তিন রঙা পতাকার অপমান: টিএসসিতে রাজাকারের ছবি টাঙিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে কুঠারাঘাত”
তিন রঙা পতাকার গল্পটা কি তোমরা ভুলে গেছো?
লাল রঙটা কিসের, বলতে পারো?
সেটা কোনো ডিজাইন নয়,
তা আমাদের বাবার রক্ত, মায়ের আহাজারি—
তা একাত্তরের গর্ভফাটা চিৎকার!
এই মাটি কথা বলে,
শোনো— এখানে রাজাকারদের পদচিহ্ন আগুন হয়ে জ্বলে,
এখানে গোলাম আজমের নাম উচ্চারণ মানে শহীদের কবর অবমাননা।
তবুও আজও কেউ কেউ ওদের ছবি টাঙায়,
মুক্তিযুদ্ধকে মুখোমুখি দাঁড় করায় বিকৃত রাজনীতির তকমায়!
তুমি কি শুনতে পাও না, শহীদেরা আজও কাঁদে?
তুমি কি দেখতে পাও না, রণাঙ্গনের কুয়াশায়
রক্তমাখা ব্যান্ডেজ হাতে দাঁড়িয়ে আছে একজন মুক্তিযোদ্ধা—
জানায় আহ্বান:
"এই বাংলাদেশ রাজাকারদের নয়…
এই বাংলাদেশ গোলাম আজমের নয়…
এই বাংলাদেশ আমার রক্তে কেনা—
তাকে অপমান করতে দিলে, সে রক্ত বৃথা যাবে…
তোমরা থেমো না, দাঁড়াও, রুখে দাঁড়াও…!"
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ কোনো মতাদর্শের ছায়া নয়, এটি ছিল সাম্রাজ্যবাদ ও শোষণের বিরুদ্ধে এক রক্তঝরা প্রতিরোধ। সে যুদ্ধ ছিল মানুষের অধিকার, ভাষা, সংস্কৃতি ও মর্যাদার জন্য। সেই মহান মুক্তিযুদ্ধকে অসম্মান করে কেউ যদি স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তির ছবিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মত একটি মুক্ত বুদ্ধির চত্বরে প্রদর্শন করে, তা শুধু কুরুচিপূর্ণই নয়, ইতিহাস বিকৃতির এক ভয়াবহ উদাহরণ হয়ে দাঁড়ায়। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি প্রাঙ্গণে ইসলামী ছাত্রশিবির আয়োজিত এক প্রদর্শনীতে এইরকমই ঘটনা ঘটেছে। এতে টগবগ করে ফুটে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধপ্রেমী ও গণতান্ত্রিক চেতনার মানুষদের ক্ষোভ, প্রতিবাদে উত্তাল হয়েছে রাজপথ, সোচ্চার হয়েছে বুদ্ধিজীবী সমাজ।
ঘটনার বিবরণ:
জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস উপলক্ষে ইসলামী ছাত্রশিবির ৩ আগস্ট থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে ‘আমরাই ৩৬ জুলাই: আমরা থামব না’ শীর্ষক এক প্রদর্শনীর আয়োজন করে। প্রদর্শনীতে একাধিক পোস্টারে দেখা যায় যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ও দণ্ডিত ব্যক্তি — মতিউর রহমান নিজামী, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ একাধিক রাজাকারের ছবি। এটি মুহূর্তেই বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষার্থী মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়।
সবার আগে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী উমামা ফাতেমা। ৫ আগস্ট সন্ধ্যা ৬টা ৯ মিনিটে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে তিনি লিখেন:
‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এই বাংলাদেশের জন্ম, আর ২৪-এর অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১৭ বছরের স্বৈরাচারী ব্যবস্থার পতন। জনগণের সংগ্রামের ধারায় বাংলাদেশের ইতিহাস নির্মিত হয়েছে। এই ছবির প্রতি চূড়ান্ত ঘৃণা জানিয়ে দিলাম।'
তিনি আরও বলেন,
‘জুলাই অভ্যুত্থানকে বিতর্কিত করে ৭১-এর বিপক্ষে দাঁড় করানোর এক ঘৃণ্য অপচেষ্টা হয়েছে। এটি লাখো শহীদের রক্তের প্রতি চূড়ান্ত অবমাননা।’
প্রতিবাদ ও প্রশাসনের হস্তক্ষেপ:
বাম ছাত্র সংগঠন ও বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস)-এর নেতাকর্মীরা সরাসরি ঘটনাস্থলে গিয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। তাদের উপস্থিতি এবং আন্দোলনের মুখে প্রদর্শনী থেকে বিতর্কিত ছবি সরিয়ে নেয়া হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিক্রিয়া:
