চট্টগ্রামে ডবলমুরিং থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) বাবুল আজাদ ও সাংবাদিকদের মধ্যে সংঘাত সাম্প্রতিক সময়ে তীব্র আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিষয়টি শুধু একটি শ্রমিক আন্দোলনের সমাধানকে কেন্দ্র করে শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত তা সাংবাদিক বনাম পুলিশের দ্বন্দ্বে পরিণত হয়েছে। ঘটনার জটিলতায় একদিকে পুলিশের প্রতি জনআস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, অন্যদিকে সাংবাদিক সমাজও সমালোচনার মুখে পড়ছে—তাদের ভূমিকা কতটুকু দায়িত্বশীল ছিল তা নিয়েও জনমনে প্রশ্ন উঠেছে।
শ্রমিক আন্দোলন থেকে উত্তেজনার সূচনা-২০ আগস্ট দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আগ্রাবাদ চৌমুহনী এলাকায় ৪-৫ শত গার্মেন্টস শ্রমিক তিন মাসের বকেয়া বেতনের দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বসেন। ব্যস্ততম এই বাণিজ্যিক এলাকায় যানজট সৃষ্টি হলে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজ ওসি বাবুল আজাদকে ঘটনাস্থলে যেতে নির্দেশ দেন। ওসি শ্রমিকদের দাবি খতিয়ে দেখে জানান, প্রকৃতপক্ষে বকেয়া রয়েছে দেড় মাসের। এরপর তিনি গার্মেন্টস মালিক হুমায়ুনকে থানায় নিয়ে আসেন এবং শ্রমিকদেরকে আশ্বস্ত করেন বকেয়া বেতন পরিশোধ হবে। শ্রমিকরা প্রথমে অবরোধ তুলে নেয় এবং থানার দিকে চলে আসে।
কিন্তু পরে থানার ভেতর মালিক-শ্রমিক বৈঠক চলাকালে পরিস্থিতি আবারও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। অভিযোগ উঠেছে, কয়েকজন সাংবাদিক লাইভ ভিডিও প্রচার ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উসকানিমূলক পোস্ট দেওয়ার কারণে পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে।
ওসি বাবুল আজাদ বনাম সাংবাদিকরা-এ সময় ওসি বাবুল আজাদ সাংবাদিকদের অনুমতি ছাড়া ভিডিও ধারণ ও ছবি তোলার বিষয়ে আপত্তি জানান। এর জের ধরে সাংবাদিকদের সঙ্গে তীব্র বাকবিতণ্ডা শুরু হয়। সাংবাদিকদের অভিযোগ, ওসি তাদেরকে অপমানজনক ও হেনস্তামূলক কথা বলেছেন। অপরদিকে ওসি বাবুল আজাদ দাবি করেন—
“আমি পরিস্থিতি শান্ত করতে চেয়েছি। কিন্তু কয়েকজন সাংবাদিক অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন, যা সমাধানের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।” শেষ পর্যন্ত তিনি সাংবাদিকদের থানার বাইরে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন। এতে সাংবাদিকরা আরও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে ধরেন। সাংবাদিকদের অভিযোগ-
জায়যায়দিন পত্রিকার মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিক সরাসরি অভিযোগ করেন যে, ওসি বাবুল আজাদ তাকে প্রকাশ্যে অপমান করেছেন এবং হেনস্তা করেছেন। তিনি এর বিচার দাবি করেছেন।
ওসির ব্যাখ্যা ও দুঃখ প্রকাশ-
পরবর্তীতে ওসি বাবুল আজাদ গণমাধ্যমকে জানান— “আমি কখনোই সাংবাদিকদের অসম্মান করার পক্ষপাতী নই। আমি সারাদিন শ্রমিক-মালিক সমাধান করতে ব্যস্ত ছিলাম। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে যে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে, তার জন্য আমি দুঃখ প্রকাশ করছি। সাংবাদিক সমাজ আমার আপনজন, আমি আশা করি ভবিষ্যতে আর এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না।”
পুলিশ কমিশনারের বক্তব্য
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজ বলেন—“যে-ই অপরাধ করুক না কেন, তদন্তের মাধ্যমে সত্য উদঘাটন করা হবে এবং আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে পুলিশের দায়িত্ব হচ্ছে জনস্বার্থে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, সেটি অব্যাহত থাকবে।” এদিকে তার একটি ওয়্যারলেস বার্তা ফাঁস হওয়ায় সম্প্রতি এক কনস্টেবলকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যা নিয়ে পুলিশ বাহিনীর ভেতরে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে।
প্রেক্ষাপট ও বিশ্লেষণ- চট্টগ্রামের পাহাড়তলী থানায় আগুনের ঘটনার পর ধ্বংসস্তূপ থেকে নতুন রূপে থানাটি গড়ে তোলেন ওসি বাবুল আজাদ। অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও জনআস্থা ফেরাতে তার ভূমিকা ছিল প্রশংসিত। এজন্যই পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজ তাকে ডবলমুরিং থানার দায়িত্ব দেন। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনার পর প্রশ্ন উঠেছে—এই অভিজ্ঞ ওসি কি সত্যিই সাংবাদিক হেনস্তা করেছেন, নাকি শ্রমিক আন্দোলনের জটিল প্রেক্ষাপটে ভুল বোঝাবুঝিই বড় আকার ধারণ করেছে?
অনেকে বলছেন, সাংবাদিকদের দায়িত্বশীল ভূমিকার অভাবেই পরিস্থিতি জটিল হয়েছে। আবার সাংবাদিক সমাজের দাবি—আইনের রক্ষক হয়েও ওসি কোনো অবস্থাতেই সাংবাদিকদের অপমান করতে পারেন না। একটি শ্রমিক আন্দোলনকে ঘিরে শুরু হওয়া এই সংঘাত এখন পুলিশের ভাবমূর্তি ও সাংবাদিকতার স্বাধীনতার জন্য পরীক্ষার মুহূর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিস্থিতি তদন্তের মাধ্যমে সঠিক বিচার না হলে ভবিষ্যতে পুলিশ-সাংবাদিক সম্পর্ক আরও অবনতি ঘটতে পারে—এমন আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।