নামি-দামি বনাম নামধারী সাংবাদিকঃ
-মো. কামাল উদ্দিন।
সাংবাদিকদের দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়—নামি-দামি সাংবাদিক এবং নামধারী সাংবাদিক। নামি-দামি সাংবাদিকরা সাংবাদিকতা করেন বিবেকের তাড়নায়, আর নামধারী সাংবাদিকরা করেন পেটের তাগিদে। সমস্যা হলো, সাধারণত মানুষ নামি-দামি সাংবাদিকদের চিনতে পারে না। কিন্তু নামধারী সাংবাদিকদের সকলেই চেনেন, জানেন। নামি-দামি সাংবাদিকরা নৈতিকতার বাণী নিয়ে লিখলেও তাদের অর্থনৈতিক সংকটের সমাধান কেউ করে না। তারা নামধারীদের মতো দালালি, চাঁদাবাজি, তোষামোদ করে উপার্জন করতে পারেন না, ফলে সংকট বাড়তে থাকে।
সরকারও নামি-দামি সাংবাদিকদের কোনোরূপ সুবিধা দেয় না। বিশেষ করে, মালিক পক্ষের কাছে নামধারী সাংবাদিকদের গুরুত্ব বেশি। কারণ, তাদের মোটা অঙ্কের বেতন দিতে হয় না, বরং তাদের চাঁদাবাজি ও ধান্দাবাজির অংশ থেকে মালিকও কিছু সুবিধা পান। যদিও সব মালিক এরকম নন, কিছু কিছু মালিক এই সুযোগ নিয়ে থাকেন। আবার অনেক মালিক এসব জানেন না; মাঠ পর্যায়ের নামধারী সাংবাদিকদের সঙ্গে থাকা অফিসের কিছু কর্মী অসাধু সুবিধা ভোগ করে—এটাই হলো “ওপেন সিক্রেট।”প্রশ্ন হলো, কেন অনিয়মকে নিয়ম বানিয়ে সাংবাদিকতা করতে হবে? নামি-দামি সাংবাদিকদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ভর্তুকির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বিশ্বের কিছু দেশে সরকার এ ধরনের সুযোগ সুবিধা দিয়ে থাকে, যা আমাদেরও বিবেচনা করা উচিত।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সরকার সাংবাদিকতা এবং সংবাদপত্রকে আর্থিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে, বিশেষ করে গণমাধ্যমের টিকে থাকা এবং সাংবাদিকতার মান উন্নয়নের জন্য। এই আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা সরাসরি ভর্তুকি, বিজ্ঞাপন রাজস্ব, বা কর সুবিধার মাধ্যমে দেওয়া হতে পারে। তবে এরূপ পৃষ্ঠপোষকতা কখনো কখনো সরকারের নিয়ন্ত্রণ এবং প্রভাবের আশঙ্কা তৈরি করতে পারে। পেশাদার সাংবাদিকদের জন্য বিভিন্ন সুবিধা দেশভেদে পরিবর্তিত হয়, তবে কিছু সাধারণ সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, যা নীচে আলোচনা করা হলো: ১. সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং ভর্তুকি প্রদানকারী কিছু দেশ:ক) নরওয়েতে সরকার সংবাদপত্রের জন্য ভর্তুকি এবং আর্থিক সহায়তা প্রদান করে। তারা ছোট ও স্বাধীন সংবাদপত্রগুলোকে সহায়তা করার মাধ্যমে বহুমাত্রিক সাংবাদিকতা বজায় রাখতে চায়। এ ধরনের ভর্তুকি মূলত বাণিজ্যিক চাপ থেকে মুক্ত সাংবাদিকতার বিকাশে সহায়ক হয়।
খ) ফ্রান্স:ফ্রান্স সরকার সংবাদপত্রগুলিকে আর্থিক ভর্তুকি প্রদান করে, বিশেষ করে যারা স্থানীয় সংবাদ কভার করে এবং বাণিজ্যিক চাপ কমাতে সরকারি সহায়তা দরকার। সরকার সংবাদপত্রের জন্য পোস্টাল সার্ভিস, কাগজের খরচে ভর্তুকি দেয় এবং কখনো বিজ্ঞাপনী সহযোগিতাও করে।
