"দানবাক্স পাহারায় ছদ্মবেশী মোড়ল মজু: সুদের ঘুঁটে গড়া দেউলিয়া জীবনের প্রতারণাপূর্ণ অধ্যায়""
--শহর থেকে গ্রামে—এক ভণ্ড মোড়লের রূপান্তর-অনুসন্ধানে: দৈনিক ভোরের আওয়াজ ও সময় আলো প্রতিবেদক দলঃ
চাকতাইয়ের শুটকি পট্টি। এক সময়ের গমগমে বাণিজ্যিক এলাকা। সেইখানেই ছিল মোড়ল মজুর ‘রাজত্ব’। কথায়, ভঙ্গিমায়, বাহারে এক অনন্য প্রতারক রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তিনি। মুখে ধর্মের বুলি, হাতে সুদের খাতা—লোক ঠকানো ছিল তার অভ্যাস, জীবনচর্চা। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে তিনি বলতেন, “আল্লাহর ওপর ভরসা রাখো”—আর পেছনে গোপনে চলত সুদের জাল। নগরজীবনের পতন,ব্যবসার নামে লোকজনের কাছ থেকে টাকা ধার নেওয়া, সুদের নামে গরিবদের সর্বস্ব কাড়ার অভিযোগে এক সময় তাকে ঘিরে তৈরি হয় জনরোষ। একে একে লোকজন তার আসল চেহারা চিনতে শুরু করে। দেনায় জর্জরিত হয়ে, সম্মান হারিয়ে যখন আর শহরে টিকতে পারলেন না, তখন তিনি নিঃশব্দে হারিয়ে গেলেন।
কিন্তু প্রতারকেরা সহজে হেরে যায় না। মজুও হারেননি, শুধু রঙ পাল্টেছেন। আশ্রয় নিলেন পশ্চিম চরণদ্বীপ সিরাজ চৌধুরী মসজিদে। নিজেকে ধর্মপ্রাণ বানিয়ে বসালেন মসজিদ কমিটির একজন ‘নম্র’ কর্মী হিসেবে। কৌশলে পেলেন দানবাক্স পাহারার দায়িত্ব। মানুষ যখন জানল, শহরের এক 'পশ্চাতাপরায়ণ' মানুষ এখন ধর্মের পথে—তখন কেউ আর প্রশ্ন তুলল না। মানুষ যেমন বিশ্বাস করতে চায়, মজুও তেমন রূপ ধারণ করলেন।
পবিত্রতা ছদ্মবেশ, ভেতরে সুদের নোংরা কারখানা- মসজিদের দানবাক্স! একটি পবিত্র প্রতীক, যেখান থেকে চলে গরিবের ইফতার, মাদ্রাসার খরচ, অসুস্থদের চিকিৎসা। সেই দানবাক্সই হয়ে উঠল মজুর নতুন সুদের মূলধন। মানুষের দানের টাকা দিয়ে তিনি শুরু করলেন পুরনো ব্যবসা—সুদের চক্র। গোপনে টাকাগুলো নির্দিষ্ট কয়েকজনের মাধ্যমে ঋণ হিসেবে ছড়িয়ে দিলেন, আর ফিরিয়ে নিলেন দ্বিগুণ, কখনো তিনগুণ। মসজিদের নাম ব্যবহার করে অনেককে ‘শরিয়া ভিত্তিক’ ব্যবসার নামে প্রলুব্ধ করলেন। তিন বছর ধরে চলছে এই কর্মকাণ্ড। কোনো অডিট নেই, কোনো হিসাব নেই। জিজ্ঞেস করলে বলেন, “সব আল্লাহর ইচ্ছায় চলছে”—আসলে চলেছে নিজের বিলাসিতার জীবন। একদিকে দানবাক্স থেকে চলছে মজুর সংসার, অন্যদিকে সেই টাকায় চলছে সুদের বাণিজ্য। অথচ মসজিদের মিনারে আজও ভেসে আসে আজানের ধ্বনি, কেউ জানে না—মিনারের নিচে দাঁড়িয়ে একজন মানুষ সেই পবিত্র আওয়াজকে বানিয়ে তুলেছে নিজ লাভের ঢাল।
নারী, মদ ও মোড়লগিরির অন্ধকার অধ্যায়- মজুর অতীত কেবল অর্থনৈতিক নয়, চারিত্রিক পতনেরও উদাহরণ। নারী ঘটিত অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। শহর ছাড়ার অন্যতম কারণও এটি। একাধিক বিবাহ, প্রতারণামূলক সম্পর্ক, নারীদের সম্মানহানি করে লাভবান হওয়া—এসব ছিল তার অপরিচিত নয়।
এমনকি চেয়ারম্যান নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সময় এলাকার ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের কাছ থেকে 'চাঁদা' নামে আদায় করা টাকা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। পরাজয়ের পর এসব টাকার কোনো জবাবদিহি ছিল না। বরং একপর্যায়ে নিজের পরিবারের কাছেও হয়ে ওঠেন অবাঞ্ছিত। পরিবারের মানুষজন বলেছে, “আমরা তাকে ত্যাগ করেছি—সে শুধু লজ্জা ডেকে এনেছে।”
