চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব। এই নামটি চট্টগ্রামের গণমাধ্যম জগতের গৌরবময় অতীত এবং সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের প্রতীক। দীর্ঘদিন ধরে এই ক্লাবটি সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, এবং প্রকৃত সাংবাদিকদের উপেক্ষা করে এটি কয়েকজন সুবিধাবাদীর ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু আজ সেই অন্ধকার অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটতে শুরু করেছে। আমি আন্তরিক অভিনন্দন জানাই চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ফরিদা খানমকে, যিনি সরকারের নির্দেশে এই ক্লাবের অন্তর্বর্তীকালীন কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। তার সঙ্গে আছেন সাংবাদিকতার জগতে সুনাম অর্জন করা আরও কয়েকজন যোগ্য ব্যক্তি। আমি বিশ্বাস করি, তাদের যোগ্য নেতৃত্বে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব আবার তার হারানো গৌরব ফিরে পাবে।
সংকটের শুরু এবং আন্দোলনের প্রেক্ষাপটঃ চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব, যা একসময় সাংবাদিকদের মতবিনিময়ের কেন্দ্রস্থল ছিল, তা ধীরে ধীরে একটি ক্ষমতালিপ্সু গোষ্ঠীর দখলে চলে যায়। এই গোষ্ঠী প্রেসক্লাবকে তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে। ক্লাবের সদস্যপদ দেওয়া হতো এমন ব্যক্তিদের, যাদের সাংবাদিকতার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না। নামসর্বস্ব পত্রিকার তথাকথিত সাংবাদিকরা ক্লাবের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীকে সমর্থন দিতেন। এই গোষ্ঠী প্রেসক্লাবকে তাদের দালালির মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করত। সরকারি সুবিধা লাভ, অনৈতিক অর্থ আয়, এবং ক্লাবের তহবিল অপব্যবহার ছিল তাদের প্রধান লক্ষ্য। এই পরিস্থিতি প্রকৃত সাংবাদিকদের হতাশ করে তোলে।
কিন্তু একসময় এই দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সুর উচ্চারিত হয়। প্রকৃত সাংবাদিকরা ক্লাবের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধারের জন্য আন্দোলনে নামে। তাদের এই আন্দোলন ধীরে ধীরে গণআন্দোলনে পরিণত হয়। ক্লাবটি একসময় অচল হয়ে পড়ে। তিন মাস ধরে ক্লাবের কার্যক্রম স্থগিত থাকে। নতুন কমিটির অভ্যুদয় ২০ নভেম্বর, ২০২৪-এ সরকার একটি অন্তর্বর্তীকালীন কমিটি গঠন করে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ফরিদা খানমকে এই কমিটির আহ্বায়ক করা হয়। তার সঙ্গে সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার চট্টগ্রামের আবাসিক সম্পাদক জাহিদুল করিম কচি। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন দৈনিক কালের কণ্ঠ-এর ব্যুরো প্রধান মুস্তফা নঈম এবং গ্লোবাল টেলিভিশন-এর ব্যুরো প্রধান গোলাম মওলা মুরাদ। কমিটি দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম সভায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ক্লাবের ব্যাংক হিসাব পরিচালনার জন্য তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। নতুন সদস্যপদ প্রদান এবং স্থায়ী সদস্যদের যাচাই-বাছাইয়ের জন্যও একটি বিশেষ কমিটি গঠিত হয়। এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে ক্লাবের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সংগ্রামের অংশীদার হিসেবে গর্ব আমি নিজেকে গর্বিত মনে করি, কারণ আমি এই আন্দোলনের একজন সক্রিয় অংশীদার ছিলাম। আমি লেখালেখি ও প্রকাশ্য বক্তব্যের মাধ্যমে বারবার বলেছি, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব প্রকৃত সাংবাদিকদের অধিকার ও মতবিনিময়ের একটি পবিত্র স্থান। এটি কখনো ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহৃত হতে পারে না।