গ) কানাডা: কানাডা সরকার স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে টিকিয়ে রাখতে ভর্তুকি এবং অন্যান্য আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে। এটি বিশেষ করে ছোট ও স্বাধীন সংবাদ মাধ্যম গুলোর জন্য প্রযোজ্য। কানাডা সরকার “Journalism Labour Tax Credit” চালু করেছে, যার মাধ্যমে সাংবাদিকদের মজুরির উপর ট্যাক্স ক্রেডিট প্রদান করা হয়। ঘ) যুক্তরাজ্যের সরকারও স্থানীয় সংবাদপত্রগুলোকে টিকিয়ে রাখতে ভর্তুকি দেয়। তবে সেখানে BBC-এর মত সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত গণমাধ্যমও রয়েছে, যা সরকার কর্তৃক আর্থিকভাবে পৃষ্ঠপোষিত।
২. পেশাদার সাংবাদিকদের জন্য সুবিধা: ক) অর্থনৈতিক সুবিধা:
সাংবাদিকরা দেশে ভেদে সরকারি বা বেসরকারি বিভিন্ন সুবিধা পান। বিশেষ করে সংবাদমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকরা বেতন, ভাতা, স্বাস্থ্যসেবা, বীমা ইত্যাদি পেতে পারেন। কিছু দেশ সাংবাদিকদের পেনশন সুবিধাও প্রদান করে।
খ) ট্যাক্স সুবিধা:
কিছু দেশে সাংবাদিকদের ট্যাক্স ছাড় সুবিধা দেওয়া হয়, বিশেষ করে যারা নির্দিষ্ট প্রজেক্ট বা বিষয়ভিত্তিক সাংবাদিকতায় জড়িত থাকেন। কানাডার মত দেশে সাংবাদিকদের মজুরির ওপর কর ছাড় সুবিধা দেওয়া হয়।গ) সরকারি প্রণোদনা ও সুরক্ষা:
যে সমস্ত সাংবাদিকরা চ্যালেঞ্জিং ও বিপদসংকুল পরিবেশে কাজ করেন, তাদেরকে সরকার প্রায়শই সুরক্ষা প্রদান করে। এছাড়া কিছু দেশ বিপদসংকুল এলাকায় কর্মরত সাংবাদিকদের জন্য বিশেষ বীমা বা ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা রাখে।ঘ) প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন: অনেক দেশ সাংবাদিকদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। কিছু দেশে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম বা ফেলোশিপও দেওয়া হয়, যাতে সাংবাদিকরা তাদের পেশাগত দক্ষতা বাড়াতে পারেন।
ঙ) আইনি সহায়তা:
সাংবাদিকদের আইনি সমস্যার সম্মুখীন হলে কিছু সরকার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা তাদের আইনি সহায়তা প্রদান করে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা বা হুমকি থেকে রক্ষা করার জন্য এই ধরনের সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ৩. বিশেষ সুবিধা এবং সম্মান:কিছু দেশে সরকার পেশাদার সাংবাদিকদের জন্য বিশেষ সম্মাননা ও পুরস্কার প্রদান করে। যেমন, ফ্রান্সে সাংবাদিকদের জন্য “Legion of Honour” বা অন্যান্য সরকারি পুরস্কার রয়েছে। এ ধরনের পুরস্কার সাংবাদিকদের কাজের প্রতি সরকার এবং সমাজের সম্মান প্রদর্শন করে।
চূড়ান্ত মূল্যায়ন:
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাংবাদিকতা একটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত। অনেক দেশ সরকারি সহায়তা প্রদান করলেও, এর সঠিক ব্যবহারের জন্য স্বচ্ছতা এবং স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকা জরুরি। সাংবাদিকতা সমাজের জন্য অপরিহার্য, তাই সাংবাদিকদের অর্থনৈতিক ও পেশাগত সুরক্ষার ব্যবস্থা করা উচিত, যাতে তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন।
আরো একটু খোলাসা ভাবে আলোচনার প্রয়োজন-সাংবাদিকতার সত্যিকারের রূপ: বিবেকের তাড়না বনাম পেটের তাগিদ
