একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চারটি স্তম্ভের মাঝে একটি হলো সংবাদ মাধ্যম। আইনসভা শাসন বিভাগ বিচার বিভাগ এবং সংবাদ মাধ্যম এই চারটি স্তম্ভ রাষ্ট্রের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা ও নাগরিকদের অধিকার সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রশ্ন উঠেছে বাংলাদেশে সংবাদ মাধ্যমের বাস্তব চিত্র কি?
কথা হয় একটি স্বনামধন্য পেশাজীবী সাংবাদিক সংগঠনের নেতার সাথে তিনি বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে এদেশের সাংবাদিক সমাজ তাদের অধিকার ও মর্যাদার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত তেমন কোন অগ্রগতি নেই। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর সাংবাদিক সুরক্ষা আইন' নামে একটি অধ্যাদেশ জারি করতে যাচ্ছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। দীর্ঘ ৫৩ বছর অধিকার হারা সাংবাদিক সমাজ কতটা অধিকার ফিরে পাবে এই আইনে? সাংবাদিকতার অধিকার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়া চূড়ান্ত করেছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। সেখানে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সহিংসতা, হুমকি ও হয়রানি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ধরনের অপরাধের জন্য দোষী ব্যক্তিকে মাত্রাভেদে এক থেকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা ন্যূনতম এক লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। খসড়ায় অংশীজনের মতামত নেওয়ার পর অনুমোদনের জন্য উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে বলে তথ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট জনেরা বলেন, পৃথিবী জুড়ে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃত এই অর্গান টি বাংলাদেশে ব্যাপক বৈষম্যের শিকার। সরেজমিন অনুসন্ধানে উঠে আসে পেশাজীবী সাংবাদিকদের পেশাগত নিরাপত্তাহীনতা, ব্যাক্তি ও পারিবারিক জীবনের করুণ চিত্র। যারা প্রতিদিন মানুষের অধিকার, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব,গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে জীবন বাজি রেখে কাজ করে, তাদের জন্য রাষ্ট্রের কোন দায় আছে বলে কোন দৃষ্টান্ত চোখে পড়েনা। একইভাবে সংবাদপত্র ও বিভিন্ন মিডিয়ার মালিকদের কাছেও হয়রানির শিকার হয় সাংবাদিক সমাজ। তাই পেশাজীবী সাংবাদিকরা রুটিরুজির সংগ্রামে অনেক পিছিয়ে। জানা গেছে, আশির দশক ও নব্বই দশকের পর সাংবাদিক দের আবাসন নিয়েও কোন সরকারি উদ্যোগ চোখে পড়েনি। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত সহ বিশ্বের অনেক দেশেই সাংবাদিক দের জন্য আবাসন প্রকল্প সহ সরকারি ভাবে রেশনিং এর সিস্টেম চালু আছে। পেশাজীবী সাংবাদিকদের রেশনিং এর আওতায় আনতে ও আবাসন সমস্যার আলোচনা থাকলেও বাস্তবে কোন অগ্রগতি নেই। এছাড়াও আইনি পরিকাঠামোয় সাংবাদিকতা পেশার কোন নীতিমালাও তৈরি হয়নি এপর্যন্ত। সাংবাদিকদের কাজের জন্য বিপজ্জনক দেশের তালিকায় নাম এসেছে বাংলাদেশের। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে এই তালিকায় নাম আছে পাকিস্তানেরও। তবে এ বছর সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক নয়টি দেশের মধ্যে শীর্ষে আছে যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিনের নাম। সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরেছে বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স ।সবচেয়ে বিপজ্জনক নয়টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে তৃতীয় অবস্থানে।
এসব নিয়ে কথা হয় ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন একাংশের সভাপতি সাজ্জাদ আলম খান তপুর সাথে তিনি বলেন,সাংবাদিকদের পেশাগত সুরক্ষার জন্যে আইন প্রয়োজন। তবে তা চুড়ান্ত করতে হবে অংশীজনদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে। শারীরিক নির্যাতন বা মামলার মাধ্যমে হয়রানির হাত থেকে রক্ষা যেমন পাওয়া দরকার, পাশাপাশি আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়টিও আইনে সম্পৃক্ত হওয়া প্রয়োজন। মর্যাদার সাথে বেচে থাকতে এবং নিরাপদ কর্ম পরিবেশের জন্যে সমন্বিত আইন প্রয়োজন। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে হয়রানিমূলক মামলা দিয়ে সাংবাদিকদের হয়রানি করা হয়। বেতন-ভাতা বকেয়া রাখার মাধ্যমে মানসিক নির্যাতনের মুখে পড়েন সাংবাদিকরা। আর্থিক-মানসিক-শারীরিক সুরক্ষার জন্যে সমন্বিত আইন প্রয়োজন। সাংবাদিক নির্যাতনকারী ও হত্যাকারীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার সর্বোচ্চ শাস্তি প্রয়োজন। একই সাথে হয়রানিমূলক মামলা করে তাদেরও শাস্তির আওতায় আনার বিধান থাকা প্রয়োজন।