ক্লাবের পুরনো নেতৃত্বের বিরুদ্ধে আমি সরাসরি কথা বলেছি, তাদের দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রতিবাদ করেছি। যারা এই ক্লাবকে তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করেছিল, তাদের সরিয়ে দেওয়া আজ শুধু আন্দোলনের নয়, চট্টগ্রামের সাংবাদিক সমাজেরও এক বিশাল বিজয়। ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে প্রেসক্লাবের ভূমিকা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব দেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। এটি শুধু একটি ক্লাব নয়; এটি ছিল সাংবাদিকদের জন্য একটি মঞ্চ, যেখানে তারা মতামত প্রকাশ করতে পারতেন এবং পেশাগত উন্নতির জন্য একত্রিত হতে পারতেন। ছাত্রজনতার গণআন্দোলনের সময় প্রেসক্লাব একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। সেই সময়ে গণমাধ্যমকর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে জাতীয় পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ক্লাবটির নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিরা সেই গৌরবময় ঐতিহ্যকে কলুষিত করেছে। আশার নতুন আলো আজকের এই পালাবদল নতুন নেতৃত্ব এবং সম্ভাবনার একটি দিগন্ত উন্মোচন করেছে। আমি বিশ্বাস করি, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব আবার তার পুরনো গৌরব ফিরে পাবে। যোগ্য নেতাদের হাত ধরে এটি প্রকৃত সাংবাদিকদের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল এবং মতবিনিময়ের পবিত্র স্থান হয়ে উঠবে।
আমি আশা করি, এই ক্লাবটি আবার সেই আদর্শ প্রতিষ্ঠা করবে, যা একসময় এটি ধারন করত। সাংবাদিকতার মুক্ত পরিবেশ এবং সুষ্ঠু কার্যক্রম নিশ্চিত করতে এটি এক নতুন যুগের সূচনা করবে। চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের এই নবযাত্রা স্বাগত। এটি শুধুমাত্র সাংবাদিকদের জন্য নয়, পুরো গণমাধ্যমের জন্য একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে। চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে পেশাদার গণমাধ্যম কর্মীদের নিয়মিত সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করা এবং প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত কঠিন করে রাখা চট্টগ্রামের সাংবাদিকতা জগতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। এই বিষয়ে প্রশ্ন তোলার সময় কিছু গভীর অসঙ্গতি সামনে আসে, যা শুধু ক্লাবের স্বচ্ছতা নয়, বরং পেশার নৈতিকতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে।
প্রথমত, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সদস্যপদ প্রাপ্তির নিয়ম ও শর্তাবলী এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে অনেক পেশাদার গণমাধ্যমকর্মীকে বাদ দেওয়া যায়। বিশেষ করে অনলাইন সাংবাদিকতা এবং নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকদের সদস্য হতে বাঁধার মুখে পড়তে হয়। এটি খুবই দুঃখজনক, কারণ সারা পৃথিবীতে গণমাধ্যমের অন্যতম প্রধান প্ল্যাটফর্ম হিসেবে অনলাইন নিউজ দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। অথচ কিছু মানুষ এখনো অনলাইন সাংবাদিকতাকে স্বীকৃতি দিতে রাজি নন। অনলাইন সাংবাদিকদের অবজ্ঞা