সন্ধ্যার শব্দহীনতায় তিস্তার পাড়ে এক লেখিকার স্বপ্নজাল—আফরোজা লীনার কথামালায় উষ্ণতার খোঁজ”
নিশীথের নিস্তব্ধতায় যখন শব্দেরা জেগে ওঠেছিল, আমি তখন আফরোজা লীনাকে নিয়ে লিখতে বসলাম। এই লেখাটি যেন তারই কোনো এক কবিতার ছায়ায় ভিজে ওঠা সন্ধ্যাকাব্যের মতো—কুয়াশায় মোড়া, ধূপগন্ধে ভাসা, নূপুরের ছন্দে জেগে থাকা। রাত গভীর। ঘড়ির কাঁটায় সময় পেরিয়ে গেছে দিনের প্রান্তসীমা। ঘরের জানালায় পর্দা নড়ছে হালকা হাওয়ায়, দূরের কোনো নাম না জানা গাছ থেকে ঝরে পড়ছে একেকটি পাতা—শব্দহীনতায়। ঠিক এই মুহূর্তে, আমি লিখতে বসেছি একজন লেখিকাকে নিয়ে, যাকে আমি জানি না, চিনি না, কোনোদিন দেখিনি—তবু তার লেখার শব্দেরা আমার ভেতর কিছু একটা জাগিয়ে তোলে। তিনি আফরোজা লীনা, এবং তার লেখা দেখে মনে হয়—এই নামটি সাহিত্যের বাতাসে এক কোমল সুবাস হয়ে আছে। তার প্রোফাইল পিকচারে “তিস্তার পাড়ের গল্প” বইটির প্রচ্ছদ। বইটি এখনো হাতে পাইনি, কিন্তু তার কথাগুলো, কবিতাগুলো, অনুভবগুলোর নিঃশব্দ ঢেউ আমাকে ছুঁয়ে গেছে। সন্ধ্যার মতোই নরম, মায়াবী ও গভীর তার লেখার স্বর।
এখানে সন্ধ্যা নামে হাঁসেদের দলে, নামে ফোঁটা ফোঁটা কুয়াশায়, মসজিদ-মন্দির-প্যাগোডার মৃদু প্রার্থনাধ্বনিতে। নামে বাবুই পাখির শৈল্পিক বাসায়, শিমের মাচায়, লজ্জাবতীর কুঁচকে পড়া পাতায়। আফরোজা লীনার লেখা ঠিক তেমনই—প্রকৃতি আর অনুভবের মিশেলে নির্মিত এক নিঃশব্দ জাদু। তার কবিতার প্রতিটি শব্দ যেন ধানের শীষে জমে থাকা শিশির, যেন কাঠগোলাপের পাপড়ির ভেতরে বাসা বাঁধা কোনো একান্ত প্রার্থনা। তার কথার ভেতর বয়ে চলে তিস্তার নদীর মতো এক মন্থর, অথচ অদম্য স্রোত। কখনো তা আবেগের, কখনো তা বেদনার, আবার কখনো নিঃসঙ্গতায় মোড়ানো গভীর এক সন্ধ্যাকাব্য। আমি জানি না তিনি কোথায় থাকেন, কী করেন, কেমন তার হাসি বা কণ্ঠস্বর। তবে এটুকু জানি, শব্দ দিয়ে কেউ যখন পাঠকের মনে উষ্ণতার আলোর রেখা আঁকে—তখন সে লেখক নয়, সে হয়ে ওঠে এক আত্মীয় আত্মার।
তাই আমি অপেক্ষায় আছি “তিস্তার পাড়ের গল্প” বইটির জন্য। সেই গল্প শুধু নদীর নয়, তা একজন সংবেদনশীল নারীর ভেতরের আলো-আঁধারির প্রতিচ্ছবি—একজন যিনি শব্দ দিয়ে জাগিয়ে তোলেন নীরব সন্ধ্যাকে, আর শব্দহীনতার মধ্যেই ছড়িয়ে দেন সাহিত্যের মায়াবী আভা।