মজু সেই ব্যক্তি, যিনি নিজের স্বার্থে নজর মোহাম্মদ গোষ্ঠীর পারিবারিক কবরস্থানের মালিকানা নিয়ে গণমাধ্যমে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছেন। এমনকি মৃতদের স্বজনদের কাছ থেকেও আদায় করেছেন চাঁদার টাকা।মসজিদের সভাপতি—এক প্রশ্নবিদ্ধ মর্যাদা-আজ সেই মজুই মসজিদ কমিটির সভাপতি! এলাকার নিরীহ ধর্মপ্রাণ মানুষের সঙ্গে কৌশলে মিশে গিয়ে তিনি বনে গেছেন ‘পরামর্শদাতা’, ‘দরবেশ’ এবং কখনো কখনো ‘গুরুজন’। অথচ পিছনের কাহিনি ভয়াবহ। এই লোক কীভাবে এতবড় পবিত্র দায়িত্ব পালন করছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে চারদিকে। ভোরের আওয়াজ ও সময় আলো-এর অনুসন্ধান দল ইতিমধ্যেই একাধিক চাঞ্চল্যকর তথ্য সংগ্রহ করেছে। আমরা পেয়েছি মজুর সুদের খাতা, তার নারীঘটিত অডিও রেকর্ড, চাঁদাবাজির লেনদেনের লিখিত প্রমাণ, এবং সেইসব সাক্ষাৎকার—যেখানে নিরীহ মানুষ বলেছেন, কিভাবে তারা এই ছদ্মবেশী মোড়লের ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হয়েছেন।
সুদে গলা ডোবা গরিবের কান্না—দানবাক্স থেকে স্বর্ণালঙ্কার, ছড়িয়ে পড়া চক্র
অনুসন্ধানে: দৈনিক ভোরের আওয়াজ ও সময় আলো প্রতিবেদক দল
গ্রামের ছোট মসজিদটির দানবাক্স একসময় ছিল সমাজের সহানুভূতির প্রতীক। কিন্তু মোড়ল মজুর হাতে পড়ে সেটিই হয়ে উঠেছে সুদের মূলধন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত তিন বছরে মজু দানবাক্স থেকে উঠিয়েছেন লক্ষাধিক টাকা, যা দিয়ে গোপনে গরিব মানুষদের সুদের ফাঁদে ফেলেছেন।
একাধিক নারী অভিযোগ করেছেন—দুস্থ সহায়তার নামে মজু প্রথমে সহানুভূতি দেখিয়ে টাকা দেন, পরে তার সুদ আদায়ের পদ্ধতি হয় অপমানজনক ও অমানবিক। কেউ সময়মতো ফেরত দিতে না পারলে তাদের গৃহস্থালি জিনিস, এমনকি স্বর্ণালঙ্কার পর্যন্ত হস্তগত করেন। এক বিধবা নারীর গলার হার খুলে নেওয়ার ঘটনাও উঠে এসেছে আমাদের অনুসন্ধানে। এই পুরো চক্র চালাতে মজু ব্যবহার করছেন দুই থেকে তিনজন 'মধ্যস্থতাকারী'—যারা সুদের টাকা আদায় করে, আবার বিপদে পড়া মানুষকে ভয় দেখায় মসজিদ কমিটির নামে। অথচ মসজিদের প্রকৃত আয়-ব্যয়ের কোনো স্বচ্ছ হিসাব নেই। জিজ্ঞাসা করলে মজুর উত্তর একটাই—"হিসাব রাখে আল্লা।
মিথ্যা সাক্ষ্য, চাঁদাবাজি আর নারীঘটিত কেলেঙ্কারি—ধর্মের মুখোশে এক সমাজবিধ্বংসীর উত্থান,অনুসন্ধানে: দৈনিক ভোরের আওয়াজ ও সময় আলো--মোড়ল মজুর কাহিনি যেন এক সমাজবিরোধী নাটক—যার প্রতিটি পর্বে লুকিয়ে আছে মিথ্যাচার, কেলেঙ্কারি আর ক্ষমতার অপব্যবহার। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, চেয়ারম্যান নির্বাচনের সময় তিনি স্থানীয় ব্যবসায়ী ও প্রবাসী পরিবারের কাছ থেকে "চাঁদা" সংগ্রহ করেছিলেন জোরপূর্বক। অনেকে টাকা না দিলে তাদের নামে ‘নামধারী দলিল’, আবার কারো বিরুদ্ধে মসজিদ কমিটির লোকজনকে দিয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য আদায় করেছিলেন।
এখানেই শেষ নয়। একাধিক নারীঘটিত কেলেঙ্কারি ও পারিবারিক নির্যাতনের কারণে তার নিজের স্ত্রী-সন্তানও তাকে ত্যাগ করেছে। এলাকাবাসীর ভাষ্যমতে, রাতবিরাতে ‘দাওয়াতি বৈঠক’-এর নামে মজুর যাতায়াত ছিল সন্দেহজনক নারীদের ঘরে। অথচ মসজিদে সকালবেলা উঠে দাঁড়িয়ে দিতেন 'নৈতিকতার ভাষণ'। মজু এখন মসজিদ কমিটির সভাপতি। অথচ তার হাতেই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ইজ্জত বারবার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। "মসজিদ নয়, যেন এক সুদব্যবসার ঘাঁটি"—এ মন্তব্য এখন চাক্তাই থেকে শুরু করে আশেপাশের গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে।
পরবর্তী পর্বে:৷ চোখ রাখুন --
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ শাহজালাল, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন,যুগ্ম-সম্পাদক :মো. কামাল উদ্দিন,
নির্বাহী সম্পাদক : রাবেয়া সিরাজী
বার্তা ও বাণিজ্য বিভাগ : মোতালেব ম্যানশন, ২ আর কে মিশন রোড, মতিঝিল, ঢাকা-১২০৩।
মোবাইল : 01796-777753,01711-057321
ই-মেইল : bhorerawajbd@gmail.com