মওলানা ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক, বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু এই ঘটনাকে দেশের ইতিহাসের প্রতি ভয়ংকর অবমাননা হিসেবে অভিহিত করে বলেন:
“একাত্তরের পরাজিত শক্তিরাই আজ ৫৪ বছর পর এসে মুখ খুলে বলছে তারা দেশপ্রেমিক! তাহলে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা কী? যারা একাত্তরের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামকে অস্বীকার করে, তারা চরম বিশ্বাসঘাতক। তাদের স্থান ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে।”
তিনি আরও বলেন,
“আজ যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে রাজাকারদের ছবি টাঙিয়ে নিজেদের ‘জাতীয় শক্তি’ হিসেবে তুলে ধরছে, তারা শেখ হাসিনার তৈরি করা একনায়কতন্ত্রের ফসল। তার স্বৈরাচারী শাসন ও দমন-পীড়নের সুযোগ নিয়ে রাজাকারের উত্তরসূরীরা আজও বেঁচে আছে এবং বিষ ছড়াচ্ছে।”
আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গে রফিকুল ইসলাম বাবলুর বক্তব্য: রফিকুল ইসলাম বাবলু আওয়ামী লীগের অতীত গৌরবের কথা স্মরণ করে বলেন:
“এই দল ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা এসে দলটিকে কলঙ্কিত করেছে। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে জুতার মালা পরানো, প্রস্রাব করা — এই ধরনের ঘটনা শেখ হাসিনার ব্যর্থ নেতৃত্ব ও নৈতিক পতনের পরিচায়ক।”
তিনি বলেন,
“আমরা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে বলি না, বরং শেখ হাসিনাকে দায়ী করি যিনি একনায়কতন্ত্র কায়েম করে, গুম-খুন আর ভোটাধিকার হরণ করে দেশটাকে আজ অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছেন।”
রাজনীতির ভবিষ্যৎ ও নির্বাচন প্রসঙ্গে বক্তব্য:
শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু বলেন:
“বাংলার মানুষের এখন একটাই দাবি— নিরপেক্ষ নির্বাচন। আমরা বিএনপির নেতৃত্বে একটি জাতীয় ঐক্য গঠনের মাধ্যমে সেই দাবিকে বাস্তবে রূপ দিতে চাই। শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে গেলেও নির্বাচনবিহীন শাসন আবার চালু হয়েছে। এটা চলতে পারে না।”
তিনি আরও বলেন:
“ড. ইউনুসের যে সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, সেটা আমাদেরও কাম্য। তবে সেটা রাজনৈতিক সরকার ছাড়া সম্ভব নয়। একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর ছাড়া এই সংস্কার বাস্তবায়ন হবে না।
একাত্তরের চেতনা আজও জীবিত। কিন্তু তা ক্রমাগত আঘাতের সম্মুখীন। রাজাকারের উত্তরসূরীরা আজ তাদের বয়ান সমাজে ছড়াতে শুরু করেছে। এটি শুধুমাত্র রাজনৈতিক শূন্যতার সুযোগ নয়, বরং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপশক্তির পুনর্জন্মের পূর্বাভাস।
আজ যদি ছাত্রসমাজ, নাগরিক সমাজ, প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তি ও তরুণ প্রজন্ম সোচ্চার না হয়, তাহলে এ অপচেষ্টা আরও বেপরোয়া হবে।
এ দেশ মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তে কেনা— রাজাকারদের বংশধরদের মুখস্থ ইতিহাসে নয়।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ শাহজালাল, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন,যুগ্ম-সম্পাদক :মো. কামাল উদ্দিন,
নির্বাহী সম্পাদক : রাবেয়া সিরাজী
বার্তা ও বাণিজ্য বিভাগ : মোতালেব ম্যানশন, ২ আর কে মিশন রোড, মতিঝিল, ঢাকা-১২০৩।
মোবাইল : 01796-777753,01711-057321
ই-মেইল : bhorerawajbd@gmail.com