লেখালেখির জগতে এমন কিছু মানুষ আছেন, যাদের শব্দ পাঠকের হৃদয়ে এক অনুচ্চারিত আন্দোলন তোলে। যাদের লেখার গভীরতা বোঝার জন্য তাদের ব্যক্তিগত পরিচয় জানার দরকার পড়ে না—শুধু ভাষার ছন্দ, অনুভবের স্বচ্ছতা, আর কথার উষ্ণতাই যথেষ্ট। ঠিক তেমনই একজন হলেন আফরোজা লীনা। আমি তাকে চিনি না, দেখিনি, জানিও না তার কোনো ব্যক্তিগত তথ্য—তবু তার কবিতা, তার লেখার ছায়া আমাকে গভীরভাবে ছুঁয়েছে। তাই এই রাতের একাকী নিস্তব্ধতায় তাকে নিয়েই কিছু কথা।
রাত গভীর। ঘরের জানালায় দুলছে পর্দা, বাইরে কুয়াশা ধীরে ধীরে চেপে ধরছে পথঘাট। এমন এক মুহূর্তে, যখন শব্দেরা ঘুমিয়ে পড়েছে, আমি তখন লিখতে বসেছি আফরোজা লীনাকে নিয়ে। তার প্রোফাইল পিকচারে ফুটে থাকা “তিস্তার পাড়ের গল্প” বইটির প্রচ্ছদ যেন এক টানাটানির জাদু ছড়ায়। বইটি এখনও হাতে পাইনি, কিন্তু তার লেখা দেখে মনে হয়, শব্দ দিয়ে কেউ সত্যিই নদী বানাতে জানে। তার কবিতায় সন্ধ্যা নামে হাঁসের দলে, কুয়াশায়, ধানের শীষে, ধূপের গন্ধে, বাবুইয়ের বাসায়, কাঠগোলাপের পাপড়িতে। প্রার্থনার ধ্বনি, নূপুরের ছন্দ, নিঃশব্দ নির্জনতায় তার কবিতা যেন জীবন্ত। এমন শব্দশিল্প আমি কমই দেখেছি—যেখানে প্রকৃতি, প্রেম, শূন্যতা আর উষ্ণতা একসঙ্গে চলেছে পঙ্ক্তির হাত ধরে। আফরোজা লীনার লেখা আমাকে জানায়—একজন লেখক কেবল শব্দের কারিগর নয়, তিনি এক নির্মাতা; যিনি পাঠকের মনে তৈরি করেন অনুভবের ঘর। আমি জানি না, তার চোখ কেমন, তার কণ্ঠস্বর কেমন, কিন্তু তার শব্দ জানি। জানি, তিনি ভাবনার গভীরে গিয়ে শব্দের রূপটিকে গড়েন শিল্পে। এই লেখাটি কোনো মূল্যায়ন নয়, কোনো সমালোচনাও নয়—এ এক নিঃশব্দ পাঠকের কৃতজ্ঞতা, যিনি অনুভব করেছেন শব্দের উষ্ণতা, আর সেই উষ্ণতার অনুপস্থিতিতে এখন কেবল অপেক্ষায় আছেন। “তিস্তার পাড়ের গল্প” শুধু একটি বই নয়—সেই বইয়ের ভেতরে রয়েছে একজন সংবেদনশীল, নীরব অথচ প্রখর লেখিকার হৃদয়ছোঁয়া সুর। সেই সুর এখনো আমার কানে বাজে, এই রাতের নির্জনতায়, এই কুয়াশার পাতায়—যেমন কেউ দূর থেকে ফিসফিসিয়ে বলে,
“লেখা শেষ হয় না কখনো—শুধু একেকটি অনুভবের নতুন শুরু হয়।”
আফরোজা লীনা—আপনার লেখার জন্য এই শীতার্ত সন্ধ্যায় পাঠকের অপেক্ষা নিঃশব্দ, অথচ অন্তরঙ্গ।