সময় কখনো কখনো আমাদের ব্যস্ততার এমন এক স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, যেখানে প্রিয় মানুষদের বিশেষ দিনগুলো হারিয়ে যায় জীবনের কোলাহলে। আবসার উদ্দিন অলী ভাইয়ের জন্মদিনও তেমনই নিঃশব্দে কেটে গেল, কিন্তু তার প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান শব্দের সীমারেখায় আটকে থাকে না। দিন শেষে, দিনের কথা মনে পড়তেই কলম হাতে বসে গেলাম—লেখাটি যেন জন্মদিনের উপহার, যা সময়ের সীমা অতিক্রম করে ভালোবাসার এক অনিঃশেষ স্রোত হয়ে প্রবাহিত হয়। তিন দশক আগে যে বন্ধুত্বের বীজ রোপণ হয়েছিল, তা আজ মহীরুহ। সময়ের স্রোতে আমরা দুজনই নানা পথে হেঁটেছি, কখনো লেখালেখির জগতে, কখনোবা টেলিভিশনের পর্দায়, কিন্তু পথচলার এই মোহনায় এসে দেখি, আমাদের সেই সম্পর্কের শিকড় আরও গভীরে প্রোথিত হয়েছে। আবসার উদ্দিন অলী শুধু একজন বন্ধু বা সহকর্মী নন, তিনি আমার জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, একজন অনুপ্রেরণার উৎস, যিনি শুধু নিজেকে গড়ে তোলেননি, আমাদের অনেককেই তৈরি হতে সাহায্য করেছেন।
এক অচেনা শহরের চেনা মানুষ
চট্টগ্রামের সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে আবসার উদ্দিন অলী যেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যার আলো শুধু এই শহরে সীমাবদ্ধ নয়, তা ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। তার নাম বললেই মনে পড়ে এক বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারীর কথা—লেখক, সাংবাদিক, গীতিকার, পরিচালক, উপস্থাপক, সংগঠক, এবং সর্বোপরি একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। চট্টগ্রামের অলি-গলিতে তার উপস্থিতি যেন এক পরিচিত দৃশ্যপট। নিউ মার্কেটের আড্ডা হোক বা কোনো সাহিত্য সন্ধ্যা, অলী ভাইয়ের হাসিমুখ আর প্রাণবন্ত বাক্যালাপ যে কোনো পরিবেশকে আলোকিত করে তুলত। তার জীবন যেন এক জীবন্ত উপন্যাস, যার প্রতিটি অধ্যায়ে রয়েছে সৃষ্টিশীলতার নানা ছোঁয়া। লেখালেখির হাতেখড়ি: সমান্তরাল পথচলা তিন যুগ আগে আমরা যখন লেখালেখির জগতে প্রবেশ করি, তখন দুজনের পথচলা যেন সমান্তরাল। সাহিত্য, সাংবাদিকতা এবং সাংস্কৃতিক চর্চায় আমরা একসঙ্গে হাত ধরে চলেছি। অলী ভাইয়ের কলমে যেন ছিল এক আশ্চর্য জাদু। তার লেখা গানগুলো শুধু জনপ্রিয়তাই পায়নি, বরং মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী আসন গেড়েছে।
বাংলাদেশ টেলিভিশনের পর্দায় তার নির্মিত ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানগুলো ছিল সময়ের চেয়ে এগিয়ে। প্রতিটি অনুষ্ঠানে তিনি যোগ করতেন এক অনন্য শৈল্পিক ছোঁয়া, যা তাকে আলাদা করে তুলত। তার গীতিকার সত্তা থেকে শুরু করে পরিচালকের ভূমিকা—সব জায়গাতেই ছিল নিখুঁত দক্ষতা। সংগঠকের ভূমিকায় অলী ভাই:
আবসার উদ্দিন অলী শুধু একজন শিল্পী বা লেখক নন, তিনি একজন দক্ষ সংগঠকও। চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য। বিভিন্ন সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা ছিল চোখে পড়ার মতো। তরুণদের উৎসাহিত করা, নতুন প্রতিভা তুলে আনা—এসব কাজের মাধ্যমে তিনি চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক বিকাশে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
