“এই বাংলাদেশ গোলাম আজমের নয়”—স্বাধীনতা বিরোধীদের বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানীর উত্তরসূরির জ্বালাময়ী প্রতিবাদ
একান্ত সাক্ষাৎকারে শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু
২০ মে, নয়াপল্টনে নিজ দলীয় কার্যালয়ে এক গভীর রাজনৈতিক আলোচনায় বসেছিলেন মওলানা ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক এবং ভাসানী জনশক্তি পার্টির চেয়ারম্যান শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু। তার সাম্প্রতিক এক বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ায়, তার বক্তব্য ও অবস্থান ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে নানা আলোচনা। সেই প্রেক্ষিতেই তিনি মুখোমুখি হন দৈনিক ভোরের আওয়াজ ও The Daily Banner-এর প্রতিনিধির সঙ্গে। সাক্ষাৎকারজুড়ে উঠে এসেছে ইতিহাস, স্বাধীনতা, বর্তমান সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক চরিত্র, ভোটাধিকার হরণ, জবাবদিহিহীন দুর্নীতি এবং ভবিষ্যতের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ।
সাক্ষাৎকারের শুরুতেই স্পষ্ট ও অকপট উচ্চারণে শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু বলেন,
“এই বাংলাদেশ মওলানা ভাসানীর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমানের। এই বাংলাদেশ গোলাম আজম, মতিউর রহমান নিজামী বা কোনো রাজাকারের নয়।”
তার চোখেমুখে তখন ক্ষোভ, কণ্ঠে দৃঢ়তা। তিনি বলেন, “যারা পাকিস্তানের দোসর ছিল, যারা আলবদর-রাজাকারদের সংগঠন চালিয়েছে, যারা এই দেশের স্বাধীনতা চায়নি, আজ তারা এই দেশটাকেই নিজেদের দাবি করে বড় গলায় শ্লোগান দেয়—এটা মেনে নেওয়া যায় না।”
“আমরা দেশ স্বাধীন করেছিলাম, রাজাকারের চিৎকার শুনতে নয়”
শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলুর কথায়, “এই দেশ স্বাধীন হয়েছে তিরিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে। আজ যারা প্রকাশ্যে বলে, ‘এই দেশ গোলাম আজমের’, তারা আসলে সেই রক্তের প্রতিশ্রুতিকে অপমান করছে। আমি সেই অপমানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছি, করবো—তাতে যদি জীবনও যায়।”
সাম্প্রতিক সময়ে তার একটি বক্তব্য ভাইরাল হয়েছে, যেখানে তিনি বলেছেন, স্বাধীনতাবিরোধীদের সপক্ষে স্লোগান দেওয়া মানে ১৯৭১-এর শহীদদের অসম্মান করা। এই বক্তব্যের পর তাকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশংসার ঝড় ওঠে।
তিনি আক্ষেপের সঙ্গে বলেন, “আমরা কি এই দিন দেখার জন্য দেশ স্বাধীন করেছিলাম? আজ ৫৪ বছর পরও রাজাকাররা বুক ফুলিয়ে কথা বলবে? জাতীয় সংগীত পরিবেশনে বাধা সৃষ্টি হবে? জাতীয় পতাকার অসম্মান হবে? আর আমরা চুপ করে থাকব?”
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ
এই প্রসঙ্গেই সাংবাদিকরা প্রশ্ন তোলেন—এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী কে? রফিকুল ইসলাম বাবলু সরাসরি বলেন,
“এর জন্য দায়ী শেখ হাসিনা। তিনি আজ স্বাধীনতার মূল চেতনার বিপরীতে অবস্থান করছেন। তার একনায়কতান্ত্রিক শাসনের কারণে রাজাকারদের আবার সাহস বেড়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “আজ যদি দেশে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন হতো, তাহলে এই সরকার ক্ষমতায় থাকত না। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত ১৫ বছরে দেশে গণতন্ত্র নেই, ভোটাধিকার নেই, বিচার নেই। রাষ্ট্রীয় অর্থ লুটপাট করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। সাধারণ মানুষ নিজেদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। স্বাধীনতা আর গণতন্ত্র আজ কাঁদে।”
তার ভাষায়, “শেখ হাসিনা একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি দেশকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। এক সময় স্বাধীনতার কথা বলা আওয়ামী লীগকে আজ নিজের হাতে কলঙ্কিত করেছেন।”
“আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করতে হবে? আমরা সমর্থন করি না, কারণ এই দল ভাসানীর হাতে গড়া”
আলোচনায় আসে আওয়ামী লীগের ঐতিহ্য ও বর্তমান অবস্থান। তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হোক, সেটা আমরা সমর্থন করি না। কারণ এই দল ভাসানীর হাতে গড়া। ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা, স্বাধীনতা সংগ্রামে এই দলের ঐতিহাসিক অবদান রয়েছে।”
তবে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আজ শেখ হাসিনার জন্য সেই দল কলঙ্কিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের গলায় জুতার মালা পড়েছে, ভাস্কর্যের গায়ে মূত্র ত্যাগ করেছে। এই দৃশ্য দেখে একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা কিংবা দেশপ্রেমিক কি চুপ থাকতে পারে?”
