স্মরণছায়াঃ
"নিঃশব্দ আলোর নায়ক: লায়ন গাফফার চৌধুরীর জীবনের জয়গান"
শোকের অক্ষরে সূচনা- লিখতে বসলাম গাফফার চৌধুরীর জানাঅজানা কিছু কথা -হঠাৎ করেই এক থমকে যাওয়া সময়। শব্দহীন এক প্রস্থান। যেন সকালবেলায় সূর্য উঠলেও আলো আসে না, পাখিরা ডাকলেও সুর শোনা যায় না। এমনই এক বিষাদের দিনে আমাদের প্রিয় লায়ন মোহাম্মদ আবদুল গফফার চৌধুরী চিরবিদায় নিলেন। যাঁর স্নিগ্ধ উপস্থিতি, প্রাণচাঞ্চল্য আর সমাজগঠনমূলক কর্মকাণ্ড ছিল শত মানুষের আশ্রয়—তিনি আজ নীরব। তাঁর এ চলে যাওয়া শুধু একজন ব্যক্তির মৃত্যু নয়, এটি এক মূল্যবোধের, এক আলোকিত পথযাত্রার অবসান। হৃদয় ভারাক্রান্ত, চোখে অশ্রু, মনে তাঁর অবিনশ্বর স্মৃতি।
তাঁর মুখে ছিল না রাজা-উজিরের ভাষা, ছিল না ধনরত্নের ঝলক। কিন্তু যে চোখে স্বপ্ন দেখতেন, সে চোখে আগুন ছিল। যে হাতে পথ গড়তেন, সে হাতে ছিল নীরব প্রতিজ্ঞা। লায়ন মোহাম্মদ আবদুল গফফার চৌধুরী—একজন নিভৃতচারী আলো, যিনি কখনো শব্দ করে হাঁটেননি, কিন্তু তাঁর পথের ধুলোও কথা বলে।
তাঁকে দেখলে মনে হয়, যেন এক জীবন নদীর মোহনায় দাঁড়িয়ে আছেন তিনি, যেখানে মিশেছে প্রবাসের দিন, রাজনীতির দামামা, ব্যাংকিংয়ের কাঠিন্য আর সমাজসেবার আত্মবলি। তাঁর পায়ের নিচে সময় জমেছে, চোখে আছে সাহসের দীপ্তি, আর অন্তরে আছে একটি দেশ, একটি সমাজ, কিছু মানুষ—যাদের জন্য তাঁর এই নীরব যুদ্ধ। পাঠক, এই কলাম কেবল একটি জীবনী নয়, এটি একটি গল্প—এক Lion-এর। যিনি গর্জন করেন না, আলতো হেঁটে যান, কিন্তু রেখে যান এক অমোঘ ছাপ। জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে যিনি রেখেছেন কঠোর পরিশ্রম, আত্মনিবেদন আর নিরন্তর স্বপ্নবিলাসের ছাপ, তিনি হচ্ছেন লায়ন মোহাম্মদ আবদুল গফফার চৌধুরী। একাধারে রাজনীতিক, ব্যাংকার ও সমাজসেবী হিসেবে তাঁর যাত্রা শুধু বিস্ময়কর নয়, অনুপ্রেরণাদায়কও বটে।
ঢাকার উত্তরা ও চট্টগ্রামের চকবাজারে তাঁর আবাস, কিন্তু প্রকৃত ঠিকানা যেন তিনি গড়েছেন মানুষের হৃদয়ে
রাজনীতির শুরু সুদূর সৌদি আরবে-ব্যাংকার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও রাজনীতির প্রতি আকর্ষণ তাঁকে টেনে নেয় ভিন্ন পথে। ১৯৮৭ সালে সৌদি আরবে অবস্থানকালে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর রাজনীতিতে যুক্ত হন। এরপর দীর্ঘ সময় ধরে দলীয় দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে তিনি প্রবাসে ও দেশে দলকে সংগঠিত করেছেন। ১৯৯৫ সালে সৌদি আরব বিএনপির উপদেষ্টা হিসেবে শুরু করে, ধাপে ধাপে তিনি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপি'র সহ-সভাপতি, আহ্বায়ক, এবং সাটকানিয়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
২০১৯ সালের উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তিনি। কিন্তু সরকারদলীয় প্রার্থীর কারচুপি, সহিংসতা ও রাষ্ট্রযন্ত্রের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ নির্বাচনের মাঝপথেই তিনি নির্বাচন বর্জন করেন—এটিই তাঁর সাহসী রাজনৈতিক অবস্থানের প্রতিচ্ছবি।
ব্যাংকিং ক্যারিয়ারে অভাবনীয় সফলতা- ব্যাংকিং পেশায় তাঁর যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৩ সালে। দীর্ঘ ৪১ বছর কর্মজীবনে তিনি দেশের ও বিদেশের অসংখ্য শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকে দায়িত্ব পালন করেছেন। আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংক, BCCI, HSBC, প্রাইম ব্যাংক, এবং জামুনা ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন দেশে। সৌদি আরবে তিনি কাজ করেছেন সউদি ব্রিটিশ ব্যাংক, আল ফ্রানসি ব্যাংক (ইনডোসুজ), আল হোলান্ডি ব্যাংক (এবিএন অ্যামরো), ও সউদি ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক ব্যাংকে। ২০১৪ সালে তিনি জামুনা ব্যাংকের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট (ডিএমডি সমতুল্য) হিসেবে অবসর নেন।
