদের গোটা মানবিকতার প্রশ্ন তোলে।
এই পরিবারটি আজ আপনার, আমার, আমাদের সহমর্মিতা কামনা করছে। তারা আমাদের কাছে দয়া নয়, বরং আমাদের কণ্ঠস্বর চায়—যে কণ্ঠস্বর অন্যায়ের বিরুদ্ধে উচ্চারিত হবে। আমরা কি তাদের পাশে দাঁড়াব না? একজন মানুষের চোখের জল মুছতে, একটি শিশুর জীবন বাঁচাতে, একটি পরিবারের স্বপ্ন রক্ষায় আমরা কি সামান্য হলেও এগিয়ে আসতে পারি না? মানুষের মানবিকতাই পারে এমন পরিবারগুলোকে ন্যায়ের আলো দেখাতে।
গণপিটুনিতে নিহত শামসুল আলমের মৃত্যুকে ঘিরে পটিয়া থানার পুলিশের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের এবং নিরীহ পরিবারের হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনার প্রতিবাদে এবং প্রকৃত সত্য জাতির সামনে তুলে ধরতে আজ বিকেল সাড়ে ৩টায় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের এস রহমান হলে ভুক্তভোগী পরিবারের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্য মো. রিয়াজ।
চঘটনার পেছনের কাহিনী-লিখিত বক্তব্যে ভুক্তভোগী পরিবার জানান, গত ২১ ডিসেম্বর বিকেল ৪টায় পটিয়া থানাধীন পূর্ব হাইদগাঁও ইউনিয়নের ভাঙাপুল এলাকায় একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে। শামসুল আলমের নেতৃত্বে ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা মুদি দোকানদার মো. ইউনুচের দোকানে হামলা চালায়।তারা দেশীয় অস্ত্র দিয়ে ইউনুচকে হত্যার উদ্দেশ্যে মাথায় আঘাত করে। ইউনুচ আত্মরক্ষার চেষ্টা করলে তার ডান হাতে এবং নাকে গুরুতর জখম হয়।
হামলার সময় দোকানের কর্মচারী জাফরকেও স্টিলের পাইপ দিয়ে পিটিয়ে আহত করা হয়। এ অবস্থায় স্থানীয় জনগণ এগিয়ে এলে সন্ত্রাসীরা পালানোর চেষ্টা করে। ধাওয়ার মুখে শামসুল আলম স্থানীয় জনতার গণপিটুনির শিকার হন। পরে ৯৯৯-এ ফোন করা হলে পুলিশ এসে শামসুল আলম ও ইউনুচকে উদ্ধার করে পটিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। অবস্থার অবনতি হলে তাদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। মিথ্যা মামলা ও পুলিশের ভূমিকা-
ভুক্তভোগী পরিবার অভিযোগ করেন, গণপিটুনির ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে পটিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ আবু জায়েদ মো. নাজমুন নুর স্বার্থান্বেষী মহলের প্রভাব খেয়ে ঘটনাটিকে নাটকীয়ভাবে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করেছেন। শামসুল আলমের স্ত্রীকে থানায় ডেকে নিয়ে একটি মিথ্যা এজাহার টাইপ করে, ইউনুচসহ তার পরিবারের ১৬ জন সদস্যকে আসামি করা হয়। আসামিদের মধ্যে শিশুসহ ছাত্র, দিনমজুর ও ব্যবসায়ী রয়েছেন।
জমি নিয়ে পুরোনো বিরোধ- লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, শামসুল আলম এবং মো. ইউনুচ পরস্পর নিকট আত্মীয় হলেও তাদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে হাইদগাঁও পাহাড়ের জমি নিয়ে বিরোধ চলে আসছে। স্থানীয় সালিশি বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ইউনুচ ওই জমির মালিক বলে প্রমাণিত হলেও শামসুল আলম তা মেনে নিতে পারেননি। জমি দখল করতে শামসুল আলম বিভিন্ন ষড়যন্ত্র শুরু করেন এবং ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের নিয়ে দোকানে হামলা করেন।পুলিশি হয়রানি ও ভুক্তভোগীর বক্তব্য-
ভুক্তভোগী পরিবার অভিযোগ করেন, হামলার শিকার মো. ইউনুচ হাসপাতালের বিছানায় শয্যাশায়ী থাকা অবস্থায় তাকে আসামি করা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে ইউনুচের স্ত্রী বলেন, “আমার স্বামী দীর্ঘদিন ধরে শামসুল আলমের দ্বারা মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার। আমি বারবার পুলিশের কাছে নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করেছি, কিন্তু কোনো প্রতিকার পাইনি। এখন পুলিশ মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাদের পুরো পরিবারকে ধ্বংস করার চক্রান্ত করছে।” তিনি আরও বলেন, “পুলিশ এই ঘটনার প্রকৃত সত্যকে আড়াল করতে এবং শামসুল আলমের অপরাধ ঢাকতে আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনে মামলা রেকর্ড করেছে। আমরা সরকারের কাছে এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের আবেদন জানাই।”
সংবাদ সম্মেলনে ভুক্তভোগীদের দাবি-
ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা দাবি করেন,
মঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত: গণপিটুনির প্রকৃত কারণ এবং শামসুল আলমের নেতৃত্বে ইউনুচের ওপর হামলার বিষয়ে সঠিক তদন্ত করতে হবে।মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার: নিরীহ পরিবারের বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যা মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে।
পুলিশি নিরপেক্ষতা নিশ্চিত-পটিয়া থানার অফিসার ইনচার্জসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং তাদের পক্ষপাতমূলক আচরণ বন্ধ করতে হবে।
নিরাপত্তার নিশ্চয়তা: ভুক্তভোগী পরিবারকে সন্ত্রাসী হামলা এবং পুলিশি হয়রানি থেকে রক্ষা করতে উপযুক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
উপস্থিতি ও বক্তব্য-
সংবাদ সম্মেলনে ভুক্তভোগী ইউনুচ, তার স্ত্রী আছমা আকতার, ছেলে তৌফিক রেজা ও হোসাইন রেজা, এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। তারা সবাই প্রশাসনের দ্রুত পদক্ষেপ এবং সুবিচারের জন্য আবেদন জানান।
ভুক্তভোগী পরিবার আশা প্রকাশ করেন, প্রশাসন এই ঘটনার সঠিক তদন্ত করবে এবং তাদের নিরীহ পরিবারকে হয়রানি থেকে রক্ষা করবে। তারা সরকারের কাছে ন্যায়বিচার পাওয়ার আকুল আবেদন জানান। এখানে শুধু একটি পরিবার নয়, ন্যায়ের প্রতি সমাজের আস্থা হুমকির মুখে। গণপিটুনির শিকার একজন সন্ত্রাসীর মৃত্যুকে আড়াল করে নিরীহ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়েরের যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তা শুধু আইনের অপব্যবহার নয়; এটি মানবিকতার চরম বিপর্যয়। পুলিশ যদি নিরপেক্ষতার বদলে পক্ষপাতিত্বে লিপ্ত হয়, তবে সত্য ও ন্যায়বিচার চিরকাল অনিরাপদ হয়ে থাকে। এই ঘটনাটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, ক্ষমতা ও প্রভাবের সামনে কতটা অসহায় হয়ে পড়তে পারে একজন সাধারণ নাগরিক। এ ধরনের ঘটনা কেবল একটি পরিবারের বিপন্নতা নয়, এটি সমগ্র সমাজের শৃঙ্খলার প্রতি চ্যালেঞ্জ। আইন ও মানবিকতার সঠিক প্রয়োগ এখন সময়ের দাবি