সামগ্রিকভাবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে নিউজপেপার্স ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ । ৮ আগস্ট ২০২৫ নোয়াবের বিবৃতিতে বলা হয়, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সর্বশেষ প্রতিবেদনে গণমাধ্যম ও তথ্য প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে যে চিত্র ফুটে উঠেছে, তা দুঃখজনক।নোয়াবের পক্ষ থেকে বলা হয়,‘গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার যে প্রত্যাশা নিয়ে দেশবাসী ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, সেখানে তথ্যপ্রকাশ, মতপ্রকাশ এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার মতো মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত হবে বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেছিলাম। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, গত এক বছরে সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।টিআইবির তথ্য মতে, আগস্ট ২০২৪ থেকে জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত ৪৯৬ জন সাংবাদিক হয়রানির শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ২৬৬ জনকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানসংক্রান্ত হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে। দায়িত্ব পালনকালে তিনজন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। কমপক্ষে ২৪ জন গণমাধ্যমকর্মীকে পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছে, আটটি সংবাদপত্রের সম্পাদক এবং ১১টি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের বার্তাপ্রধানকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
পরিস্থিতি বিবেচনায় একটি অবাধ ও গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সরকারকে জরুরিভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছে নোয়াব।বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে,১৯৭১ সালের ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে ৪ জন সাংবাদিক শহীদ হয়েছিলেন। আর জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ৬ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়। ফ্যাসিস্ট হাসিনার গত ১৬ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে ৩০ জন সাংবাদিক হত্যার শিকার ও দেড় হাজার সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা ও নির্যাতন চালানো হয়। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে রংপুরে ৬ জন সাংবাদিক পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকার এখন পর্যন্ত সাংবাদিক হত্যার বিচারে দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখাতে পারেনি। এমনকি সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন পর্যন্ত দিতে পারেনি। এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ এ পর্যন্ত ১১৯ বার পেছানো হয়েছে।বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে রিপোর্টিংয়ের সময় অথবা সাংবাদিকতা চর্চার কারণে নিহত বা হত্যা করা হয়েছে এমন সাংবাদিকদের সম্পর্কে,কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্ট নামক সংস্থা নিশ্চিত করেছে যে ১৯৯২ সাল হতে এ পর্যন্ত ৩৩জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন।জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ’ অর্থাৎ সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে যেকোনো মূল্যে সুরক্ষা দিতে হবে। আইনি কাঠামো দ্বারা সুরক্ষা না দিলে সাংবাদিক সমাজ প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রযন্ত্র দ্বারা নিগৃহীত হতে থাকবে।
রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক মানবিক ও নৈতিক পরিমাপে নির্মাণ করতে হলে অবশ্যই সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করতে হবে। ২২ মে ২০২৫ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সম্পাদক মণ্ডলীর ভার্চ্যুয়াল সভায় দলটির সভাপতি আ স ম আবদুর রব এসব কথা বলেন।তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সব স্তরে এবং আইন প্রণয়ন ও নীতি নির্ধারণে সাংবাদিক সমাজের অংশগ্রহণের প্রয়োজন আজ সময়ের দাবি। যতদিন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে সাংবাদিক সমাজের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে না ততদিন পর্যন্ত স্বাধীন সাংবাদিকতাও সম্ভব হবে না এবং সাংবাদিকরা পেশাগত দায়িত্ব সম্পাদনে রাষ্ট্রযন্ত্র দ্বারা নিগৃহীত এবং পিষ্ট হতে থাকবেন।ফলে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে দায়িত্ব পালনে গণমাধ্যম ক্রমাগতভাবে ব্যর্থ হতে থাকবে। তাই বাঙালির তৃতীয় জাগরণের এ কালে জাতি বিনির্মাণে আজ সাংবাদিক সমাজকে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব এবং প্রশাসনে অংশগ্রহণের জন্য আওয়াজ তুলতে হবে।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ শাহজালাল, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন,যুগ্ম-সম্পাদক :মো. কামাল উদ্দিন,
নির্বাহী সম্পাদক : রাবেয়া সিরাজী
বার্তা ও বাণিজ্য বিভাগ : মোতালেব ম্যানশন, ২ আর কে মিশন রোড, মতিঝিল, ঢাকা-১২০৩।
মোবাইল : 01796-777753,01711-057321
ই-মেইল : bhorerawajbd@gmail.com