সমাজসেবা ও সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ততা- ব্যক্তিজীবনে তিনি একজন মানবিক ও সমাজমনস্ক মানুষ। চট্টগ্রামের মা ও শিশু হাসপাতাল, ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন, লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনাল, সাটকানিয়া-লোহাগাড়া সমিতি, মির্জাখীল সমবায় সমিতি, সাটকানিয়া ডায়াবেটিক সমিতি, আরবিয়ান লিডারশিপ মাদরাসা এবং চিকিৎসা সেবা সংশ্লিষ্ট বহু প্রতিষ্ঠানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন। তাঁর গড়ে তোলা ‘গফফার-আমেনা-খালেক ফাউন্ডেশন’ স্থানীয় মানবিক কাজে নিয়োজিত রয়েছে।ব্যক্তিগত জীবন ও উত্তরাধিকার- পারিবারিক জীবনেও তিনি সফল। বড় ছেলে মোহাম্মদ ওসমান চৌধুরী একজন ব্যারিস্টার ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল। ছোট ছেলে মোহাম্মদ ওমর চৌধুরী আইন পেশায় যাত্রা শুরু করেছেন। কন্যা উম্মে সালমা যুক্তরাষ্ট্রে জনস্বাস্থ্য প্রশাসনের ওপর ডিগ্রি নিয়ে লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যের স্বাস্থ্যখাতে কর্মরত। পুত্রবধূ ও কন্যাসন্তানের স্বামীরাও উচ্চশিক্ষিত এবং পেশাগতভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত। সম্মাননা ও স্বীকৃতি-ব্যাংকিং ও সমাজসেবায় অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন ‘বেস্ট ব্যাংকার গোল্ড মেডেল অ্যাওয়ার্ড’, ‘মেলভিন জোনস ফেলো অ্যাওয়ার্ড’, ‘সাটকানিয়া সমিতি অ্যাওয়ার্ড’, এবং ‘লায়ন্স হিউম্যানিটারিয়ান সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড’-এর মতো সম্মাননা।
লায়ন মোহাম্মদ আবদুল গফফার চৌধুরীর জীবন আমাদের শেখায়—যে জীবনে রয়েছে সততা, সাহস, আত্মত্যাগ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব, সেই জীবনই সত্যিকারের অনুকরণীয়। তিনি এক জীবনে যেন অনেক জীবনের গল্প বয়ে চলেছেন—রাজনীতি, পেশা ও সমাজসেবায় এক ঐক্যবদ্ধ আলোকবর্তিকা হয়ে। লায়ন মোহাম্মদ আবদুল গফফার চৌধুরী—তিনি কোনো চেয়ারে বসে থাকা নেতার নাম নন, তিনি সময়ের এক নীরব স্থপতি। ব্যাংকের ঠান্ডা দেয়ালে থেকেও মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার যে শক্তি, তিনি তা দেখিয়ে দিয়েছেন। রাজনীতিতে থেকেও আত্মপ্রচার নয়, বরং নীতির প্রতি অবিচল থেকেছেন। প্রবাসের ধুলো আর দেশের মাটির গন্ধ, দুটিই তাঁর রক্তে মিশেছে। এক হাতে সমাজসেবা, অন্য হাতে রাজনীতি, মাঝে মধ্যে একটুখানি কণ্ঠে মানবিকতার সুর। তাঁর অর্জন শুধু পদ-পদবি নয়, তাঁর অর্জন মানুষের হৃদয়ে থাকা এক টুকরো শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর অনুপ্রেরণা।
আজ যখন তাঁকে নিয়ে লেখা হয়, তখন মনে হয়—এমন কিছু মানুষ রয়ে যান বলেই সমাজের ভিত নড়ে না। তিনি ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন—আলোকবর্তিকার মতো, যাঁর আলো নিঃশব্দে জ্বলে, পথ দেখায়, আর থেকে যায় দীর্ঘশ্বাসের মতো জীবনের কোনো এক শান্ত কোণে।
শ্রদ্ধা লায়ন গাফফার চৌধুরী, আপনি সময়কে ছুঁয়েছেন। এখন সময় আপনাকে মনে রাখবে।
লেখকঃ যুগ্ন সম্পাদক– দৈনিক ভোরের আওয়াজ ও The Daily Banner-
সহসভাপতি-বাংলাদেশ পেশাজীবী সাংবাদিক কো-আপারেটিভ সোসাইটি লিঃ (বাপেসাস)
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ শাহজালাল, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন,যুগ্ম-সম্পাদক :মো. কামাল উদ্দিন,
নির্বাহী সম্পাদক : রাবেয়া সিরাজী
বার্তা ও বাণিজ্য বিভাগ : মোতালেব ম্যানশন, ২ আর কে মিশন রোড, মতিঝিল, ঢাকা-১২০৩।
মোবাইল : 01796-777753,01711-057321
ই-মেইল : bhorerawajbd@gmail.com