করার মূল কারণ সম্ভবত একটি প্রথাগত মানসিকতা। যারা শুধু প্রিন্ট মিডিয়াকে সাংবাদিকতার মূল মাধ্যম হিসেবে মনে করেন, তারা বিশ্বাস করেন অনলাইন নিউজ কোনও প্রকৃত সাংবাদিকতার ক্ষেত্র নয়। কিন্তু এই ধারণা বাস্তবতার সঙ্গে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। কারণ অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এখন সবচেয়ে দ্রুত ও কার্যকর সংবাদ প্রকাশের একটি মাধ্যম। সারা পৃথিবীতে অনলাইন সাংবাদিকতা নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। যারা এই মাধ্যমকে সাংবাদিকতা হিসেবে স্বীকার করতে চান না, তারা হয়তো এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে অক্ষম। দ্বিতীয়ত, অনেকেই বলে থাকেন, ছোট পত্রিকা বা কম প্রচারিত সংবাদমাধ্যমে কাজ করা ব্যক্তিরা প্রকৃত সাংবাদিক নন। এই ধারণা একেবারেই ভিত্তিহীন। পত্রিকা ছোট হোক বা বড়, যারা পেশাগতভাবে সংবাদ সংগ্রহ, সম্পাদনা এবং প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত, তারা সবাই সাংবাদিক। সরকারের অনুমোদন নিয়ে প্রকাশিত কোনও পত্রিকায় যদি কেউ কাজ করেন, তবে তাকে অসাংবাদিক বলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বড় পত্রিকার প্রচারসংখ্যা বেশি হতে পারে, তাদের আর্থিক সামর্থ্যও বেশি হতে পারে, কিন্তু পেশাদারিত্বের মানের বিচার ছোট পত্রিকাগুলোর ক্ষেত্রেও সমান হওয়া উচিত। চট্টগ্রামের সাংবাদিক সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে সাংবাদিক হিসেবে স্বীকার করতে রাজি নয়। তাদের এই সংকীর্ণ মানসিকতা কেবল পেশাটির ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। প্রকৃত সাংবাদিকতা সহযোগিতার মাধ্যমে পেশাদারিত্ব বৃদ্ধি এবং ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য। কিন্তু যেসব তথাকথিত “জ্ঞানপাপী” নিজেদের ছাড়া অন্য কাউকে স্বীকার করতে চায় না, তারা এই পেশার নৈতিকতার সঙ্গে প্রতারণা করছে। তাছাড়া, এমন অনেক সদস্য আছেন যারা আর সাংবাদিকতা পেশায় নেই, তবুও তারা প্রেসক্লাবের সদস্যপদ ধরে রেখেছেন। অথচ যারা নিয়মিত সাংবাদিকতা করছেন, তারা সদস্যপদ পেতে হিমশিম খাচ্ছেন। এটি ক্লাব পরিচালনার দুর্বল নীতিমালার একটি বড় উদাহরণ। সদস্যপদের ক্ষেত্রে নিয়মিত পেশাগত কার্যক্রমের ভিত্তিতে সদস্য নির্বাচন করা উচিত। এই সমস্যাগুলোর সমাধান জরুরি। চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবসহ দেশের সমস্ত সাংবাদিক সংগঠনগুলোকে নতুন প্রযুক্তি ও মাধ্যমগুলোকে স্বীকার করতে হবে এবং সদস্যপদের প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং যুগোপযোগী করতে হবে। সাংবাদিকতার জন্য প্রয়োজন সমতা, সহযোগিতা এবং নৈতিকতার ভিত্তিতে কাজ করা, যা এই পেশার প্রতি সম্মান ও আস্থা তৈরি করবে।
চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে এই অসঙ্গতিগুলো শুধুমাত্র একটি ক্লাবের সংকট নয়, এটি বৃহত্তর সাংবাদিকতার নৈতিক সংকটের প্রতিফলন। পেশাটি সবার জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে, যাতে নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকরা তাদের প্রতিভা, পরিশ্রম এবং উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে সাংবাদিকতার উন্নতি সাধন করতে পারে। সংকীর্ণ মানসিকতার পরিবর্তনই এক্ষেত্রে একমাত্র সমাধান।
লেখকঃ চট্টগ্রাম বিভাগীয় ব্যুরো প্রধান ও যুগ্ন সম্পাদক, দৈনিক ভোরের আওয়াজ ও The Daily banner এবং গবেষক, কথা সাহিত্যিক টেলিভিশন উপস্থাপক।