২০শে জুন: ফিরে দেখা এক ঝড়ের দিন
সত্য বলার অপরাধে হুমকি-ধমকির ছায়ায় কাটানো এক সাংবাদিকের অভিজ্ঞতা--১
আজ ২০শে জুন ২০২৫-এই দিনটা এলেই আমার হৃদয়ে এক রকম ভার নেমে আসে। কারণ আজকের এই দিনেই, ঠিক ছয় বছর আগে, ২০১৯ সালের ২০শে জুন, আমি জীবনের এক কঠিন ও সাহসিকতায় গাঁথা অধ্যায়ের ভেতর দিয়ে গিয়েছিলাম—যে দিনটিতে আমি একজন সাংবাদিক হিসেবে নিজের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে চট্টগ্রামের চকবাজার থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে বাধ্য হয়েছিলাম।
সে সময় আমি বাংলা টিভির জনপ্রিয় টক-শো "চট্টগ্রাম সংলাপ"-এর উপস্থাপক হিসেবে কাজ করছিলাম। কর্ণফুলী নদীর পাড়ঘেঁষে গড়ে ওঠা অবৈধ বালু উত্তোলন সিন্ডিকেট, রাউজানের নোয়াপাড়া মৌজার বৈধ বালুমহলে চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের সশস্ত্র হামলা, বন্দরের ব্লক ৩ ও ৪ থেকে চুরি হওয়া বালু—এসব দুর্নীতির খবর আমি সরাসরি প্রচার করি। এমন কোনো কথা বলিনি যা মিথ্যা, কিন্তু তবুও সত্য বলার অপরাধে আমি হয়ে উঠি লক্ষ্যবস্তু।
হুমকি, নজরদারি ও থানায় ছুটে যাওয়া-প্রতিবেদন প্রচারের ঠিক পর থেকেই শুরু হয় হুমকি। অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসে—"আর একবার চট্টগ্রামের নদী বা বালু নিয়ে টক-শো করলেই শেষ করে দেব!" এভাবেই ভয় দেখানো হতো, যেন আমি থেমে যাই। তারপর শুরু হয় নজরদারি। আমার বাসা, চট্টেশ্বরী রোডের কর্নকর্ড টাওয়ারের আশপাশে অচেনা যুবকদের ঘোরাফেরা লক্ষ্য করি। কেউ নিচে দাঁড়িয়ে, কেউ পাশের দোকানে বসে, আবার কেউ আমাকে অনুসরণ করছে নীরবে।
তখন আমি সিদ্ধান্ত নিই, এই ঘটনা চেপে রাখব না। ২০১৯ সালের ২০শে জুন চকবাজার থানায় হাজির হয়ে স্পষ্ট ভাষায় বলি— “আমি সাধারণ ডায়েরি করতে এসেছি, কারণ আমি হুমকির মুখে। যদি আমার কিছু হয়, এ যেন নথিভুক্ত থাকে।”
সেই জিডির নম্বর ছিল ৯৩৮। দায়িত্বরত এএসআই সেটি গ্রহণ করেন।
জিডিতে আমি লিখি—বাংলা টিভিতে প্রচারিত প্রতিবেদন ও টক-শোর কারণে কর্ণফুলী নদী ও বালুমহল সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কথা বলায় আমাকে খুন কিংবা হয়রানিমূলক মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। আমার বাসার চারপাশে ঘোরাঘুরি করছে অজ্ঞাত পরিচয়ের কিছু লোক। আমি এবং আমার পরিবার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছি।
সেই সময়ের প্রভাবশালী চক্র ও বর্তমানের পুনরাবৃত্তি
সেই সময়কার চট্টগ্রামের বাস্তবতা ছিল—একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক চক্র, বিশেষ করে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এমপি ফজলে করিম চৌধুরীর আশ্রয়ে থাকা চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা নদী দখল, বালু লুট, এবং নিরীহ মাঝিদের শারীরিকভাবে আক্রমণ করত। আমার প্রতিবেদন সরাসরি তাদের স্বার্থে আঘাত করায় আমি হয়ে উঠি তাদের টার্গেট।
দুঃখজনক হলেও সত্য, ছয় বছর পরেও একই পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি ঘটছে।
বর্তমানেও যখন আমি বোয়ালখালী চরণদ্বীপের কিছু চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওয়াতায় আনার কথাসহ চট্টগ্রাম বন্দর, কর্পোরেশন, হাসপাতাল, বালু সিন্ডিকেট ইত্যাদি নিয়ে টক-শো এবং অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করছি, তখন আবারও সেই চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এখন তারা সরাসরি অস্ত্র নিয়ে আসে না, বরং ফেসবুকে মিথ্যা তথ্য ছড়ায়, আমার ছবি বিকৃত করে পোস্ট করে, এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার চালিয়ে আমার মানহানি ঘটাতে চেষ্টা করছে।
কিছু কিছু অপপ্রচারের বিরুদ্ধে আমি আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি, বাকিগুলোর বিরুদ্ধেও প্রক্রিয়া চলমান।
সাংবাদিকদের চরিত্র হননের এ কৌশল নতুন নয়, কিন্তু এতে আমি বিচলিত নই।
কারণ আমি বিশ্বাস করি, “সত্যকে দমিয়ে রাখা যায় না—যতই চাপ আসুক, সে নিজ পথ খুঁজে নেয়।”
শেষ কথাঃ থেমে থাকব না
সাংবাদিকতা শুধু আমার পেশা নয়, এটি আমার আত্মার দায়। যদি সত্য বলার জন্য আবারও হুমকি আসে, যদি আবারও থানায় যেতে হয়—তবু আমি থামবো না।
আজ ২০শে জুনে দাঁড়িয়ে আমি শুধু অতীতকে স্মরণ করছি না, বরং ভবিষ্যতের পথে নিজের সংকল্পকেও পুনরায় শক্ত করছি। বোয়ালখালী চরণদ্বীপসহ চট্টগ্রামের অসংখ্য অপরাধীদের বিরুদ্ধে বিশেষ করে
চট্টগ্রামের মাটি, কর্ণফুলীর নদী, এবং এর মানুষের সত্য তুলে ধরাই আমার দায়িত্ব—আর আমি সেই দায়িত্ব থেকে একচুলও সরবো না।
লেখক সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কলাম লেখক ও টেলিভিশন উপস্থাপক।
মহাসচিব - চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরাম।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ শাহজালাল, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন,যুগ্ম-সম্পাদক :মো. কামাল উদ্দিন,
নির্বাহী সম্পাদক : রাবেয়া সিরাজী
বার্তা ও বাণিজ্য বিভাগ : মোতালেব ম্যানশন, ২ আর কে মিশন রোড, মতিঝিল, ঢাকা-১২০৩।
মোবাইল : 01796-777753,01711-057321
ই-মেইল : bhorerawajbd@gmail.com