তার লেখা শত শত গান আজও গেয়ে চলেছেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শিল্পীরা। এমনকি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশের মঞ্চেও তার সৃষ্টিগুলো সমান জনপ্রিয়। তার গানের মধ্যে যে আবেগ আর মাটি-ঘেঁষা ভাব, তা বাংলার প্রতিটি হৃদয়ে দাগ কেটে যায়। ক্যামেরার সামনে এবং পেছনে: একজন সফল পরিচালক
অলী ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক শুধু ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং পেশাদার জীবনের নানা ক্ষেত্রেও আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি। কতবার যে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের ক্যামেরা নিয়ে আমার অফিসে এসেছেন, তার কোনো হিসাব নেই।
একজন দক্ষ পরিচালক হিসেবে তিনি কেবল কনটেন্ট নির্মাণ করতেন না, বরং প্রতিটি দৃশ্যের পেছনে লুকিয়ে থাকত শিল্পের নিখুঁত ছোঁয়া। টেলিভিশন অনুষ্ঠানের প্রতিটি ফ্রেমে তার সৃজনশীলতার ছাপ স্পষ্ট।
একজন বিনোদনের মানুষ
বিনোদন বলতে আমরা যা বুঝি, অলী ভাই ছিলেন তার মূর্ত প্রতীক। তার উপস্থিতি মানেই হাসি, আনন্দ আর নতুন কিছু শেখার সুযোগ। বাংলাদেশের টেলিভিশন জগতে যে কয়জন মানুষ বিনোদনকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, অলী ভাই তাদের মধ্যে অন্যতম।
তার তৈরি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানগুলো শুধু বিনোদন নয়, বরং শিক্ষণীয় এবং চিন্তাশীল বিষয়েও আলোকপাত করত।
নিস্তব্ধ জন্মদিনের আক্ষেপ
তবে আজকের এই লেখার পেছনে আছে এক টুকরো আক্ষেপ। আবসার উদ্দিন অলীর মতো একজন ব্যক্তিত্বের জন্মদিন এমন নীরবতার মধ্যে কেটে গেল, যা আমাদের সমাজের এক গভীর সংকটের প্রতিচ্ছবি। আজকাল অনেকের জন্মদিনে আলোচিত হয় বিলাসী আয়োজন, অথচ সত্যিকারের গুণীজনদের আমরা অনেক সময় ভুলে যাই।
এমন একজন মানুষ, যার প্রতিভা আর অবদান চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে সমৃদ্ধ করেছে, তার জন্মদিন যদি আমরা মনে না রাখি, তাহলে আমাদের সাংস্কৃতিক দায়বদ্ধতা কোথায়? তবু, এই লেখার মধ্য দিয়ে আমি চেষ্টা করছি তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা প্রকাশ করতে। অলী ভাই, আপনার সৃষ্টিশীলতার আলো আমাদের পথ দেখাক আরও বহু বছর।
শেষকথা: অলী ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা জন্মদিন শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু আবসার উদ্দিন অলীর প্রতি আমাদের ভালোবাসা কোনোদিন ফুরাবে না। তার হাসিমুখ, প্রাণবন্ত কণ্ঠ আর সৃষ্টিশীল কর্মধারা আমাদের মনে গেঁথে থাকবে চিরকাল। এই সমাজ তাকে মনে রাখবে, যতদিন সাহিত্য আর সংস্কৃতি বেঁচে থাকবে।
আমার এই ক্ষুদ্র লেখায় হয়তো তার বিশাল ব্যক্তিত্বের সবটা তুলে ধরা সম্ভব নয়, কিন্তু তবু আমি চেষ্টা করলাম তার প্রতি আমার অনুভূতি প্রকাশ করতে। অলী ভাই, আপনার প্রতি এই ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা চিরন্তন। জন্মদিন হোক বা না হোক, আপনার অবদান আমরা কোনোদিন ভুলব না।