“আমরা বিএনপির নেতৃত্বে জোট গঠন করবো”
তিনি বলেন, “আমরা মওলানা ভাসানীর চিন্তা ও আদর্শে বিশ্বাসী। জিয়াউর রহমান ছিলেন স্বাধীনতার ঘোষক, সেক্টর কমান্ডার। সেই ধারার নেতৃত্বে বিএনপির সঙ্গে আমরা জোটবদ্ধভাবে রাজনীতি করতে চাই।”
তার মতে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য থাকতেই পারে, তবে দেশের জন্য যেটি প্রয়োজন, সেটিই বড়। তিনি বলেন, “ড. ইউনুস একটি বিকল্প সরকার ও সংস্কারের কথা বলছেন—আমরা সেটাও মানি। তবে সংস্কার হবে রাজনৈতিকভাবে, কোন নির্বাহী আদেশে নয়।”
নির্বাচন ছাড়া কোনো সমাধান নেই
সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে তিনি বলেন, “বাংলার মানুষের মূল দাবি হচ্ছে একটি সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন। আমরা দেড় যুগ ধরে এই দাবিতে আন্দোলন করছি। শেখ হাসিনার পাতানো নির্বাচনের কারণে আজ ভোটাধিকার হরণ হয়েছে। জনগণ তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এজন্যই তিনি পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু এখন আবারো সেই পুরনো পথেই হাঁটছেন। নির্বাচনবিহীন দেশ চালাচ্ছেন। এটি গণতন্ত্রের অবমাননা।”
তার মতে, “ড. ইউনুস সাহেব যদি সত্যিই সংস্কারের কথা বলেন, তবে তার প্রথম কাজ হওয়া উচিত একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করে জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া। সরকার পরিবর্তন রাজনৈতিক প্রক্রিয়াতেই সম্ভব।”
আইনত দলে নিষেধাজ্ঞা সম্ভব, নির্বাহী আদেশে নয়
তিনি বলেন, “বিশ্ব ইতিহাসে দেখা গেছে—কিছু রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়েছে, তবে সেটা হয়েছে আইনের মাধ্যমে। কখনো নির্বাহী আদেশে নয়। আমাদের দেশের রাজনীতি আজ নির্বাহী আদেশের বন্দি, যা গণতান্ত্রিক চেতনার পরিপন্থী।”
সাক্ষাৎকারের শেষ কথায় কৃতজ্ঞতা ও প্রত্যয়
শেষ প্রশ্নের উত্তরে রফিকুল ইসলাম বাবলু বলেন, “বাংলাদেশ আজ দিকভ্রান্ত। মানুষ মুক্তি চায়, অধিকার চায়। আর সেই মুক্তির জন্য সবচেয়ে জরুরি সুষ্ঠু নির্বাচন, দায়িত্বশীল সরকার ও রাজনৈতিক শুদ্ধি।”
সাক্ষাৎকারের একেবারে শেষে তিনি বলেন, “আমি দৈনিক ভোরের আওয়াজ এবং The Daily Banner-কে ধন্যবাদ জানাই। আপনারা নির্ভয়ে আমাদের কথা তুলে ধরেছেন, এটাই আসল সাংবাদিকতা।”
উপসংহার:
শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলুর এই বক্তব্য শুধু একটি রাজনীতিকের মতামত নয়, এটি একটি দেশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক শুদ্ধতার পক্ষে দৃপ্ত উচ্চারণ। একজন ভাসানী-অনুসারীর মুখ থেকে এমন জোরালো বক্তব্য এটাই প্রমাণ করে—স্বাধীনতার প্রকৃত চেতনা এখনও জীবিত, এবং তা যারা বিশ্বাস করেন, তারা রাজাকারদের চিৎকার শুনে নিশ্চুপ নন।
প্রতিবেদক: যুগ্ম সম্পাদক, দৈনিক ভোরের আওয়াজ ও The Daily Banner- সহ সভাপতি-বাংলাদেশ পেশাজীবী সাংবাদিক কো-আপারেটিভ সোসাইটি লিঃ (বাপেসাস)।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ শাহজালাল, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন,যুগ্ম-সম্পাদক :মো. কামাল উদ্দিন,
নির্বাহী সম্পাদক : রাবেয়া সিরাজী
বার্তা ও বাণিজ্য বিভাগ : মোতালেব ম্যানশন, ২ আর কে মিশন রোড, মতিঝিল, ঢাকা-১২০৩।
মোবাইল : 01796-777753,01711-057321
ই-মেইল : bhorerawajbd@gmail.com