সাংবাদিকতা এক পবিত্র পেশা, যার মূল কাজ হলো সত্য প্রকাশ করা এবং জনসাধারণের অধিকার রক্ষা করা। কিন্তু আমাদের সমাজে এই পেশার ভেতরে দুটি ভিন্ন ধারা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একদিকে আছেন নামি-দামি সাংবাদিক, যারা আদর্শ, নীতি এবং বিবেকের তাড়নায় সাংবাদিকতা করেন। অন্যদিকে আছেন নামধারী সাংবাদিক, যাদের কাছে সাংবাদিকতা শুধুমাত্র অর্থ উপার্জনের একটি মাধ্যম, যেখানে তোষামোদ, দালালি, এবং চাঁদাবাজি মূল ভূমিকা পালন করে।
নামি-দামি সাংবাদিকদের অবস্থা: নামি-দামি সাংবাদিকরা সবসময় সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন, ন্যায়ের সপক্ষে লিখেন। তাদের কাজ নির্ভীক এবং নিরপেক্ষ, তারা কোনো চাপের কাছে নতিস্বীকার করেন না। কিন্তু এই শ্রেণির সাংবাদিকদের কদর সাধারণ মানুষ বা মালিকদের কাছে খুব একটা নেই। তারা কেবল নিজের বিবেকের তাগিদে কাজ করে যান, অর্থনৈতিক সংকটে পড়লেও তাদের সংগ্রাম থামে না। এই সাংবাদিকদের জন্য সরকার বা সমাজের পক্ষ থেকে তেমন কোনো সহায়তা আসে না, যা তাদের সংকট নিরসনে সহায়ক হতে পারে। অথচ, তাদের লেখা এবং চিন্তা-ভাবনা সমাজের জন্য অনেক বেশি মূল্যবান। নামধারী সাংবাদিকদের প্রভাব: অপরদিকে নামধারী সাংবাদিকদের বেশিরভাগই পরিচিত মুখ। তারা চটুল সংবাদ, রাজনৈতিক তোষামোদি, চাঁদাবাজি ও দালালির মাধ্যমে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেন। এদের কাজের মধ্য দিয়ে অনেক সময় সত্য গোপন থাকে, এবং সমাজের ক্ষতি হয়। এর ফলে, এই সাংবাদিকরা সমাজে বেশ প্রভাবশালী হয়ে ওঠে এবং তাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে কিছু অসাধু মালিকরা। তারা কম বেতনে কাজ করেন এবং তাদের অসৎ উপার্জন মালিকদেরও কিছু সুবিধা দেয়। এতে করে, নামি-দামি সাংবাদিকদের তুলনায় নামধারী সাংবাদিকদের মূল্যায়ন বেশি হয়, কারণ তাদের জন্য মালিকদের অর্থনৈতিক খরচ কম। ব্যবস্থা পরিবর্তনের প্রয়োজন: প্রশ্ন থেকে যায়, কেন অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করে সাংবাদিকতা করতে হবে? নামি-দামি সাংবাদিকদের এই অর্থনৈতিক সংকট থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। বিশ্বের কিছু দেশে সরকার সাংবাদিকদের জন্য ভর্তুকি বা সহায়তা প্রদান করে থাকে, যাতে তারা স্বাধীন ভাবে, নির্ভয়ে কাজ করতে পারেন। আমাদের দেশেও এমন একটি ব্যবস্থা চালু করা উচিত, যাতে প্রকৃত সাংবাদিকরা তাঁদের মেধা এবং বিবেকের তাগিদে কাজ করতে পারেন, অর্থনৈতিক চিন্তা ছাড়াই।
নামি-দামি সাংবাদিকরা হলো সমাজের দর্পণ, যারা সত্যকে উন্মোচন করেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ান। কিন্তু তাদের কাজের মূল্যায়ন যদি ঠিক ভাবে না হয়, তাহলে সাংবাদিকতার মূল উদ্দেশ্য নষ্ট হয়ে যায়। তাই সরকার, সমাজ এবং মালিকদের যৌথভাবে উদ্যোগ নিতে হবে যেন সাংবাদিকতার এই বিভাজন মুছে যায়, এবং প্রকৃত সাংবাদিকরা তাদের প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মান পেতে পারে।
লেখকঃ সাংবাদিক গবেষক টেলিভিশন উপস্থাপক ও মহাসচিব,চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরাম।